বর্তমান সংবিধান বাতিল করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুসকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠন করে জুনের মধ্যে গণপরিষদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ।
শনিবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এক নাগরিক সমাবেশে সদ্যগঠিত দলটির রাজনৈতিক প্রধান মো. আনিছুর রহমান বিপ্লবের রূপরেখা শীর্ষক এক প্রস্তাবনায় এ দাবি জানান।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, নির্বাচিত গণপরিষদ ছয় মাসের মধ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে ও দুই দফা খসড়া প্রকাশের পর ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান চূড়ান্ত হবে। এর তিন মাসের মাথায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ বলছে ড. ইউনুসের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি শাসিত বিপ্লবী সরকার হবে চার বছর মেয়াদী। এর একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা থাকবে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে সামনে রেখে রাষ্ট্রপতির ফরমান বলে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।
এছাড়াও দলটি বিপ্লবী সরকারের সময়ে রাষ্ট্রপতিকে চেয়ারম্যান ও সেনা প্রধানকে ভাইস চেয়ারম্যান করে একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এবং অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে একটি জাতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কাউন্সিল গঠন করতে প্রস্তাব করেছে।
সমাবেশে আনিছুর রহমান বলেন, বিপ্লবী সরকারের সর্ব প্রথম কাজ হবে জুলাই গণহত্যা, পিলখানা ও শাপলা চত্বর ম্যাসাকার, গুম-খুনসহ মানবাধিকার হরণের সকল অপরাধে জড়িতদের সরকার ও দলগতভাবে সুপ্রিম কমান্ড রেস্পন্সিবিলিটিসহ বিচার করতে হবে।
ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ও নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবিতে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ আয়োজিত এই নাগরিক সমাবেশে জুলাই গণহত্যা, পিলখানা ও শাপলা চত্বর ম্যাসাকারের শহিদের পরিবারের সদস্য ও আহতরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশ উদ্বোধন করেন আশুলিয়ায় পুলিশ ভ্যানে পুরিয়ে ফেলা শহিদদের একজন শহিদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা আখতার। তিনি বলেন, অন্য শহিদের মায়েরা তাদের সন্তানের লাশ দেখতে পেলেও আমি আমার ছেলের লাশটিও দেখতে পারিনি। খুনি হাসিনা আমাদের সন্তানদেরকে কত কষ্ট দিয়ে মারলো, অথচ এখন পর্যন্ত তার কোনো বিচার হয়নি।
মুন্সিগঞ্জের শহিদ সজলের ভাই প্রশ্ন রাখেন, আওয়ামীলীগ ও তাদের দোসরদের এখনো কেন বিচারের আওতায় আনা হলো না?
শহিদ মোবারক হোসেনের পিতা মোহাম্মদ রমজান আলী হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে বলেন, ঘটনাস্থলে অনেকগুলো সিসি ক্যামেরা আছে, অনেক ফুটেজ আছে। সেসব দেখে অপরাধীদের সনাক্ত করা কঠিন কিছু না। আমরা শহিদদের বাবারা শান্তি পাচ্ছি না, কারন আমরা আমাদের সন্তানদের খুনের বিচার পাচ্ছি না।
শহিদ সায়েম হোসেনের মা শিউলি আক্তার বলেন আমার ছেলেকে যারা গুলি করে মেরেছে আমি তাদের বিচার চাই। এখনো বিচার হচ্ছে না কেন? সরকার কি করতেছে? এই বাংলাদেশের মাটিতে খুনি হাসিনার বিচার করতে হবে। আমি আমার ছেলেকে চিকিৎসা করাতে পারিনি, আমি ডাক্তারদের হাতে পায়ে ধরেছি আমার ছেলেটাকে একটু দেখেন, কিন্তু কোন ডাক্তার আমার ছেলেটাকে দেখেনি।
শহিদ সৈয়দ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের স্ত্রী দ্রুত বিচার দাবি করে বলেন, যারা এখন ক্ষমতায় আছেন তারা আমাদেরকে নিয়ে অবহেলা করলে চলবে না। তাদেরকে এটা মাথায় রাখতে হবে যে তারা কাদের বিনিময়ে ক্ষমতায় আছেন। তিনি শহিদ পরিবারের সকলকে বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
শহিদ ইমনের মা বলেন, যে র্যাব সদস্যের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে সে কিভাবে ভালো পদে চাকরী করে এখনো? এদের নির্দেশ দাতা ডিবি হারুন, আয়নাঘরের হারুন কিভাবে পালিয়ে গেলো। একশবার না পাঁচ লক্ষ কোটি বার বিচার হওয়া চাই শেখ হাসিনার। এবং ওকে যেন শহিদ মিনারে এই আসমানের নিচে ফাঁসি দেওয়া হয়।
পায়ে গুলিবিদ্ধ ও শরীরে অসংখ্য স্প্রিন্ট এর আঘাতপ্রাপ্ত আমিরুল ইসলাম ইমন বলেন, পাঁচ মাস হয়ে গেছে আমাদের এখনো পুনর্বাসনের জন্য রাস্তায় নামতে হয়। আমাদেরকে দাবিয়ে রাখার জন্য একটা গ্রুপ এখনো বিভিন্ন জায়গায় সচেষ্ট রয়েছে। আমাদের নামে বরাদ্দ টাকাগুলো ব্যাংকে পরে রয়েছে কিন্তু আমার আহত ভাইয়েরা চিকিৎসা পায় না, ঠিকমতো খাবার পায় না, বিভিন্ন মেডিকেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বিশ হাজার, বাইশ হাজার আহত, সেখানে এখনো পর্যন্ত ষোলশত মানুষ চিকিৎসার টাকা পেয়েছে। এখনো অনেকে এক লাখ টাকাও পায়নি। তিনি আরো বলেন, আমরা যাদের কাছে বিচারের জন্য যাবো তাদের আশেপাশে আওয়ামী লীগ ঘুরঘুর করছে।
শহিদ বিলালের বাবা বলেন, ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এই স্বাধীন বাংলাদেশটাকে ডাইনি হাসিনা অশান্তির বাংলাদেশ বানিয়ে রেখেছিল। এই অশান্তির বাংলাদেশটা আবার শান্ত করতে গিয়ে আজকে আমাদের সন্তানরা বিদায় হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে আবার যারা অশান্তির বাংলাদেশ বানানোর চেষ্টা করতেছে আমরা শহিদদের বাবারা বেঁচে থাকতে সেটা করতে দেব না।
শাপলা চত্বর ম্যাসাকারে শহিদ আনোয়ার হোসেনের বয়োবৃদ্ধ পিতা তার সন্তানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনা করেন এবং তার সন্তানসহ সকল আন্দোলনে শহিদদের জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া করেন।
শহিদ পরিবারের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন শহিদ আবুল হোসেনের বড় ভাই আবুল বাশার অনিক, শহিদ মো. রনির বাবা মো. হারুনসহ প্রায় ১৫জন শহিদ পরিবারের সদস্য এবং অনেক আহত।
এছাড়াও জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সাংগঠনিক প্রধান মো. শফিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান, ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা মো. সেলিম, অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট কোয়ালিশনের সাধারণ সম্পাদক এস এম তানিম ও জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের যুগ্ম আহবায় রোটারিয়ান রাবেয়া আক্তার।