ঢাকা ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের লাভ-ক্ষতি

মাধবী চৌধুরী, :: জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে প্রধান নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপি। শুধু তাই নয়; দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র ২০ দলীয় জোটকে উপেক্ষা করে দলটি ঐক্যফ্রন্টকেই গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু শেষ বিচারে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেনি।

উপরন্তু ২০ দলীয় জোটের মধ্যেই ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির পাশাপাশি দলটির শুভান্যুধায়ীদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে, ফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি কতটা লাভবান হতে পেরেছে। অনেকে এমনও বলছেন যে, বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে কোনো শর্ত মানা ছাড়াই বিএনপিকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; আর এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ঐক্যফ্রন্ট। বিশেষ করে ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেনের ভূমিকার দিকে কেউ কেউ সন্দেহের আঙ্গুল তুলছেন। আবার কারও কারও মতে, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ তিনিও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দাবি আদায়ের মতো পরিস্থিতি বা কৌশল সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ায় সরকার বৈধতা পেয়েছে।

জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অবশ্য বলছেন, দাবি আদায় করা যায়নি সরকারের একগুয়েমির কারণে। তিনি দাবি করেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে সরকার সংলাপেই রাজি হয়নি।

তাছাড়া ফ্রন্ট গঠনের পরই বিএনপি কিছুটা স্পেস পেয়েছে এমন দাবি করে তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো না। কিছু অর্জন করা যায়নি এর কারণ হলো; এ ধরনের সরকার সব সময় দুর্বল এবং ভয়ে থাকে বলেই কিছু মানতে চায় না।

শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ অবশ্য মনে করেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপির তেমন লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে। তার মতে, ওই ফ্রন্ট গঠনের ফলে ২০ দলীয় জোটে ভাঙ্গন হয়েছে। কারণ জোটের দলগুলোর প্রতি উদাসিনতা দেখানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সুধী সমাজের এই প্রতিনিধি বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা কিছু নেতাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; যাদের আন্দোলনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। নির্বাচনের কৌশলও জানা নেই। ফলে শেষ বিচারে আন্দোলনও হয়নি, নির্বাচনে ফলও পাওয়া যায়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এ বিষয়ে কিছু বলতে অস্বিকৃতি জানিয়ে বলেন, যাই বলবো তাতেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। ঐক্যফ্রন্ট তাদের মতো চলুক। তবে আমরা আর কখনোই ফ্রন্টের বৈঠকে যাবো না।

বাংলাদেশে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে এক বৈঠকে ড. কামাল কামাল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়ার পরও তিনি নির্বাচন করতে রাজি হননি। বিএনপির পক্ষে যে দুই শীর্ষ নেতা ওই প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানা যায় তাদের একজন হলেন স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং অন্যজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তারা দু’জনেই এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে এ নিয়ে মুখ খোলেননি।

তবে তাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো সাউথ এশিয়া মনিটরকে জানিয়েছে, ওইদিনের বৈঠকে বাক-বিতণ্ডার পর থেকেই বিএনপির সিনিয়র ওই দুই নেতা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ওই ঘটনার সূত্র ধরে নির্বাচনের পরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও সংকট তৈরী হয়; যে কারণে কয়েকটি বৈঠকে অংশ নেননি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে সর্বশেষ গত ১০ জুনের বৈঠকে আবার তিনি যোগ দিলেও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়েছে। কারণ ড. কামাল হোসেন ওই বৈঠকে যাননি। তার এই না যাওয়ার ঘটনা নিয়েও ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর মধ্যে নানা গুঞ্জন চলছে।

তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, স্বাস্থ্যগত কারণেই তিনি বৈঠকে অংশ নেননি। এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, ফ্রন্ট গঠনের পরে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে সারা পড়ে গিয়েছিলো। মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুতও ছিলো। কিন্তু সরকার এটি বুঝতে পেরেই রাতের অন্ধকারের পথ বেছে নিয়ে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ফলে এখানে ফ্রন্টের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর মতে, বিভক্ত রাজনীতিকে একত্রিত করার জন্য বিএনপির সঙ্গে উদারপন্থী দলগুলো মিলে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে। কিন্তু সরকারের কূটকৌশল ও অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে গেছে। ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনাকে বড় করে দেখা ঠিক হবে না। কারণ আশির অধিক বয়সে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে তার আর বেশি কিছু করা সম্ভব ছিলো না।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার মতে, সময়ের প্রয়োজনের ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু ওই অর্থে ইতিবাচক কিছু অর্জিত হয়েছে একথা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে ফ্রন্ট গঠনের কারণে কয়েক নেতার গুরুত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাড়লেও বিএনপি কিছু পেয়েছে একথা বলা যাবে না। অবশ্য ঐক্যফ্রন্ট থেকে কিছু অর্জন করতে গেলে আগে বিএনপিকে গুছিয়ে মাঠে নামতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

গত বছরের ১৩ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যাত্রা শুরু করে। বিএনপিসহ ফ্রন্টভুক্ত অন্য দলগুলো হলো আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য।

যদিও ওই একই দিনে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দো চৌধুরীর পূর্বনির্ধারিত একটি বৈঠক না হওয়ায় বিকল্প ধারা ফ্রন্ট থেকে ছিটকে পড়ে এবং পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। এর আগে জোট গঠনের উদ্দেশ্যে প্রায় দু’বছর ধারাবাহিকভাবে বৈঠকে অংশ নেয় বিকল্প ধারা। ৩০ ডিসেম্বরের আগে অবশ্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করে। তবে বি. চৌধুরী বিএনপির সঙ্গে না যাওয়ায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট কিছুটা দুর্বল হয়ে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

গত নির্বাচনে ওই তিনটি দলকে বিএনপি মোট ১৯টি আসন ছেড়ে দেয়। আর ২০ দলীয় জোট শরিকদের ছেড়ে দেওয়া হয় ৪১টি আসন। এর মধ্যে জামায়াত ছাড় পায় ২২টি আসনে। তবে প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে ২০ দলীয় জোট শরিকদের আসন ছাড়া হয় তা নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় শরিক দলগুলোর মধ্যে। কারণ জোট নেতাদের সঙ্গে তেমন কোনো বৈঠকই করেনি বিএনপি। তাদের আসনগুলোতে ছাড় দেওয়া হয়েছে শেষ মুহূর্তে। অন্যদিকে আসন ভাগাভাগি নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। নির্বাচনের আগে গত বছর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপেও ২০ দলকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোকে নিয়ে যায় বিএনপি। সব মিলিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকে গত ৬ মে ২০ দলীয় জোট ছেড়ে চলে যায় আন্দালিভ রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বিজেপি।

অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ ঐক্য ফ্রন্ট্রের ভূমিকার ব্যাপারে সম্প্রতি মুখ খুলেছেন। গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিএনপি কী কারণে হঠাৎ করে ঐক্যফ্রন্টের প্রেমে পড়ে গেলো এ বিষয়টি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, ড. কামাল সাহেব প্রত্যেকটি বৈঠক শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে এবং বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ বলে বৈঠক শেষ করেছেন। তিনি কোনোদিন বেগম খালেদা জিয়ার নাম নেননি।

জানতে চাইলে অলি আহমেদ বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে কী লাভ হয়েছে তা বিএনপি ভালো বলতে পারবে। তবে ২০ জোটের মধ্যে যে এ কারণে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, এখনো দেখি তারা ঐক্যফ্রন্ট নিয়েই বেশি ব্যস্ত। দেখা যাক তারা আরও কী পান!

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের লাভ-ক্ষতি

আপডেট টাইম ০২:০১:০৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জুন ২০১৯

মাধবী চৌধুরী, :: জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে প্রধান নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপি। শুধু তাই নয়; দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র ২০ দলীয় জোটকে উপেক্ষা করে দলটি ঐক্যফ্রন্টকেই গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু শেষ বিচারে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেনি।

উপরন্তু ২০ দলীয় জোটের মধ্যেই ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির পাশাপাশি দলটির শুভান্যুধায়ীদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে, ফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি কতটা লাভবান হতে পেরেছে। অনেকে এমনও বলছেন যে, বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে কোনো শর্ত মানা ছাড়াই বিএনপিকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; আর এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ঐক্যফ্রন্ট। বিশেষ করে ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেনের ভূমিকার দিকে কেউ কেউ সন্দেহের আঙ্গুল তুলছেন। আবার কারও কারও মতে, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ তিনিও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দাবি আদায়ের মতো পরিস্থিতি বা কৌশল সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ায় সরকার বৈধতা পেয়েছে।

জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অবশ্য বলছেন, দাবি আদায় করা যায়নি সরকারের একগুয়েমির কারণে। তিনি দাবি করেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে সরকার সংলাপেই রাজি হয়নি।

তাছাড়া ফ্রন্ট গঠনের পরই বিএনপি কিছুটা স্পেস পেয়েছে এমন দাবি করে তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো না। কিছু অর্জন করা যায়নি এর কারণ হলো; এ ধরনের সরকার সব সময় দুর্বল এবং ভয়ে থাকে বলেই কিছু মানতে চায় না।

শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ অবশ্য মনে করেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপির তেমন লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে। তার মতে, ওই ফ্রন্ট গঠনের ফলে ২০ দলীয় জোটে ভাঙ্গন হয়েছে। কারণ জোটের দলগুলোর প্রতি উদাসিনতা দেখানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সুধী সমাজের এই প্রতিনিধি বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা কিছু নেতাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; যাদের আন্দোলনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। নির্বাচনের কৌশলও জানা নেই। ফলে শেষ বিচারে আন্দোলনও হয়নি, নির্বাচনে ফলও পাওয়া যায়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এ বিষয়ে কিছু বলতে অস্বিকৃতি জানিয়ে বলেন, যাই বলবো তাতেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। ঐক্যফ্রন্ট তাদের মতো চলুক। তবে আমরা আর কখনোই ফ্রন্টের বৈঠকে যাবো না।

বাংলাদেশে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে এক বৈঠকে ড. কামাল কামাল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়ার পরও তিনি নির্বাচন করতে রাজি হননি। বিএনপির পক্ষে যে দুই শীর্ষ নেতা ওই প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানা যায় তাদের একজন হলেন স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং অন্যজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তারা দু’জনেই এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে এ নিয়ে মুখ খোলেননি।

তবে তাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো সাউথ এশিয়া মনিটরকে জানিয়েছে, ওইদিনের বৈঠকে বাক-বিতণ্ডার পর থেকেই বিএনপির সিনিয়র ওই দুই নেতা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ওই ঘটনার সূত্র ধরে নির্বাচনের পরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও সংকট তৈরী হয়; যে কারণে কয়েকটি বৈঠকে অংশ নেননি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে সর্বশেষ গত ১০ জুনের বৈঠকে আবার তিনি যোগ দিলেও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়েছে। কারণ ড. কামাল হোসেন ওই বৈঠকে যাননি। তার এই না যাওয়ার ঘটনা নিয়েও ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর মধ্যে নানা গুঞ্জন চলছে।

তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, স্বাস্থ্যগত কারণেই তিনি বৈঠকে অংশ নেননি। এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, ফ্রন্ট গঠনের পরে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে সারা পড়ে গিয়েছিলো। মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুতও ছিলো। কিন্তু সরকার এটি বুঝতে পেরেই রাতের অন্ধকারের পথ বেছে নিয়ে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ফলে এখানে ফ্রন্টের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর মতে, বিভক্ত রাজনীতিকে একত্রিত করার জন্য বিএনপির সঙ্গে উদারপন্থী দলগুলো মিলে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে। কিন্তু সরকারের কূটকৌশল ও অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে গেছে। ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনাকে বড় করে দেখা ঠিক হবে না। কারণ আশির অধিক বয়সে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে তার আর বেশি কিছু করা সম্ভব ছিলো না।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার মতে, সময়ের প্রয়োজনের ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু ওই অর্থে ইতিবাচক কিছু অর্জিত হয়েছে একথা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে ফ্রন্ট গঠনের কারণে কয়েক নেতার গুরুত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাড়লেও বিএনপি কিছু পেয়েছে একথা বলা যাবে না। অবশ্য ঐক্যফ্রন্ট থেকে কিছু অর্জন করতে গেলে আগে বিএনপিকে গুছিয়ে মাঠে নামতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

গত বছরের ১৩ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যাত্রা শুরু করে। বিএনপিসহ ফ্রন্টভুক্ত অন্য দলগুলো হলো আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য।

যদিও ওই একই দিনে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দো চৌধুরীর পূর্বনির্ধারিত একটি বৈঠক না হওয়ায় বিকল্প ধারা ফ্রন্ট থেকে ছিটকে পড়ে এবং পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। এর আগে জোট গঠনের উদ্দেশ্যে প্রায় দু’বছর ধারাবাহিকভাবে বৈঠকে অংশ নেয় বিকল্প ধারা। ৩০ ডিসেম্বরের আগে অবশ্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করে। তবে বি. চৌধুরী বিএনপির সঙ্গে না যাওয়ায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট কিছুটা দুর্বল হয়ে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

গত নির্বাচনে ওই তিনটি দলকে বিএনপি মোট ১৯টি আসন ছেড়ে দেয়। আর ২০ দলীয় জোট শরিকদের ছেড়ে দেওয়া হয় ৪১টি আসন। এর মধ্যে জামায়াত ছাড় পায় ২২টি আসনে। তবে প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে ২০ দলীয় জোট শরিকদের আসন ছাড়া হয় তা নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় শরিক দলগুলোর মধ্যে। কারণ জোট নেতাদের সঙ্গে তেমন কোনো বৈঠকই করেনি বিএনপি। তাদের আসনগুলোতে ছাড় দেওয়া হয়েছে শেষ মুহূর্তে। অন্যদিকে আসন ভাগাভাগি নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। নির্বাচনের আগে গত বছর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপেও ২০ দলকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোকে নিয়ে যায় বিএনপি। সব মিলিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকে গত ৬ মে ২০ দলীয় জোট ছেড়ে চলে যায় আন্দালিভ রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বিজেপি।

অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ ঐক্য ফ্রন্ট্রের ভূমিকার ব্যাপারে সম্প্রতি মুখ খুলেছেন। গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিএনপি কী কারণে হঠাৎ করে ঐক্যফ্রন্টের প্রেমে পড়ে গেলো এ বিষয়টি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, ড. কামাল সাহেব প্রত্যেকটি বৈঠক শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে এবং বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ বলে বৈঠক শেষ করেছেন। তিনি কোনোদিন বেগম খালেদা জিয়ার নাম নেননি।

জানতে চাইলে অলি আহমেদ বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে কী লাভ হয়েছে তা বিএনপি ভালো বলতে পারবে। তবে ২০ জোটের মধ্যে যে এ কারণে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, এখনো দেখি তারা ঐক্যফ্রন্ট নিয়েই বেশি ব্যস্ত। দেখা যাক তারা আরও কী পান!