ঢাকা ০১:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সত্যজিতের চলচ্চিত্রে নারী

সুদীপ্ত মিত্র | ৬ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:১২::
ফেলুদা কি বিবাহিত? তোপসের গার্লফ্রেন্ডের নাম জানেন? আর লালমোহন বাবু গিন্নি? তিনি নাকি খুব সাবেকি? সহজে ঘরের বাইরে বের হন না? শুনেছি প্রফেসর শঙ্কুর স্ত্রী নাকি গিরিডি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপিকা? তারিণী খুড়ে কি বিপতœীক? অল্প বয়সে স্ত্রীকে হারিয়ে ভবঘুরে হয়ে গিয়েছিলেন? …না, এমনটা কল্পনাও করা যায় না। আমরা যারা, আবালবৃদ্ধবনিতা, সত্যজিতের গল্পের ভক্ত তারা জানি সত্যজিতের চরিত্র বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নিপাট এক অন্তর্মুখী মধ্যবিত্ত বাঙালির ছবি যিনি অবশ্যই অকৃতদার। বস্তুত সত্যজিতের সবকটি রপড়হরপ ক্যারেক্টারগুলো যেমন ফেলুদা, লালমোহনবাবু, প্রফেসর শঙ্কু এবং তাঁর প্রতিবেশী অবিনাশ মজুমদার, তারিণীখুড়োÑএঁরা কেউই বিবাহিত নন। এমনকি সত্যজিতের ভয়ঙ্কর ভিলেন মাঘানলাল মেঘরাজের স্ত্রী ছিল বলে কখনো শুনিনি। সত্যজিতের অমর সৃষ্টি ফেলুদা সিরিজের ৩৯টি
কাহিনীর কোনোটিতে কোনো স্ত্রী চরিত্রের প্রাধান্য দেখা যায় না। অপরদিকে প্রফেসর শঙ্কুর ৪০টি গল্প নারী বর্জিত। ছোট বড় সবার জন্য লেখা ১০০টিরও বেশি ছোটগল্পে মাত্র ২ গল্পে স্ত্রী চরিত্র মুখ্য ভূমিকায় দেখা যায়। পিকুর ডায়েরি ও ময়ূরকণ্ঠী জেলি-দুটিই বড়দের জন্য লেখা। এমনকি অনুবাদ সাহিত্যেও সত্যজিৎ নারী চরিত্রকে বাদ রেখেছে।
অথচ রুপালি পর্দায় সত্যজিৎ? সে এক বিপরীত মানুষ। নারী চরিত্রের জটিল মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোকে নিয়ে সূক্ষ্মভাবে কাজ করেছেন তিনি। মোট ৩৪টি গল্প নিয়ে ছবি করেছেন সত্যজিৎ, তার মধ্যে ১৯টি ছবিতে গল্পের ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন মুখ্য ভূমিকায় থাকা কোনো নারী। নারীর আত্মমর্যাদা, নারীর মমতা, নারীর প্রেম, নারীর ভালোবাসা, নারীর লালসা, নারীর স্বাধীনতা, মাতৃরূপী নারী, নারীর উচ্চাকাক্সক্ষা, নারীর অভিলাষ, নারীর দ্বিচারিতা ও নারীর ব্যাভিচার-মূলত নারী চরিত্রের এই জটিল দিকগুলোকে সত্যজিৎবাবু তাঁর সিনেমায় ব্যবহার করেছেন।
আজকের আলোচনায় আমরা এরকমই ৯ জন নারীকে উদাহরণ স্বরূপ বেছে নিয়েছি। যে কজন বিশেষ নারী আজ আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন, তাঁরা হচ্ছেনÑ সর্বজয়া, মণিমালিকা, রতন, দয়াময়ী, চারুবালা, আরতি, বিমলা, প্রমীলা এবং মিসেস ত্রিপাঠি।
প্রথমে আমরা যাঁকে দেখবো তিনি সর্বজয়া। সর্বজয়া দরিদ্র ব্রাহ্মণ গৃহিণী। সর্বজয়া দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক, সর্বজয়া মাতৃত্বের প্রতীক, সর্বজয়া আত্মমর্যাদার প্রতীক। সর্বজয়া শত দারিদ্র্যেও আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দেয়নি। ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে চরিত্রটির রূপদান করেছেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘পথের পাঁচালি’ ছবির একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই পাড়ার প্রতিবেশী ও জ্ঞাতি, সর্বজয়ার বাড়ি বয়ে এসে দুর্গাকে ভর্ৎসনা করে যাচ্ছে। দুর্গা সেই সময় বাড়ির বাইরে। দুর্গার বিরুদ্ধে অভিযোগ দুর্গা নাকি তাঁদের বাড়িতে বাড়ির ছোট মেয়েদের সঙ্গে খেলতে এসে নতুন কেনা একটি পুঁথির মালা চুরি করে নিয়ে গেছে। সর্বজয়ার মাতৃস্নেহ এই অভিযোগ মেনে নিতে পারে না। মেয়ের নামে অপবাদের তীব্র প্রতিবাদ করে সে। এই কাজ দুর্গা করতেই পারে না। অথচ ছবির শেষে আমরা দেখতে পাই পুঁথির মালাটা দুর্গাই নিয়েছিল। কিশোরী দুর্গা তার বড় লোক জ্ঞাতির বাড়িতে মালাটা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। দুর্গার মৃত্যুর পরে একটি লুকানো নারকেলের মালার ভেতর থেকে অপু সেটিকে উদ্ধার করে গোপনে পুকুরের জলে বিসর্জন দিয়ে যায় মুক্ত হয়।
অলঙ্কার প্রত্যেক নারীরই প্রিয়। কিন্তু অলঙ্কারের প্রতি নারীর আসক্তি কখনো কখনো মানসিক ব্যাধির আকার নেয়। যেমনটি ঘটেছিল মণিমালিকার ক্ষেত্রে। এটি রবীন্দ্র সৃষ্ট চরিত্র। নিঃসন্তান সুন্দরী স্ত্রীর ভালোবাসা পেতে বিত্তশালী ফণিভূষণ একের জানতেন না তার স্ত্রীর এই স্বর্ণতৃষ্ণাই তাঁর জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনবে। ঘটনা চক্রে একদিন ফণিভূষণের ব্যবসায় মন্দা আসে এবং ফণিভূষণ কলকাতায় যায় অর্থ সংগ্রহ করতে। পাছে তার গয়নার বাক্সে হাত পড়ে, তাই মণিমালিকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে গোপনে গৃহত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। কিন্তু মণিমালিকার একটি আপসোস রয়ে গেল, টাকার জোগাড় হলে তার স্বামী একটা গয়না গড়িয়ে দেবেন বলেছিলেন, সেটি আর নেয়া হলো না। ‘মণিহারা’ ছবিতে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন কণিকা মজুমদার। কিন্তু লালসা নারীর আসল রূপ নয়। নারী নিঃস্বার্থ ভালোবাসারও প্রতীক। যেমন ধরুন ‘পোস্টমাস্টার’ ছবিতে গ্রামের অনাথ বালিকা রতনের কথা। গ্রামের একটি মাত্র সাব পোস্ট অফিস। আর সেই পোস্ট মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কাজ করে রতন। বিনিময়ে জোটে একমুঠো অন্ন আর একটু আশ্রয়। তবুও নতুন মাস্টারমশাইয়ের একটু স্নেহ, একটু মমতা তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে ফেলে। মাস্টারমশাই একদিন চাকরি ছেড়ে চলে যান। ভগ্ন হৃদয়ে এই অনাথ বালিকার মনের খবর কে রাখে? ছবির শেষ দৃশ্যে বোঝা যায় অনাথ শিশুটির কাছে সামান্য ক’টা টাকার চেয়ে স্নেহ ভালোবাসার দাম অনেক বেশি।
মাতৃত্ব নারীর আভরণ। আবার সেই মাতৃরূপ কখনো কখনো বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল গ্রামের জমিদারের ছোট বৌমা দয়াময়ীর জীবনে। কালীভক্ত জমিদার কালীকিঙ্কর রায় একদিন তাঁর ছোট বৌমার মধ্যে দেবী দর্শন লাভ করেন। সেই থেকে রক্ত মাংসের দয়াময়ীর স্থান হয় দেবী দালানে। স্বামী ও সংসারের সুখের বিনিময়ে দয়াময়ী আজ দেবীর আসনে অধিষ্টিত। ‘দেবী’ ছবিতে দয়াময়ীর ভূমিকায় অভিনয় করেন শর্মিলা ঠাকুর।
চারুবালা শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, রুচিশীলা তরুণী। চারু সাহিত্যপ্রেমী। তার সাহিত্য চর্চায় একমাত্র সঙ্গী অমল। প্রায় সমবয়স্ক অমল চারুর পিশততো দেওর। চারুর একান্ত ইচ্ছে তাদের দুজনের সাহিত্য সৃষ্টি যেন বাইরের জগতে প্রকাশ না পায়। কিন্তু অমল তার কথা রাখেনি। একদিন এক পত্রিকায় আমলের লেখা ছাপা হয়। মনে মনে কষ্ট পেলেও প্রকাশ করে না চারু। অমলের প্রতি তার অন্ধ ভালোবাসা কখনো অমলকে জানতে দেয়নি চারু। অমল তার একান্ত সাহিত্য চর্চার সঙ্গী। অমল শুধু চারুর। আমলের সাহিত্য সৃষ্টি যেন শুধুই তার-অন্যকে ভাগ করার বস্তু নয়। অমলের লেখার কদর করার অধিকার একমাত্র চারুই থাকবে। অথচ বৌঠানের এই প্রচ- অধিকারবোধের সন্ধান অমল কখনো পায়নি। অমলের লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছেÑ এতে অমলের প্রতি তার অধিকার খর্ব হয়েছে। অমলকে কিছুটা জব্দ করার জন্যই একদিন চারুও গোপনে কলম ধরে এবং অচিরেই তার লেখা বের হয় ‘বিশ্ববন্ধু’র মতো জনপ্রিয় পত্রিকায়। চারুর উদ্দেশ্য ছিল অমলের কাছে নিজেকে প্রমাণ করা যে সাহিত্য সৃষ্টিতে সেও কম যায় না। অথচ অমল যেন তাতে দুঃখ না পায়ে। অমল অবশ্য বৌঠানের লেখন শৈলী দেখে আশ্চর্যই হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’য় নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়।
‘মহানগরের’ আরতি নারী স্বাধীনতার প্রতীক। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের শিক্ষিতা স্ত্রী, বৃহত্তর সংসারের হাল ধরতে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ির এমনকি নিজের বাবার অমতে চাকরিরতা। স্বামী সুব্রত সামান্য ব্যাংকের কর্মচারী কিন্তু সংসারের অভাব তাঁর কাছে স্ত্রী স্বাধীনতার চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক। চাকরির সুবাদে অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলা মেশায় তাঁর ঘোর আপত্তি। অবশেষে একদিন আরতির স্বামী চাকরি খোয়ায়। হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করেন সুব্রত। অথচ পুরুষ শাসিত সমাজে আরতি তার স্বামীর আর্থিক সংকটের কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। ছবিতে আরতির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়।
‘ঘরে বাইরে’ ছবির বিমলা রবীন্দ্র সৃষ্ট চরিত্র। ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই চরিত্রের জন্ম। বিমলার স্বামী নিখিল জমিদার। আর দশটা বিত্তশালী জমিদারের থেকে নিখিল একটু আলাদা। প্রগতিশীল নিখিল বিলেত ফেরত উচ্চ শিক্ষিত। নিখিল ‘মহানগরের’ সুব্রত নয়। নিখিল নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। নিখিল চায় তাঁর স্ত্রী অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক যুগের সঙ্গে পরিচিত হোক। অবশেষে প্রথা ভেঙে স্ত্রীকে অন্দরমহল থেকে বাইরে এনে এক বিপ্লব সৃষ্টি করে নিখিল। বিমলা তাঁর স্বামী ছাড়া জীবনে যে পুরুষটির কাছে প্রথম এসেছিল তিনি স্বদেশি বিপ্লবী নিখিলের সহপাঠী, সন্দীপ। সন্দীপের বাচন শৈলী বিমলাকে আকৃষ্ট করে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজেকে সামলাতে পারেনি বিমলা। গড়ে উঠে এক ত্রিকোণ প্রেমের উপাখ্যান। ক্রমশ আত্মসংযম হারায় বিমলা। ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে বিমলার চরিত্রে অভিনয় করেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।
নারী সর্বদাই রহস্যময়ী, আর যদি সে হয় উচ্চাভিলাষী তা হলে তো কথাই নেই। প্রমীলা এমনি এক রহস্যময়ী নারী। নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো রহস্য? পর্দায় হিরোইন হওয়াই কি তার জীবনের একমাত্র বাসনা? তবে কেন স্বপ্নের নায়কের সঙ্গে দেখা করতে রাতের অন্ধকারকেই বেছে নেয় সে? মাত্র একটি দৃশ্যে প্রমীলাকে পর্দায় এনেছেন সত্যজিৎ। আলো আঁধারি দৃশ্যে রহস্যমাখা কথোপকথন। উচ্ছ্বসিত যৌবনা প্রমীলা কি তার স্বপ্নের নায়ককে প্রলুব্ধ করতে চায়? প্রমীলা কি বিবাহিতা? অরিন্দম উত্তর পায় না। সে কিন্তু সংযত, সতর্ক। গোটা ছবিতে আমরা দেখতে পাই অরিন্দমের মনের কোঠায় এমনকি স্বপ্নেও প্রমীলার উপস্থিতি বার বার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রমীলাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না অরিন্দম। …“নায়ক” ছবিতে প্রমীলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুমিতা সান্যাল।
মিসেস জয়া ত্রিপাঠি। একজন প্রাণবন্তু, প্রাণোচ্ছল নারী। কলকাতার এক আধুনিক শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারের ঘরনী, খুব অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। অত্যন্ত মিশুকে এই পরিবারটির সঙ্গে পালামৌয়ে ছুটি কাটাতে গিয়ে আলাপ হলো কলকাতার কয়েকজন শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত যুবকের। রক্ষণশীল বিত্তশালী পরিবারের বিধনা নারী আকৃষ্ট হন অত্যন্ত সংযক্ত, সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত, শিক্ষিত অথচ অনাড়ম্বর, সাম্যবাদী সঞ্জয়ের প্রতি। সেদিন এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মনের কথা গোপন রাখতে পারেননি মিসেস ত্রিপাঠি। ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ ছবিতে চরিত্রটি রূপায়ণ করেছেন কাবেরী বসু। 
Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

সত্যজিতের চলচ্চিত্রে নারী

আপডেট টাইম ০২:৩৫:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ জুন ২০১৯
সুদীপ্ত মিত্র | ৬ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:১২::
ফেলুদা কি বিবাহিত? তোপসের গার্লফ্রেন্ডের নাম জানেন? আর লালমোহন বাবু গিন্নি? তিনি নাকি খুব সাবেকি? সহজে ঘরের বাইরে বের হন না? শুনেছি প্রফেসর শঙ্কুর স্ত্রী নাকি গিরিডি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপিকা? তারিণী খুড়ে কি বিপতœীক? অল্প বয়সে স্ত্রীকে হারিয়ে ভবঘুরে হয়ে গিয়েছিলেন? …না, এমনটা কল্পনাও করা যায় না। আমরা যারা, আবালবৃদ্ধবনিতা, সত্যজিতের গল্পের ভক্ত তারা জানি সত্যজিতের চরিত্র বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নিপাট এক অন্তর্মুখী মধ্যবিত্ত বাঙালির ছবি যিনি অবশ্যই অকৃতদার। বস্তুত সত্যজিতের সবকটি রপড়হরপ ক্যারেক্টারগুলো যেমন ফেলুদা, লালমোহনবাবু, প্রফেসর শঙ্কু এবং তাঁর প্রতিবেশী অবিনাশ মজুমদার, তারিণীখুড়োÑএঁরা কেউই বিবাহিত নন। এমনকি সত্যজিতের ভয়ঙ্কর ভিলেন মাঘানলাল মেঘরাজের স্ত্রী ছিল বলে কখনো শুনিনি। সত্যজিতের অমর সৃষ্টি ফেলুদা সিরিজের ৩৯টি
কাহিনীর কোনোটিতে কোনো স্ত্রী চরিত্রের প্রাধান্য দেখা যায় না। অপরদিকে প্রফেসর শঙ্কুর ৪০টি গল্প নারী বর্জিত। ছোট বড় সবার জন্য লেখা ১০০টিরও বেশি ছোটগল্পে মাত্র ২ গল্পে স্ত্রী চরিত্র মুখ্য ভূমিকায় দেখা যায়। পিকুর ডায়েরি ও ময়ূরকণ্ঠী জেলি-দুটিই বড়দের জন্য লেখা। এমনকি অনুবাদ সাহিত্যেও সত্যজিৎ নারী চরিত্রকে বাদ রেখেছে।
অথচ রুপালি পর্দায় সত্যজিৎ? সে এক বিপরীত মানুষ। নারী চরিত্রের জটিল মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোকে নিয়ে সূক্ষ্মভাবে কাজ করেছেন তিনি। মোট ৩৪টি গল্প নিয়ে ছবি করেছেন সত্যজিৎ, তার মধ্যে ১৯টি ছবিতে গল্পের ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন মুখ্য ভূমিকায় থাকা কোনো নারী। নারীর আত্মমর্যাদা, নারীর মমতা, নারীর প্রেম, নারীর ভালোবাসা, নারীর লালসা, নারীর স্বাধীনতা, মাতৃরূপী নারী, নারীর উচ্চাকাক্সক্ষা, নারীর অভিলাষ, নারীর দ্বিচারিতা ও নারীর ব্যাভিচার-মূলত নারী চরিত্রের এই জটিল দিকগুলোকে সত্যজিৎবাবু তাঁর সিনেমায় ব্যবহার করেছেন।
আজকের আলোচনায় আমরা এরকমই ৯ জন নারীকে উদাহরণ স্বরূপ বেছে নিয়েছি। যে কজন বিশেষ নারী আজ আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন, তাঁরা হচ্ছেনÑ সর্বজয়া, মণিমালিকা, রতন, দয়াময়ী, চারুবালা, আরতি, বিমলা, প্রমীলা এবং মিসেস ত্রিপাঠি।
প্রথমে আমরা যাঁকে দেখবো তিনি সর্বজয়া। সর্বজয়া দরিদ্র ব্রাহ্মণ গৃহিণী। সর্বজয়া দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক, সর্বজয়া মাতৃত্বের প্রতীক, সর্বজয়া আত্মমর্যাদার প্রতীক। সর্বজয়া শত দারিদ্র্যেও আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দেয়নি। ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে চরিত্রটির রূপদান করেছেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘পথের পাঁচালি’ ছবির একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই পাড়ার প্রতিবেশী ও জ্ঞাতি, সর্বজয়ার বাড়ি বয়ে এসে দুর্গাকে ভর্ৎসনা করে যাচ্ছে। দুর্গা সেই সময় বাড়ির বাইরে। দুর্গার বিরুদ্ধে অভিযোগ দুর্গা নাকি তাঁদের বাড়িতে বাড়ির ছোট মেয়েদের সঙ্গে খেলতে এসে নতুন কেনা একটি পুঁথির মালা চুরি করে নিয়ে গেছে। সর্বজয়ার মাতৃস্নেহ এই অভিযোগ মেনে নিতে পারে না। মেয়ের নামে অপবাদের তীব্র প্রতিবাদ করে সে। এই কাজ দুর্গা করতেই পারে না। অথচ ছবির শেষে আমরা দেখতে পাই পুঁথির মালাটা দুর্গাই নিয়েছিল। কিশোরী দুর্গা তার বড় লোক জ্ঞাতির বাড়িতে মালাটা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। দুর্গার মৃত্যুর পরে একটি লুকানো নারকেলের মালার ভেতর থেকে অপু সেটিকে উদ্ধার করে গোপনে পুকুরের জলে বিসর্জন দিয়ে যায় মুক্ত হয়।
অলঙ্কার প্রত্যেক নারীরই প্রিয়। কিন্তু অলঙ্কারের প্রতি নারীর আসক্তি কখনো কখনো মানসিক ব্যাধির আকার নেয়। যেমনটি ঘটেছিল মণিমালিকার ক্ষেত্রে। এটি রবীন্দ্র সৃষ্ট চরিত্র। নিঃসন্তান সুন্দরী স্ত্রীর ভালোবাসা পেতে বিত্তশালী ফণিভূষণ একের জানতেন না তার স্ত্রীর এই স্বর্ণতৃষ্ণাই তাঁর জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনবে। ঘটনা চক্রে একদিন ফণিভূষণের ব্যবসায় মন্দা আসে এবং ফণিভূষণ কলকাতায় যায় অর্থ সংগ্রহ করতে। পাছে তার গয়নার বাক্সে হাত পড়ে, তাই মণিমালিকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে গোপনে গৃহত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। কিন্তু মণিমালিকার একটি আপসোস রয়ে গেল, টাকার জোগাড় হলে তার স্বামী একটা গয়না গড়িয়ে দেবেন বলেছিলেন, সেটি আর নেয়া হলো না। ‘মণিহারা’ ছবিতে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন কণিকা মজুমদার। কিন্তু লালসা নারীর আসল রূপ নয়। নারী নিঃস্বার্থ ভালোবাসারও প্রতীক। যেমন ধরুন ‘পোস্টমাস্টার’ ছবিতে গ্রামের অনাথ বালিকা রতনের কথা। গ্রামের একটি মাত্র সাব পোস্ট অফিস। আর সেই পোস্ট মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কাজ করে রতন। বিনিময়ে জোটে একমুঠো অন্ন আর একটু আশ্রয়। তবুও নতুন মাস্টারমশাইয়ের একটু স্নেহ, একটু মমতা তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে ফেলে। মাস্টারমশাই একদিন চাকরি ছেড়ে চলে যান। ভগ্ন হৃদয়ে এই অনাথ বালিকার মনের খবর কে রাখে? ছবির শেষ দৃশ্যে বোঝা যায় অনাথ শিশুটির কাছে সামান্য ক’টা টাকার চেয়ে স্নেহ ভালোবাসার দাম অনেক বেশি।
মাতৃত্ব নারীর আভরণ। আবার সেই মাতৃরূপ কখনো কখনো বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল গ্রামের জমিদারের ছোট বৌমা দয়াময়ীর জীবনে। কালীভক্ত জমিদার কালীকিঙ্কর রায় একদিন তাঁর ছোট বৌমার মধ্যে দেবী দর্শন লাভ করেন। সেই থেকে রক্ত মাংসের দয়াময়ীর স্থান হয় দেবী দালানে। স্বামী ও সংসারের সুখের বিনিময়ে দয়াময়ী আজ দেবীর আসনে অধিষ্টিত। ‘দেবী’ ছবিতে দয়াময়ীর ভূমিকায় অভিনয় করেন শর্মিলা ঠাকুর।
চারুবালা শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, রুচিশীলা তরুণী। চারু সাহিত্যপ্রেমী। তার সাহিত্য চর্চায় একমাত্র সঙ্গী অমল। প্রায় সমবয়স্ক অমল চারুর পিশততো দেওর। চারুর একান্ত ইচ্ছে তাদের দুজনের সাহিত্য সৃষ্টি যেন বাইরের জগতে প্রকাশ না পায়। কিন্তু অমল তার কথা রাখেনি। একদিন এক পত্রিকায় আমলের লেখা ছাপা হয়। মনে মনে কষ্ট পেলেও প্রকাশ করে না চারু। অমলের প্রতি তার অন্ধ ভালোবাসা কখনো অমলকে জানতে দেয়নি চারু। অমল তার একান্ত সাহিত্য চর্চার সঙ্গী। অমল শুধু চারুর। আমলের সাহিত্য সৃষ্টি যেন শুধুই তার-অন্যকে ভাগ করার বস্তু নয়। অমলের লেখার কদর করার অধিকার একমাত্র চারুই থাকবে। অথচ বৌঠানের এই প্রচ- অধিকারবোধের সন্ধান অমল কখনো পায়নি। অমলের লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছেÑ এতে অমলের প্রতি তার অধিকার খর্ব হয়েছে। অমলকে কিছুটা জব্দ করার জন্যই একদিন চারুও গোপনে কলম ধরে এবং অচিরেই তার লেখা বের হয় ‘বিশ্ববন্ধু’র মতো জনপ্রিয় পত্রিকায়। চারুর উদ্দেশ্য ছিল অমলের কাছে নিজেকে প্রমাণ করা যে সাহিত্য সৃষ্টিতে সেও কম যায় না। অথচ অমল যেন তাতে দুঃখ না পায়ে। অমল অবশ্য বৌঠানের লেখন শৈলী দেখে আশ্চর্যই হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’য় নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়।
‘মহানগরের’ আরতি নারী স্বাধীনতার প্রতীক। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের শিক্ষিতা স্ত্রী, বৃহত্তর সংসারের হাল ধরতে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ির এমনকি নিজের বাবার অমতে চাকরিরতা। স্বামী সুব্রত সামান্য ব্যাংকের কর্মচারী কিন্তু সংসারের অভাব তাঁর কাছে স্ত্রী স্বাধীনতার চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক। চাকরির সুবাদে অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলা মেশায় তাঁর ঘোর আপত্তি। অবশেষে একদিন আরতির স্বামী চাকরি খোয়ায়। হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করেন সুব্রত। অথচ পুরুষ শাসিত সমাজে আরতি তার স্বামীর আর্থিক সংকটের কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। ছবিতে আরতির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়।
‘ঘরে বাইরে’ ছবির বিমলা রবীন্দ্র সৃষ্ট চরিত্র। ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই চরিত্রের জন্ম। বিমলার স্বামী নিখিল জমিদার। আর দশটা বিত্তশালী জমিদারের থেকে নিখিল একটু আলাদা। প্রগতিশীল নিখিল বিলেত ফেরত উচ্চ শিক্ষিত। নিখিল ‘মহানগরের’ সুব্রত নয়। নিখিল নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। নিখিল চায় তাঁর স্ত্রী অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক যুগের সঙ্গে পরিচিত হোক। অবশেষে প্রথা ভেঙে স্ত্রীকে অন্দরমহল থেকে বাইরে এনে এক বিপ্লব সৃষ্টি করে নিখিল। বিমলা তাঁর স্বামী ছাড়া জীবনে যে পুরুষটির কাছে প্রথম এসেছিল তিনি স্বদেশি বিপ্লবী নিখিলের সহপাঠী, সন্দীপ। সন্দীপের বাচন শৈলী বিমলাকে আকৃষ্ট করে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজেকে সামলাতে পারেনি বিমলা। গড়ে উঠে এক ত্রিকোণ প্রেমের উপাখ্যান। ক্রমশ আত্মসংযম হারায় বিমলা। ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে বিমলার চরিত্রে অভিনয় করেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।
নারী সর্বদাই রহস্যময়ী, আর যদি সে হয় উচ্চাভিলাষী তা হলে তো কথাই নেই। প্রমীলা এমনি এক রহস্যময়ী নারী। নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো রহস্য? পর্দায় হিরোইন হওয়াই কি তার জীবনের একমাত্র বাসনা? তবে কেন স্বপ্নের নায়কের সঙ্গে দেখা করতে রাতের অন্ধকারকেই বেছে নেয় সে? মাত্র একটি দৃশ্যে প্রমীলাকে পর্দায় এনেছেন সত্যজিৎ। আলো আঁধারি দৃশ্যে রহস্যমাখা কথোপকথন। উচ্ছ্বসিত যৌবনা প্রমীলা কি তার স্বপ্নের নায়ককে প্রলুব্ধ করতে চায়? প্রমীলা কি বিবাহিতা? অরিন্দম উত্তর পায় না। সে কিন্তু সংযত, সতর্ক। গোটা ছবিতে আমরা দেখতে পাই অরিন্দমের মনের কোঠায় এমনকি স্বপ্নেও প্রমীলার উপস্থিতি বার বার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রমীলাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না অরিন্দম। …“নায়ক” ছবিতে প্রমীলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুমিতা সান্যাল।
মিসেস জয়া ত্রিপাঠি। একজন প্রাণবন্তু, প্রাণোচ্ছল নারী। কলকাতার এক আধুনিক শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারের ঘরনী, খুব অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। অত্যন্ত মিশুকে এই পরিবারটির সঙ্গে পালামৌয়ে ছুটি কাটাতে গিয়ে আলাপ হলো কলকাতার কয়েকজন শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত যুবকের। রক্ষণশীল বিত্তশালী পরিবারের বিধনা নারী আকৃষ্ট হন অত্যন্ত সংযক্ত, সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত, শিক্ষিত অথচ অনাড়ম্বর, সাম্যবাদী সঞ্জয়ের প্রতি। সেদিন এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মনের কথা গোপন রাখতে পারেননি মিসেস ত্রিপাঠি। ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ ছবিতে চরিত্রটি রূপায়ণ করেছেন কাবেরী বসু। 