ঢাকা ০৪:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের বর্তমান সংকট যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর: আলী রীয়াজ

অতীতে বাংলাদেশ যত ধরনের রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করেছে, এখনকার সংকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং আরও গভীর।

শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গণবক্তৃতায় এ মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করে এই সংকটের জন্য ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা দোআঁশলা ব্যবস্থাকে দায়ী করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক গণবক্তৃতায় অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ কথাগুলো বলেন। রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ বক্তৃতার আয়োজন করে। সভাপতিত্ব করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলো প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভর করে। ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের একধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৩৭টি দেশের অবস্থা এ রকম।

দীর্ঘ বক্তৃতায় আলী রীয়াজ বলেন, ‘যেকোনো হাইব্রিড রেজিমকে টিকে থাকার জন্য নির্বাচন, নির্বাহী ও আইনসভা এবং বিচারব্যবস্থা—এই চারটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দরকার হয়। শেষ তিনটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র তৈরি হয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সেই নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হলো কি না, সেটা বিবেচ্য থাকে না। যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু আর সব ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা চূর্ণ করে ফেলাই হচ্ছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উপায়। বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, সহিংসতার ব্যাপক বিস্তারের যে সব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তি এখানেই।’

অধ্যাপক রীয়াজ বিরাজমান শাসনের ধরন নিরূপণের পাশাপাশি সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিক্রিয়া, ইসলামপন্থীদের প্রভাব এবং ভারতের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমাজে স্থানীয় ও সমন্বয়বাদী (সিনক্রেটিক) ইসলামের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতক্রমে একটি রক্ষণশীল আক্ষরিক (লিটারালিস্ট) ব্যাখ্যা এবং একই সঙ্গে একটি বৈশ্বিক ব্যাখ্যার ইসলামেরই প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে। ভবিষ্যতে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ক্ষেত্র যতই সীমিত হবে, এই শক্তির প্রভাব ও ক্ষমতা বাড়বে। সবার অংশগ্রহণমূলক অবাধ নির্বাচনের বিকল্প কিছু চেষ্টা করা হলে এই শক্তিই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।

আলী রীয়াজ বলেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত প্রায় নির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, যা কার্যত সব প্রধান দলই স্বীকার করে নিয়েছে; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বলে যে এতে করে দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের লাভবান না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

সভাপতির বক্তৃতায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো রওনক জাহান বলেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অভাব। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি এবং তা ব্যক্তিনির্ভর। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতা, অধিকারহীনতায় ভুগছে। এ সমস্যার প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান করা জরুরি এবং তা করতে হবে তরুণদেরই।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশের বর্তমান সংকট যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর: আলী রীয়াজ

আপডেট টাইম ১১:১৬:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জুলাই ২০১৮

অতীতে বাংলাদেশ যত ধরনের রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করেছে, এখনকার সংকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং আরও গভীর।

শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গণবক্তৃতায় এ মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করে এই সংকটের জন্য ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা দোআঁশলা ব্যবস্থাকে দায়ী করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক গণবক্তৃতায় অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ কথাগুলো বলেন। রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ বক্তৃতার আয়োজন করে। সভাপতিত্ব করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলো প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভর করে। ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের একধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৩৭টি দেশের অবস্থা এ রকম।

দীর্ঘ বক্তৃতায় আলী রীয়াজ বলেন, ‘যেকোনো হাইব্রিড রেজিমকে টিকে থাকার জন্য নির্বাচন, নির্বাহী ও আইনসভা এবং বিচারব্যবস্থা—এই চারটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দরকার হয়। শেষ তিনটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র তৈরি হয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সেই নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হলো কি না, সেটা বিবেচ্য থাকে না। যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু আর সব ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা চূর্ণ করে ফেলাই হচ্ছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উপায়। বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, সহিংসতার ব্যাপক বিস্তারের যে সব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তি এখানেই।’

অধ্যাপক রীয়াজ বিরাজমান শাসনের ধরন নিরূপণের পাশাপাশি সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিক্রিয়া, ইসলামপন্থীদের প্রভাব এবং ভারতের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমাজে স্থানীয় ও সমন্বয়বাদী (সিনক্রেটিক) ইসলামের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতক্রমে একটি রক্ষণশীল আক্ষরিক (লিটারালিস্ট) ব্যাখ্যা এবং একই সঙ্গে একটি বৈশ্বিক ব্যাখ্যার ইসলামেরই প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে। ভবিষ্যতে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ক্ষেত্র যতই সীমিত হবে, এই শক্তির প্রভাব ও ক্ষমতা বাড়বে। সবার অংশগ্রহণমূলক অবাধ নির্বাচনের বিকল্প কিছু চেষ্টা করা হলে এই শক্তিই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।

আলী রীয়াজ বলেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত প্রায় নির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, যা কার্যত সব প্রধান দলই স্বীকার করে নিয়েছে; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বলে যে এতে করে দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের লাভবান না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

সভাপতির বক্তৃতায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো রওনক জাহান বলেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অভাব। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি এবং তা ব্যক্তিনির্ভর। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতা, অধিকারহীনতায় ভুগছে। এ সমস্যার প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান করা জরুরি এবং তা করতে হবে তরুণদেরই।