ঢাকা ১১:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাদ্রাসা বোর্ড যেন ‘দালালের আখড়া’

মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। প্রতিদিন নানান প্রয়োজনে মানুষের আসতে হয় রাজধানীর এই বোর্ড। কিন্তু তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে দালালদের দ্বারা। অভিযোগ রয়েছে এই প্রতারণার সাথে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা। যারা বিভিন্নভাবে দালালদের সাথে মিলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতারিত করছে।

রোববার ও সোমবার সরেজমিনে ঘুরে প্রতারণার এমনই চিত্র দেখা যায়। অভিযোগ রয়েছে টাকা দিলে দ্রুত কাজ হয়। আবার অনেক সময় কেউ কেউ কাজ দ্রুত করিয়ে দেবেন বলে টাকা নিয়ে ভোগান্তিতে ফেলেন শিক্ষার্থীসহ অভিভাবককে। কিন্তু একাধিক ভুক্তোভোগী অভিযোগ করেছেন তারা টাকা দিলেও এক-দুইবছরেও কাজ হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে দালালদের কেউ কেউ বোর্ডে লোক আছে, কেউ চেয়ারম্যানের সাথে ভালো সম্পর্ক কেউ বা অন্য পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করছেন। এদের কেউ কেউ আবার নিজেকে সাংবাদিকও দাবি করেন।

ভুক্তোভোগীদের অভিযোগ

সরেজমিনে ঘুরে প্রতিবেদকের কথা হয় একাধিক ভুক্তোভোগীর সাথে। তারা জানান তাদের বাজে অভিজ্ঞতার কথা। জানান, দালালদের টাকা দিলেও বছরের পর বছর ঘুরে সমাধান মেলেনি।

রহিমা বেগমের মেয়ের নাম পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন ২০১৭ সাল থেকে। তিনবছর ধরে কয়েকদফায় চেষ্টা চালিয়ে তিনি তার কাজ করিয়েছেন গত পরশু। তিনি বলেন, আমার মেয়ের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেটে নাম ভুল আসছিলো। আমি ২০১৭ সালের দিকে নাম পরিবর্তনের আবেদন করি। তখন আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিই। এরপর এফিডেভিট করে ব্যাংকে টাকা জমা দিই। পরে আমাকে জানানো হয় আগামী ১-২ মাসে মধ্যে মিটিংয়ে আসবে আমার নাম। কিন্তু আজ প্রায় দুই-আড়াই বছর ধরে ঘুরছি। সবে গত পরশু আমার মেয়ের নাম পরিবর্তন হলো। আমি এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি।

অপর ভুক্তোভোগীর নাম মাসুদ। তার বাড়ি বরিশাল। তার নামে ভুল হয়েছিলো। তার সার্টিফিকেটে নাম মো. মাছুদ। ‘সু’ এর স্থানে এসেছে ‘ছু’। বাড়ি তার বরিশালে। দীর্ঘদিন এভাবেই চলছিলেন তিনি। তবে চাকরির জন্য এবার নাম ঠিক না করলেই নয়। মাসুদ ২০১৮ সালে নাম সংশোধনের আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বছরখানেক কয়েকবার এসেছেন বোর্ডে। শেষ পর্যন্ত ১৬ আগস্ট তার কাজটি হয় দালালের সহযোগিতায়।

মাসুদ বলেন, এই বছরে চারবার এসেছি। কোনো না কোনো কারণে কাজ হয় না। শেষ পর্যন্ত দালালকে ১ হাজার দিয়ে কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, কেন যে ভুলটা করলাম। আগেই যদি দালালকে টাকাটা দিতাম, তবে আমার এতোবার ঢাকায় আসা লাগতো না।

দিনাজপুরের কাহারোল থেকে নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য এসেছেন মিজানুর রহমান। তিনি তার মাদ্রাসা থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেবার সময়েই জানিয়ে দেয়া হয়, এক দালালের সহযোগিতা নেবার কথা। তিনি ঢাকায় আসার আগেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন ৫ শ টাকা। অপেক্ষা করছিলেন আরমান নামে সেই লোকের।

তিনি বলেন, যোগাযোগ করে জানাই ভাগিনার জেডিসি সার্টিফিকেটের বয়স সংশোধন করতে হবে।

তিনি জানান, বোর্ডের ভেতরেই দেখা হয় তার সাথে। কথা বলার জন্য নিয়ে যান একটু পাশে। আরমান দাবি করেন, ১৮ বছর ধরে এই বোর্ডের সকল কাজ করছেন তিনি। কোনো কাজই বিষয় না। বয়স পরিবর্তনের জন্য এফিডেফিট ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। এরপর এই কাগজ নিয়ে সোনালী ব্যাংকে জমা দিতে হবে ৫ শ টাকা। এসব কাজ করবার পর অপেক্ষা করতে হবে বোর্ড মিটিংয়ের জন্য। এই কাজের জন্য ৬ থেকে ১ বছর সময় লাগবে বলে জানান তিনি।

এফিডেভিড ৩ শ টাকা ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য তাকে দিতে হবে ১৫ শ টাকা। কোন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন জানতে চাইলে বলেন, যে পত্রিকা বোর্ড গ্রহণ করে। এর জন্য সোনালী বার্তা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। এই পত্রিকা ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকার বিজ্ঞাপন গ্রহণ করা হয় না। আর এই আরমান সোনালী বার্তা পত্রিকার একজন ‘সাংবাদিক’।

প্রতারকদের ফাঁদ

সরেজমিনে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন প্রতারকের সাথে যোগাযোগ করতে হয় প্রতিবেদককে। ভিন্ন পরিচয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা নানান প্রলোভন দেখিয়ে দ্রুত কাজ করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। তবে এর জন্য দাবি করেন মোটা অঙ্কের টাকা।

তিনজন দালালের ভিডিও প্রতিবেদন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছেন আবুল বাশার। তিনি কাজ করেন ‘দৈনিক সোনালী বার্তা’ নামের একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি হিসেবে। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, তিনি কাজ করে দেবেন। প্রথমে এফিডেভিট এবং পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। এরপর ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া লাগবে। দ্রুত কাজ করা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে স্যারদের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। হলে জানাবো, রাতে ফোন দিয়েন।

রাত ৮টার দিকে ফোন করা হলে বাশার জানান, তিনি কথা বলেছেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে একটু চাপ আছে। তাই তিনি একটু সময় চান। তবে, তিনি আশ্বাস দেন, অফিসারদের ২-৩ হাজার টাকার মধ্যে কাজ হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় দালাল, সামছুল হুদা (জসিম)। তিনি মাদ্রাসা বোর্ডের সামনে বিভিন্ন বই বিক্রি করেন। প্রথমেই নানান কথার ছলে তিনি বলেন, আগে বিজ্ঞাপন দিয়ে অন্যান্য কাজ করতে হবে। এরপর তিনি, এক লোকের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন, যিনি সার্বিক বিষয়ে সহোযোগিতা করবেন। তবে, তিনি মোটোমুটি ৫ হাজার টাকার মধ্যে মিটিংয়ে তুলে দিতে পারবেন। বয়স পরিবর্তন, নাম পরিবর্তনসহ আরো বেশ কিছু কাজ করেন তিনি।

ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আর মাত্র কদিন পরেই একটা মিটিং আছে। তার সাথে দ্রুত টাকা নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে তুলে দিতে পারবেন। তবে, তিনি জানান, টাকা লাগবে ৫-৬ হাজার। যেহেতু দ্রুত কাজ করতে হবে তাই টাকার পরিমাণ একটু বেশিও লাগতে পারে। তিনি পরদিন প্রতিবেদকে মাদ্রাসা বোর্ডের সামনে দেখা করতে বলেন। এছাড়া জানান, তিনি থাকেন বোর্ডের পাশ্ববর্তী সরকারি কোয়াটারে।

জসিম, কর্থাবার্তার এক পর্যায়ে জানান, বোর্ডের এক নেতা এসব কাজ করেন। সেই নেতা নিয়মিত বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে বসে চা খান। এবং তার সাথে সেই নেতার খুব ভালো সম্পর্ক। এসব কাজ নেতা করলেও তিনি নেতাকে বেশি কিছু বলতে পারেন না। কারণ তিনি কিছু বললে ওই নেতা তাকে বোর্ডের সামনে দোকান বসাতে দেবেন না।

তৃতীয় প্রতারণ নিজেকে পরিচয় দেন, আয়মান নামে। স্থানীয়রা তাকে আরমান নামেও চেনে। তিনি জানান, সবচেয়ে কম রেটে কাজ করে দেন তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে মূল ফটকে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলেন প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, ‘তিনি বোর্ডেরই কর্মকর্তা।’ তিনি সর্বনিম্ম যে রেটে কাজ করতে পারবে তা চাইলেই অন্য কেউ করতে পারবে না। কারণ তিনি বোর্ডে কাজ করেন।

চেয়ারম্যানের বক্তব্য

কেন এতো দালালদের আনাগোনা, বোর্ডের ভেতরে কীভাবে প্রতারক চক্র ঘুরে বেড়ায়- এমন প্রশ্নের জবাবে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কায়সার আহমেদ বলেন, আমার বোর্ড দালালমুক্ত এটা আমি বলবো না। আমি এখানে যোগ হবার পর নানা উদ্যোগ নেবার চেষ্টা করেছি। আমারা বোর্ডের যাবতীয় কাজ অনলাইনে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি। আমরা অনেকদিন ধরেই এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সব কার্যক্রম অনলাইনে চলে আসছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কিছু কাজের জন্য স্বশরীরে উপস্থিত হতে হয়। এসব কাজকেই দালালরা টার্গেট করেন। অবস্থা এমন যে, কোনো ব্যক্তি আমাদের কাছে আসার আগেই হয়তো তার দালালদের সাথে চুক্তি হয়ে যায়। কিন্তু তারা আমাদের কাছে আসলে সহজেই কাজ করতে পারতেন। আমাদের অফিসাররা সর্বদা যতোটা সম্ভব এসব দালালদের প্রভাব রুখতে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তারপরেও কিছু সময়ে কিছু জিনিস ঘটে যায়।

অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের নাম ব্যবহার করেও দালালি করা হচ্ছে, এই বিষয়ে জানতে চাইলে কায়সার আহমেদ বলেন- এই বিষয়টি আমি প্রথমবার শুনলাম। এখানো দালাল আছে; কিন্তু আমার নামে দালালি করছে এটা আমার জন্যেও বিপজ্জনক। আশা করি আমরা সার্বিক কার্যক্রম অনলাইনে আনতে পারলে আর এমন হবে না। আপাতত আমরা লিফলেট সাটানোসহ আরো বেশ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা ভাবছি।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

মাদ্রাসা বোর্ড যেন ‘দালালের আখড়া’

আপডেট টাইম ০১:২৫:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ অগাস্ট ২০২০

মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। প্রতিদিন নানান প্রয়োজনে মানুষের আসতে হয় রাজধানীর এই বোর্ড। কিন্তু তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে দালালদের দ্বারা। অভিযোগ রয়েছে এই প্রতারণার সাথে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা। যারা বিভিন্নভাবে দালালদের সাথে মিলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতারিত করছে।

রোববার ও সোমবার সরেজমিনে ঘুরে প্রতারণার এমনই চিত্র দেখা যায়। অভিযোগ রয়েছে টাকা দিলে দ্রুত কাজ হয়। আবার অনেক সময় কেউ কেউ কাজ দ্রুত করিয়ে দেবেন বলে টাকা নিয়ে ভোগান্তিতে ফেলেন শিক্ষার্থীসহ অভিভাবককে। কিন্তু একাধিক ভুক্তোভোগী অভিযোগ করেছেন তারা টাকা দিলেও এক-দুইবছরেও কাজ হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে দালালদের কেউ কেউ বোর্ডে লোক আছে, কেউ চেয়ারম্যানের সাথে ভালো সম্পর্ক কেউ বা অন্য পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করছেন। এদের কেউ কেউ আবার নিজেকে সাংবাদিকও দাবি করেন।

ভুক্তোভোগীদের অভিযোগ

সরেজমিনে ঘুরে প্রতিবেদকের কথা হয় একাধিক ভুক্তোভোগীর সাথে। তারা জানান তাদের বাজে অভিজ্ঞতার কথা। জানান, দালালদের টাকা দিলেও বছরের পর বছর ঘুরে সমাধান মেলেনি।

রহিমা বেগমের মেয়ের নাম পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন ২০১৭ সাল থেকে। তিনবছর ধরে কয়েকদফায় চেষ্টা চালিয়ে তিনি তার কাজ করিয়েছেন গত পরশু। তিনি বলেন, আমার মেয়ের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেটে নাম ভুল আসছিলো। আমি ২০১৭ সালের দিকে নাম পরিবর্তনের আবেদন করি। তখন আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিই। এরপর এফিডেভিট করে ব্যাংকে টাকা জমা দিই। পরে আমাকে জানানো হয় আগামী ১-২ মাসে মধ্যে মিটিংয়ে আসবে আমার নাম। কিন্তু আজ প্রায় দুই-আড়াই বছর ধরে ঘুরছি। সবে গত পরশু আমার মেয়ের নাম পরিবর্তন হলো। আমি এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি।

অপর ভুক্তোভোগীর নাম মাসুদ। তার বাড়ি বরিশাল। তার নামে ভুল হয়েছিলো। তার সার্টিফিকেটে নাম মো. মাছুদ। ‘সু’ এর স্থানে এসেছে ‘ছু’। বাড়ি তার বরিশালে। দীর্ঘদিন এভাবেই চলছিলেন তিনি। তবে চাকরির জন্য এবার নাম ঠিক না করলেই নয়। মাসুদ ২০১৮ সালে নাম সংশোধনের আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বছরখানেক কয়েকবার এসেছেন বোর্ডে। শেষ পর্যন্ত ১৬ আগস্ট তার কাজটি হয় দালালের সহযোগিতায়।

মাসুদ বলেন, এই বছরে চারবার এসেছি। কোনো না কোনো কারণে কাজ হয় না। শেষ পর্যন্ত দালালকে ১ হাজার দিয়ে কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, কেন যে ভুলটা করলাম। আগেই যদি দালালকে টাকাটা দিতাম, তবে আমার এতোবার ঢাকায় আসা লাগতো না।

দিনাজপুরের কাহারোল থেকে নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য এসেছেন মিজানুর রহমান। তিনি তার মাদ্রাসা থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেবার সময়েই জানিয়ে দেয়া হয়, এক দালালের সহযোগিতা নেবার কথা। তিনি ঢাকায় আসার আগেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন ৫ শ টাকা। অপেক্ষা করছিলেন আরমান নামে সেই লোকের।

তিনি বলেন, যোগাযোগ করে জানাই ভাগিনার জেডিসি সার্টিফিকেটের বয়স সংশোধন করতে হবে।

তিনি জানান, বোর্ডের ভেতরেই দেখা হয় তার সাথে। কথা বলার জন্য নিয়ে যান একটু পাশে। আরমান দাবি করেন, ১৮ বছর ধরে এই বোর্ডের সকল কাজ করছেন তিনি। কোনো কাজই বিষয় না। বয়স পরিবর্তনের জন্য এফিডেফিট ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। এরপর এই কাগজ নিয়ে সোনালী ব্যাংকে জমা দিতে হবে ৫ শ টাকা। এসব কাজ করবার পর অপেক্ষা করতে হবে বোর্ড মিটিংয়ের জন্য। এই কাজের জন্য ৬ থেকে ১ বছর সময় লাগবে বলে জানান তিনি।

এফিডেভিড ৩ শ টাকা ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য তাকে দিতে হবে ১৫ শ টাকা। কোন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন জানতে চাইলে বলেন, যে পত্রিকা বোর্ড গ্রহণ করে। এর জন্য সোনালী বার্তা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। এই পত্রিকা ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকার বিজ্ঞাপন গ্রহণ করা হয় না। আর এই আরমান সোনালী বার্তা পত্রিকার একজন ‘সাংবাদিক’।

প্রতারকদের ফাঁদ

সরেজমিনে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন প্রতারকের সাথে যোগাযোগ করতে হয় প্রতিবেদককে। ভিন্ন পরিচয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা নানান প্রলোভন দেখিয়ে দ্রুত কাজ করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। তবে এর জন্য দাবি করেন মোটা অঙ্কের টাকা।

তিনজন দালালের ভিডিও প্রতিবেদন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছেন আবুল বাশার। তিনি কাজ করেন ‘দৈনিক সোনালী বার্তা’ নামের একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি হিসেবে। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, তিনি কাজ করে দেবেন। প্রথমে এফিডেভিট এবং পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। এরপর ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া লাগবে। দ্রুত কাজ করা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে স্যারদের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। হলে জানাবো, রাতে ফোন দিয়েন।

রাত ৮টার দিকে ফোন করা হলে বাশার জানান, তিনি কথা বলেছেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে একটু চাপ আছে। তাই তিনি একটু সময় চান। তবে, তিনি আশ্বাস দেন, অফিসারদের ২-৩ হাজার টাকার মধ্যে কাজ হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় দালাল, সামছুল হুদা (জসিম)। তিনি মাদ্রাসা বোর্ডের সামনে বিভিন্ন বই বিক্রি করেন। প্রথমেই নানান কথার ছলে তিনি বলেন, আগে বিজ্ঞাপন দিয়ে অন্যান্য কাজ করতে হবে। এরপর তিনি, এক লোকের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন, যিনি সার্বিক বিষয়ে সহোযোগিতা করবেন। তবে, তিনি মোটোমুটি ৫ হাজার টাকার মধ্যে মিটিংয়ে তুলে দিতে পারবেন। বয়স পরিবর্তন, নাম পরিবর্তনসহ আরো বেশ কিছু কাজ করেন তিনি।

ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আর মাত্র কদিন পরেই একটা মিটিং আছে। তার সাথে দ্রুত টাকা নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে তুলে দিতে পারবেন। তবে, তিনি জানান, টাকা লাগবে ৫-৬ হাজার। যেহেতু দ্রুত কাজ করতে হবে তাই টাকার পরিমাণ একটু বেশিও লাগতে পারে। তিনি পরদিন প্রতিবেদকে মাদ্রাসা বোর্ডের সামনে দেখা করতে বলেন। এছাড়া জানান, তিনি থাকেন বোর্ডের পাশ্ববর্তী সরকারি কোয়াটারে।

জসিম, কর্থাবার্তার এক পর্যায়ে জানান, বোর্ডের এক নেতা এসব কাজ করেন। সেই নেতা নিয়মিত বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে বসে চা খান। এবং তার সাথে সেই নেতার খুব ভালো সম্পর্ক। এসব কাজ নেতা করলেও তিনি নেতাকে বেশি কিছু বলতে পারেন না। কারণ তিনি কিছু বললে ওই নেতা তাকে বোর্ডের সামনে দোকান বসাতে দেবেন না।

তৃতীয় প্রতারণ নিজেকে পরিচয় দেন, আয়মান নামে। স্থানীয়রা তাকে আরমান নামেও চেনে। তিনি জানান, সবচেয়ে কম রেটে কাজ করে দেন তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে মূল ফটকে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলেন প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, ‘তিনি বোর্ডেরই কর্মকর্তা।’ তিনি সর্বনিম্ম যে রেটে কাজ করতে পারবে তা চাইলেই অন্য কেউ করতে পারবে না। কারণ তিনি বোর্ডে কাজ করেন।

চেয়ারম্যানের বক্তব্য

কেন এতো দালালদের আনাগোনা, বোর্ডের ভেতরে কীভাবে প্রতারক চক্র ঘুরে বেড়ায়- এমন প্রশ্নের জবাবে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কায়সার আহমেদ বলেন, আমার বোর্ড দালালমুক্ত এটা আমি বলবো না। আমি এখানে যোগ হবার পর নানা উদ্যোগ নেবার চেষ্টা করেছি। আমারা বোর্ডের যাবতীয় কাজ অনলাইনে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি। আমরা অনেকদিন ধরেই এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সব কার্যক্রম অনলাইনে চলে আসছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কিছু কাজের জন্য স্বশরীরে উপস্থিত হতে হয়। এসব কাজকেই দালালরা টার্গেট করেন। অবস্থা এমন যে, কোনো ব্যক্তি আমাদের কাছে আসার আগেই হয়তো তার দালালদের সাথে চুক্তি হয়ে যায়। কিন্তু তারা আমাদের কাছে আসলে সহজেই কাজ করতে পারতেন। আমাদের অফিসাররা সর্বদা যতোটা সম্ভব এসব দালালদের প্রভাব রুখতে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তারপরেও কিছু সময়ে কিছু জিনিস ঘটে যায়।

অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের নাম ব্যবহার করেও দালালি করা হচ্ছে, এই বিষয়ে জানতে চাইলে কায়সার আহমেদ বলেন- এই বিষয়টি আমি প্রথমবার শুনলাম। এখানো দালাল আছে; কিন্তু আমার নামে দালালি করছে এটা আমার জন্যেও বিপজ্জনক। আশা করি আমরা সার্বিক কার্যক্রম অনলাইনে আনতে পারলে আর এমন হবে না। আপাতত আমরা লিফলেট সাটানোসহ আরো বেশ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা ভাবছি।