ঢাকা ০৫:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিচারপতির বিবেচনাবোধ ও রাষ্ট্রের করণীয়

শহিদুল্লাহ ফরাজি::”চাপের মুখে মাথা নত না করে, সমস্ত বাধা বিপত্তিকে প্রতিহত করাই একজন বিচারপতির কর্তব্য। নৈতিকতা বিসর্জন না দিয়ে নির্ভীক চিত্তে সিদ্ধান্ত নেওয়াই বিচারপতির কর্তব্য। সব ধরনের চাপ ও বাধা বিপত্তির সামনে সাহসে ভর করে মাথা তুলে দাঁড়ানোই এক জন বিচারপতির ধর্ম। নৈতিকতাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, কোনও পরিস্থিতিতেই তা ভোলা উচিত নয়।’’
কথাগুলো বলেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম অভিজ্ঞ বিচারপতি এনভি রমন।
তাঁর মতে বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা হাতে ধরিয়ে দেয়ার বস্তু নয়, তা অর্জন করতে হয়।

বিচারপতি আরো বলেছেন কর্তব্য পালন করতে গেলে ক্ষমতাশালীদের কাছ থেকে চাপ আসবেই। কিন্তু সেই চাপের সামনে মাথা নোয়ানো চলবে না। বরং নৈতিকতায় অটল থাকতে হবে।
বিগত কয়েক বছরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের একের পর এক সিদ্ধান্তে দেশের বিচার ব্যবস্থা যখন প্রশ্নের মুখে, সেইসময় এমনই বার্তা দিলেন সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম অভিজ্ঞ বিচারপতি এনভি রমন।

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এ আর লক্ষণের শোকসভায় এমন মন্তব্য করেন বিচারপতি রমন যা আনন্দবাজারে প্রকাশিত  হয়েছে।

শোকসভায় তিনি বলেন, ‘‘মানুষের বিশ্বাসই বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শক্তি। বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস এবং গ্রহণযোগ্যতা হাতে ধরিয়ে দেয়ার বস্তু নয়। এগুলি অর্জন করতে হয়।

ভাল ভাবে জীবন কাটানোর জন্য বিনয়, ধৈর্য, করুণা, নৈতিকতা এবং কাজের প্রতি উৎসাহ প্রয়োজন। কাজ করতে করতেই এ সব শিখতে হয়। নিজেকে পাল্টাতে হয়।’’
আমাদের রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কর্তব্যবোধ, নৈতিক বাধ্যবাধকতার বাণী উচ্চারিত হতে শোনা যায় না।
বিচারপতির বিবেচনাবোধের একটি প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের এই আলোচনার অবতারণা। তা হচ্ছে বিচারপতি এনভি রমন বলেছেন ‘নৈতিকতাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কোন পরিস্থিতিতেই তা ভোলা উচিত নয়’।

আমাদের রাষ্ট্র থেকে আমরা নৈতিকতাকে উচ্ছেদ করে দিয়েছি, ভুলে গিয়েছি নৈতিকতা। ফলে অন্যায়কারীর অপব্যবহৃত ক্ষমতা দিনদিন বিস্তার লাভ করে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে। বড় অন্যায়কারীরা ছোট অন্যায়কারীদের আকর্ষণ করে বাংলাদেশকে দুষ্কর্মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। ধর্ষণ, হত্যা ও দুর্নীতি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

মেজর সিনহা এবং রায়হান হত্যার  মত অসংখ্য ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে, নিরাপরাধ মানুষকে অপরাধী বানানোর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিদিন খবর প্রকাশিত হচ্ছে । এরপরও রাষ্ট্র উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে আইন প্রয়োগের সাথে নৈতিকতার প্রশ্ন কত গুরুত্বপূর্ণ। যাদের অপরাধ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়ে কেবলমাত্র তাদেরকে গ্রেপ্তার বা বরখাস্ত করে সরকার তার লোক দেখানো কর্তব্য সম্পাদন করে। কিন্তু আরেকটা ঘটনা বা আরেকটা হত্যা প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়।
মেজর সিনহা থেকে রায়হান পর্যন্ত এই দুই হত্যাকাণ্ডের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কত শত নিষ্ঠুরতা নিভৃতে রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে তা দুর্ভাগ্য পীড়িত জাতির অগোচরে থেকে গেল।

ওসি প্রদীপের মত বা আকবরের মত ভয়ঙ্কর কতজন পুলিশ সারাদেশে কর্মরত আছে, কোন কোন থানায় টর্চার সেল সক্রিয় রয়েছে, কারা জনগণকে চরম হয়রানি করছে এসব বিষয়ে কোনো তদন্ত বা নজরদারি পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আছে কিনা জনগণের  তা জানা নেই।
অন্যদিকে দুর্নীতিতে জড়িত সাহেদ বা ফরিদপুরের রুবেলদের মত সম্পদের পাহাড় সৃষ্টিকারী অন্য কোন নেতা সরকারি দলে বা সহযোগী সংগঠনে আছে কি না তা নির্ণয়ের জন্য সরকারি দলের কোনো উদ্যোগ নেই।
ফলে আরো হত্যা, আরো দুর্নীতি, আরো ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি ভয়ঙ্কর অপরাধ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাহলেই মাত্র উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ উক্ত  পুলিশকে বরখাস্ত করবে আর সরকারি দলের অপরাধী হলে ‘দলের কেউ না’ বলে অস্বীকার করবে।

সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কী করে খুনের মত বর্বরোচিত অপরাধে জড়িত হতে পারে বা কি করে জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে তার মনস্তত্ত্ব কি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি?

ফরিদপুর জেলার শহর কমিটির সেক্রেটারি হয়ে যদি কেউ কয়েক বছরে আড়াই হাজার একর জমির মালিক হতে পারে তা হলে  জীবদ্দশায় সে না কত জমির মালিক হতে পারে!  ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হলে সারাদেশের জমি তাহলে কয়েকজনের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।

যারা রক্ষক তারাই যদি নির্মম ভক্ষক হয়, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় তাহলে মানুষের আশ্রয়লাভের জায়গা কোথায় হবে? অনিয়ম, অনৈতিকতা এবং হিংস্রতা রাষ্ট্র ও সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। জনগণের জীবন, জনগণের অধিকার ও জনগণের ইচ্ছা রাষ্ট্রীয় জগত থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে গৃহীত ও স্বীকৃত অধিকার সমূহের প্রতি রাষ্ট্র ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে না। এখন শিশুদেরকেও ধর্ষণ খুন ডাকাতির সময় উপস্থিতির অভিযোগ এনে সাক্ষী বা আসামি করা হচ্ছে। সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতনে সবকিছুই দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

আমরা যে ধ্বংসের আবর্তে পড়ে যাচ্ছি, সর্বগ্রাসী সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি তা সরকার এবং সরকারি দল উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া ছাড়া কোন পুলিশকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার সরকারি উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ে না। তেমনি দলের উদ্যোগে কোন অপরাধীকে চিহ্নিত করে দল থেকে বহিষ্কারের কোন উদ্যোগও আমাদের নজরে আসে না। ফলে রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে অনিয়মতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারকে যোগান দেয়া হচ্ছে। অশুভ শক্তির ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধে আমাদের কোন ব্যবস্থাপনা নেই। প্রতিদিন প্রচুর রক্ত ঝরছে, চারিদিকে নিদারুণ হাহাকার – এগুলো সরকারকে আহত করছে না। চূড়ান্তভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তবুও রাষ্ট্র লজ্জা পাচ্ছে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অজুহাতে ধ্বংসযজ্ঞ এবং দুর্বৃত্তসুলভ কর্মকাণ্ডকে আমাদের নিঃশব্দে মেনে নিতে হচ্ছে।

আমরা যে ক্রমাগত দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে ফেলছি তা আমাদের রাজনীতিবিদদের উপলব্ধিতে নেই। ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ আর ‘ব্যর্থরাষ্ট্র’ দুটোই যে ভয়ঙ্কর তা আমাদের বিবেচনায় নেই। ‘ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র’ থেকে ‘অনুগত রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়  এসব ইতিহাসও আমাদের জানা নেই।
কর্তব্যবোধ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ  করার  জন্য নৈতিক মানসিকতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে তাও রাষ্ট্র ভুলে গেছে।

আমাদের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় অপশাসনে এবং তোষামুদের সংস্কৃতি হতে ’নৈতিকতা’ নামক উচ্চতম স্তম্ভটি ধুলিস্যাৎ হয়ে পড়েছে। প্রজাতন্ত্রের নাগরিক এবং কর্মচারীগণকে নৈতিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় লালন করতে হয় তা আমাদের শাসকদের ধারণায় নেই। শাসকগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য সকল সময় নৈতিকতাকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে। বরং নৈতিকতার স্বকীয়তা ও ভিত্তিকে মিথ্যায় পর্যবসিত করতে বাধ্য করে। নৈতিক শিক্ষা থাকলেই যে পুলিশ এবং প্রশাসনের মাঝে সংহতি  বিদ্যমান থাকবে তাও সরকারের জানা নেই। কর্তব্যনীতি যে নৈতিকতার চূড়ান্ত নীতি তা  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত চর্চায় থাকতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে প্রজাতন্ত্রের মালিকানার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা কোনক্রমে গ্রহণীয় নয়। কর্তব্যবোধ এই ধরনের মানসিকতাকে নাকচ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাধীনতা – এটাই চরম নৈতিক আইন, এটা অর্জনের জন্যই রক্তের সাগরে স্বাধীনতার অর্ঘ্য দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে পর্যালোচনা রাষ্ট্রের কাছে সামান্য প্রয়োজনও পড়ছে না। আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে কিছু মানুষের অর্থ-সম্পদ ভোগ বিলাসের কাছে ছেড়ে দিতে পারি না। আমরা সংবিধানকে কেবলমাত্র সরকারের ক্ষমতায় থাকার শর্ত হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না। স্বাধীনতার দার্শনিক ভিত্তি ছাড়া একটি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারেনা। অন্যায় অন্যায্য নিষ্ঠুরতা কোন অজুহাতেই  গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
জনগণের সম্মতি, জনগণের সমর্থন ও জনগণের রায় ব্যতিরেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিকশিত হতে পারবেনা।

নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতাসহ অশুভ দিকটি প্রশমন করার উপায় খুঁজে বের করার  তাগিদ রাষ্ট্রের নেই। এভাবেই আমরা রাষ্ট্রের অধঃপতনের বীজ বপন করে যাচ্ছি।
প্রজাতন্ত্রে এখন নির্বাচনী ব্যবস্থা ‘চরম মাত্রার প্যারোডি’। জনগণের বিশ্বাস থেকে বহুদূর ’ভোটাধিকার’। ‘চুরি যাওয়া নির্বাচন ‘(stolen Election) ব্যবস্থায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার আর কোন সুযোগ নেই। জনগণের আস্থাহীনতা চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এই নৈতিক পরাজয়ের জন্য যারা দায়ী সেই ক্ষমতাবানদের ইতিহাসের দায় শোধ করতে হবে একদিন। জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা কোনদিন আত্মসাৎ করা যায় না। স্বাধীনতাকে বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাওয়া কোন আত্মতৃপ্তির বিষয় নয়।

সকল মানবাধিকারই সর্বজনীন, অবিভাজ্য, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত স্বাধীন এবং পারস্পরিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য। এ সকল বিষয়কে আমরা ক্ষমতার দম্ভে দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে ফেলেছি।

নৈতিকতা বড় সম্পদ অথচ নৈতিকতাকে উচ্ছেদ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যাচ্ছি  যা একেবারে অন্তঃসারশূন্য।

সমাজকে রূপান্তর বা নবচেতনার দ্বারা উদ্দীপ্ত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় মৌল কাঠামোর অর্থবহ পরিবর্তন আনতে হবে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার ছাড়া বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যায় না। শহীদের আত্মার সাথে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘনের অধিকার রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি।
লেখক: শহীদুল্লাহ ফরায়জী
গীতিকার

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

বিচারপতির বিবেচনাবোধ ও রাষ্ট্রের করণীয়

আপডেট টাইম ০৬:৫০:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর ২০২০

শহিদুল্লাহ ফরাজি::”চাপের মুখে মাথা নত না করে, সমস্ত বাধা বিপত্তিকে প্রতিহত করাই একজন বিচারপতির কর্তব্য। নৈতিকতা বিসর্জন না দিয়ে নির্ভীক চিত্তে সিদ্ধান্ত নেওয়াই বিচারপতির কর্তব্য। সব ধরনের চাপ ও বাধা বিপত্তির সামনে সাহসে ভর করে মাথা তুলে দাঁড়ানোই এক জন বিচারপতির ধর্ম। নৈতিকতাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, কোনও পরিস্থিতিতেই তা ভোলা উচিত নয়।’’
কথাগুলো বলেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম অভিজ্ঞ বিচারপতি এনভি রমন।
তাঁর মতে বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা হাতে ধরিয়ে দেয়ার বস্তু নয়, তা অর্জন করতে হয়।

বিচারপতি আরো বলেছেন কর্তব্য পালন করতে গেলে ক্ষমতাশালীদের কাছ থেকে চাপ আসবেই। কিন্তু সেই চাপের সামনে মাথা নোয়ানো চলবে না। বরং নৈতিকতায় অটল থাকতে হবে।
বিগত কয়েক বছরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের একের পর এক সিদ্ধান্তে দেশের বিচার ব্যবস্থা যখন প্রশ্নের মুখে, সেইসময় এমনই বার্তা দিলেন সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম অভিজ্ঞ বিচারপতি এনভি রমন।

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এ আর লক্ষণের শোকসভায় এমন মন্তব্য করেন বিচারপতি রমন যা আনন্দবাজারে প্রকাশিত  হয়েছে।

শোকসভায় তিনি বলেন, ‘‘মানুষের বিশ্বাসই বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শক্তি। বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস এবং গ্রহণযোগ্যতা হাতে ধরিয়ে দেয়ার বস্তু নয়। এগুলি অর্জন করতে হয়।

ভাল ভাবে জীবন কাটানোর জন্য বিনয়, ধৈর্য, করুণা, নৈতিকতা এবং কাজের প্রতি উৎসাহ প্রয়োজন। কাজ করতে করতেই এ সব শিখতে হয়। নিজেকে পাল্টাতে হয়।’’
আমাদের রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কর্তব্যবোধ, নৈতিক বাধ্যবাধকতার বাণী উচ্চারিত হতে শোনা যায় না।
বিচারপতির বিবেচনাবোধের একটি প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের এই আলোচনার অবতারণা। তা হচ্ছে বিচারপতি এনভি রমন বলেছেন ‘নৈতিকতাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কোন পরিস্থিতিতেই তা ভোলা উচিত নয়’।

আমাদের রাষ্ট্র থেকে আমরা নৈতিকতাকে উচ্ছেদ করে দিয়েছি, ভুলে গিয়েছি নৈতিকতা। ফলে অন্যায়কারীর অপব্যবহৃত ক্ষমতা দিনদিন বিস্তার লাভ করে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে। বড় অন্যায়কারীরা ছোট অন্যায়কারীদের আকর্ষণ করে বাংলাদেশকে দুষ্কর্মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। ধর্ষণ, হত্যা ও দুর্নীতি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

মেজর সিনহা এবং রায়হান হত্যার  মত অসংখ্য ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে, নিরাপরাধ মানুষকে অপরাধী বানানোর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিদিন খবর প্রকাশিত হচ্ছে । এরপরও রাষ্ট্র উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে আইন প্রয়োগের সাথে নৈতিকতার প্রশ্ন কত গুরুত্বপূর্ণ। যাদের অপরাধ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়ে কেবলমাত্র তাদেরকে গ্রেপ্তার বা বরখাস্ত করে সরকার তার লোক দেখানো কর্তব্য সম্পাদন করে। কিন্তু আরেকটা ঘটনা বা আরেকটা হত্যা প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়।
মেজর সিনহা থেকে রায়হান পর্যন্ত এই দুই হত্যাকাণ্ডের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কত শত নিষ্ঠুরতা নিভৃতে রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে তা দুর্ভাগ্য পীড়িত জাতির অগোচরে থেকে গেল।

ওসি প্রদীপের মত বা আকবরের মত ভয়ঙ্কর কতজন পুলিশ সারাদেশে কর্মরত আছে, কোন কোন থানায় টর্চার সেল সক্রিয় রয়েছে, কারা জনগণকে চরম হয়রানি করছে এসব বিষয়ে কোনো তদন্ত বা নজরদারি পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আছে কিনা জনগণের  তা জানা নেই।
অন্যদিকে দুর্নীতিতে জড়িত সাহেদ বা ফরিদপুরের রুবেলদের মত সম্পদের পাহাড় সৃষ্টিকারী অন্য কোন নেতা সরকারি দলে বা সহযোগী সংগঠনে আছে কি না তা নির্ণয়ের জন্য সরকারি দলের কোনো উদ্যোগ নেই।
ফলে আরো হত্যা, আরো দুর্নীতি, আরো ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি ভয়ঙ্কর অপরাধ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাহলেই মাত্র উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ উক্ত  পুলিশকে বরখাস্ত করবে আর সরকারি দলের অপরাধী হলে ‘দলের কেউ না’ বলে অস্বীকার করবে।

সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কী করে খুনের মত বর্বরোচিত অপরাধে জড়িত হতে পারে বা কি করে জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে তার মনস্তত্ত্ব কি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি?

ফরিদপুর জেলার শহর কমিটির সেক্রেটারি হয়ে যদি কেউ কয়েক বছরে আড়াই হাজার একর জমির মালিক হতে পারে তা হলে  জীবদ্দশায় সে না কত জমির মালিক হতে পারে!  ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হলে সারাদেশের জমি তাহলে কয়েকজনের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।

যারা রক্ষক তারাই যদি নির্মম ভক্ষক হয়, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় তাহলে মানুষের আশ্রয়লাভের জায়গা কোথায় হবে? অনিয়ম, অনৈতিকতা এবং হিংস্রতা রাষ্ট্র ও সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। জনগণের জীবন, জনগণের অধিকার ও জনগণের ইচ্ছা রাষ্ট্রীয় জগত থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে গৃহীত ও স্বীকৃত অধিকার সমূহের প্রতি রাষ্ট্র ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে না। এখন শিশুদেরকেও ধর্ষণ খুন ডাকাতির সময় উপস্থিতির অভিযোগ এনে সাক্ষী বা আসামি করা হচ্ছে। সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতনে সবকিছুই দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

আমরা যে ধ্বংসের আবর্তে পড়ে যাচ্ছি, সর্বগ্রাসী সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি তা সরকার এবং সরকারি দল উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া ছাড়া কোন পুলিশকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার সরকারি উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ে না। তেমনি দলের উদ্যোগে কোন অপরাধীকে চিহ্নিত করে দল থেকে বহিষ্কারের কোন উদ্যোগও আমাদের নজরে আসে না। ফলে রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে অনিয়মতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারকে যোগান দেয়া হচ্ছে। অশুভ শক্তির ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধে আমাদের কোন ব্যবস্থাপনা নেই। প্রতিদিন প্রচুর রক্ত ঝরছে, চারিদিকে নিদারুণ হাহাকার – এগুলো সরকারকে আহত করছে না। চূড়ান্তভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তবুও রাষ্ট্র লজ্জা পাচ্ছে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অজুহাতে ধ্বংসযজ্ঞ এবং দুর্বৃত্তসুলভ কর্মকাণ্ডকে আমাদের নিঃশব্দে মেনে নিতে হচ্ছে।

আমরা যে ক্রমাগত দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে ফেলছি তা আমাদের রাজনীতিবিদদের উপলব্ধিতে নেই। ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ আর ‘ব্যর্থরাষ্ট্র’ দুটোই যে ভয়ঙ্কর তা আমাদের বিবেচনায় নেই। ‘ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র’ থেকে ‘অনুগত রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়  এসব ইতিহাসও আমাদের জানা নেই।
কর্তব্যবোধ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ  করার  জন্য নৈতিক মানসিকতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে তাও রাষ্ট্র ভুলে গেছে।

আমাদের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় অপশাসনে এবং তোষামুদের সংস্কৃতি হতে ’নৈতিকতা’ নামক উচ্চতম স্তম্ভটি ধুলিস্যাৎ হয়ে পড়েছে। প্রজাতন্ত্রের নাগরিক এবং কর্মচারীগণকে নৈতিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় লালন করতে হয় তা আমাদের শাসকদের ধারণায় নেই। শাসকগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য সকল সময় নৈতিকতাকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে। বরং নৈতিকতার স্বকীয়তা ও ভিত্তিকে মিথ্যায় পর্যবসিত করতে বাধ্য করে। নৈতিক শিক্ষা থাকলেই যে পুলিশ এবং প্রশাসনের মাঝে সংহতি  বিদ্যমান থাকবে তাও সরকারের জানা নেই। কর্তব্যনীতি যে নৈতিকতার চূড়ান্ত নীতি তা  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত চর্চায় থাকতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে প্রজাতন্ত্রের মালিকানার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা কোনক্রমে গ্রহণীয় নয়। কর্তব্যবোধ এই ধরনের মানসিকতাকে নাকচ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাধীনতা – এটাই চরম নৈতিক আইন, এটা অর্জনের জন্যই রক্তের সাগরে স্বাধীনতার অর্ঘ্য দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে পর্যালোচনা রাষ্ট্রের কাছে সামান্য প্রয়োজনও পড়ছে না। আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে কিছু মানুষের অর্থ-সম্পদ ভোগ বিলাসের কাছে ছেড়ে দিতে পারি না। আমরা সংবিধানকে কেবলমাত্র সরকারের ক্ষমতায় থাকার শর্ত হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না। স্বাধীনতার দার্শনিক ভিত্তি ছাড়া একটি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারেনা। অন্যায় অন্যায্য নিষ্ঠুরতা কোন অজুহাতেই  গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
জনগণের সম্মতি, জনগণের সমর্থন ও জনগণের রায় ব্যতিরেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিকশিত হতে পারবেনা।

নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতাসহ অশুভ দিকটি প্রশমন করার উপায় খুঁজে বের করার  তাগিদ রাষ্ট্রের নেই। এভাবেই আমরা রাষ্ট্রের অধঃপতনের বীজ বপন করে যাচ্ছি।
প্রজাতন্ত্রে এখন নির্বাচনী ব্যবস্থা ‘চরম মাত্রার প্যারোডি’। জনগণের বিশ্বাস থেকে বহুদূর ’ভোটাধিকার’। ‘চুরি যাওয়া নির্বাচন ‘(stolen Election) ব্যবস্থায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার আর কোন সুযোগ নেই। জনগণের আস্থাহীনতা চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এই নৈতিক পরাজয়ের জন্য যারা দায়ী সেই ক্ষমতাবানদের ইতিহাসের দায় শোধ করতে হবে একদিন। জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা কোনদিন আত্মসাৎ করা যায় না। স্বাধীনতাকে বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাওয়া কোন আত্মতৃপ্তির বিষয় নয়।

সকল মানবাধিকারই সর্বজনীন, অবিভাজ্য, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত স্বাধীন এবং পারস্পরিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য। এ সকল বিষয়কে আমরা ক্ষমতার দম্ভে দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে ফেলেছি।

নৈতিকতা বড় সম্পদ অথচ নৈতিকতাকে উচ্ছেদ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যাচ্ছি  যা একেবারে অন্তঃসারশূন্য।

সমাজকে রূপান্তর বা নবচেতনার দ্বারা উদ্দীপ্ত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় মৌল কাঠামোর অর্থবহ পরিবর্তন আনতে হবে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার ছাড়া বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যায় না। শহীদের আত্মার সাথে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘনের অধিকার রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি।
লেখক: শহীদুল্লাহ ফরায়জী
গীতিকার