ষ্টাফ রিপোর্টার:: করোনাকালে মানুষের জীবনযাপন অনেক বেশি অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছে। শুধু যোগাযোগ রক্ষা কিংবা কর্মক্ষেত্রে কাজের জন্য নয়, কেনাকাটার জন্যও মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিহীন বিবেচনা করে অনলাইনে নানাবিধ পণ্যের অর্ডার দিচ্ছে। অনলাইনে যারা পণ্য বিক্রি করে থাকেন তাদের ব্যবসায়িক সততা রক্ষা করেই কাজটি করার কথা। ব্যবসায়িক সুনাম ধরে রাখার জন্য তাদের মানহীন পণ্য সরবরাহ থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ তারা জানেন একবার গ্রাহক তাদের ভুল বা অসততার জন্য মুখ ফিরিয়ে নিলে সেই গ্রাহককে তিনি ভবিষ্যতের জন্য হারাবেন। এতে তারই হবে ব্যবসায়িক ক্ষতি। তাই সুনাম বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকেন পেশাদার সৎ ব্যবসায়ী এবং পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এভাবে তারা গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকেন।
কিন্তু অপেশাদার ব্যবসায়ী বা পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঠিক তার বিপরীত। তারা একবারেই ‘দান’ মারতে চান। ভাবেন নগদ লাভটাই আসল। প্রকৃতপক্ষে তারা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখেই পড়েন। তাই বলে অনলাইনে দামী আকর্ষণীয় পণ্যের ছবি দেখিয়ে অর্ডার নিয়ে ‘ডামি’ বা খেলনা পণ্য সরবরাহ করা অভিনব প্রতারণা!
বেশ কয়েকজন ক্রেতা অভিযোগ করে জানান, অনলাইনে গরু, খাসি ও ছাগল কিনে তাদের হওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। অনেকে জানান, তারা গরুর অর্ডার করে কোরবানির দিনে তা পাননি। আবার কেউ কেউ বলছেন তারা অর্ডার দিয়ে পেয়েছেন পচা মাংস।
কেউ কেউ জানান, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সাথে কোরবানির দিন কথাই বলেননি। অনেকে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। মেসেজ’র প্রতিউত্তর দেয়নি অনেক প্রতিষ্ঠান।
ধানমন্ডির বাসিন্দা আব্দুর রহিম। কোরবানির জন্য খাসির অর্ডার করেছিলেন ‘হুকুম’ নামের একটি ফেসবুক পেইজ থেকে। কথা ছিলো প্রতিকেজি ৫৫০ টাকা দরে খাসির ওজন সামনে বসে মেপে দেওয়া হবে। ২০-২২ কেজি বা যেই পরিমাণ ওজন হবে তা বিবেচনা করে দাম পরিশোধ করতে হবে। হোম ডেলিভারি পাওয়া যাবে ঈদের আগের দিন সকালেই। অগ্রিম দিতে হবে ১০০০ টাকা। বৃহস্পতিবার অগ্রিম টাকা দিয়ে খাসির বুকিং দেয়া হয়। এরপর ঈদের আগের দিন শুক্রবার সকালে কয়েকবার ফোন দিলেও ব্যস্ত পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট বিক্রেতার নম্বর। এরপর তাকে বেলা ৩টার দিকে ফোনে পাওয়া গেলেও তিনি জানান, ‘আরো সময় লাগবে’। এরপর সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ তিনি জানান, ‘খাসি আটকে গেছে গাজীপুরে জ্যামে। আসতে আরো সময় প্রয়োজন।’
পরবর্তীতে কয়েকবার ফোন করার পর রাত সাড়ে ১২টায় খাসি এসে পৌঁছায়। সে সময় খাসির সাথে আশা লোকেরা প্রতিকেজি ৬৩০ টাকা দাবি করে বসেন। কিন্তু পূর্বে তারা ৫৫০ টাকা দরে বিক্রির কথা বলেছিলেন। এরপর দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বলেন, অন্যরা বেশি দিলে আপনারা কেন দিবেন না। আমাদের অতিরিক্ত খরচ হয়েছে।
ফরহাদ হোসেন নামের এক ক্রেতারও একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে ‘সাদিক এগ্রো’ নামের এক অনলাইন শপ থেকে গরু কিনে। তিনি জানান, তিনি গরুর কেনার সময় তাদের সাথে কথা ছিলো গরু জবাই দিয়ে মাংস পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু তাদের যথাযথ সময়ে পৌঁছে না দিয়ে দীর্ঘসময় পরে পঁচা মাংস পৌঁছে দেয়া হয়।
আসমার ওসমান একজন লেখক। তিনিও জানান তার বাজে অভিজ্ঞতার কথা। তার ভাষ্য, অনলাইন শপে তিনি সব সময় কেনাকাটা করে থাকেন। কিন্তু এবার অনলাইনে কাঁচা মাংস কিনে তার সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে। তিনি জানান, তিনি খারাপ মাংস পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট অনলাইন শপের সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি কোনো ভাবেই তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। তারা ফোন ধরেননি। ওয়াটসঅ্যাপে মেসেজের রিপ্লে দেয়নি।
এ বিষয়ে জানতে বার বার যোগাযোগ করা হলেও সাদিক এগ্রোর কেউ কথা বলতে রাজি হননি। প্রতিষ্ঠানটির অপারেশন এক্সিকিউটিব বিভাগের তারেক বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমি অভিযোগের বিষয়ে আমাদের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের জানাবো। তারপর তারা আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন।
এদিকে সাদিক এগ্রোর অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে ঘুরে দেখা যায়, পেইজটিতে অসংখ্য মানুষ তাদের বাজে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। অনেকে তাদের ব্যবহারে হতাশও প্রকাশ করেছেন।
জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসের ড্রামার সৈয়দ জিয়াউর রহমান তুর্য ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে উল্লেখ করেছেন অনলাইনে কোরবানির পশু কেনার প্রথম অভিজ্ঞতা। তিনি অভিযোগ করে লিখেছেন, ঈদের দিন খাসির মাংস ডেলিভারি দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা ঈদের পরদিনও এসে পৌঁছায়নি। বারবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিলেও কেউ সাড়া দেয়নি। আমি জানিনা কোথায় আমার জবাই হওয়া পশু, আর কখনই-বা পাবো আমার কোরবানির মাংস। করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই অনলাইনে কোরবানি করেছেন এবং তাদের প্রেশার থাকতেই পারে। কিন্তু ডেলিভারির সময় জানার এবং সেটা যদি দেরি হয়, তাও জানার অধিকার অবশ্যই ভোক্তার আছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ই-ক্যাবের মহাসচিব আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, অনলাইনে কোরবানির পশুর বেশ চাহিদা ছিলো এবার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকেই ভালো পণ্য পেলেও যাদের অভিযোগ আছে, সেগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। এখন এই সময়ে অনেক সুবিধাভোগী লোকজন এটার সুবিধা নিতে চাইবে। নতুন করে কোম্পানি তৈরি করতে চাইবে। এটা একটা বড় সমস্যা। সাধারণ গ্রাহককে আমরা যেটা বলার চেষ্টা করছি যে আপনারা যে সাইট থেকেই কিনবেন না কেনো একটু বুঝে কিনুন।
অনলাইনে ভোক্তাদের অভিযোগ পেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আমাদের ভোক্তা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট আছে। ফেসবুক পেজও আছে। প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা যেনো সেগুলো স্ক্রিনশটসহ পেজের মধ্যে লিখে দেয়। এরকম কিছু সাইটের বিরুদ্ধে অলরেডি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ই-ক্যাবের দেওয়া তথ্য মতে, বিভিন্ন মাধ্যম মিলে প্রায় ২৭ হাজার গরু, ছাগল ও অন্যান্য কোরবানির পশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া অনলাইন থেকে ছবি দেখে কৃষকের বাড়িতে বা খামারে এসে ক্রেতারা যে পরিমাণ গরু ক্রয় করেছেন, তার সংখ্যা হবে এর তিন থেকে চারগুণ।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের আরো জানায়, ডিজিটাল হাট এবং এই হাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত মার্চেন্ট ও ই-ক্যাব মেম্বারদের অনলাইনে বিক্রি হওয়া গরু, ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ৬ হাজার ৮০০। জেলাভিত্তিক সরকারি প্ল্যাটফর্মে কমপক্ষে ৫ হাজার ৫০০ গরু-ছাগল বিক্রির কথা জানা গেছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত কোম্পানির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে বিক্রিত পশু সাড়ে ৯ হাজারের কাছাকাছি। বিচ্ছিন্ন অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম থেকে ৫ শতাধিক গরু বিক্রির ধারণা পাওয়া গেছে। সরকারি প্ল্যাটফর্ম ফুড ফর ন্যাশন চার হাজার গরু বিক্রির তথ্য ট্র্যাক করতে পেরেছে। এভাবে পুরো অনলাইন বাজারে প্রত্যক্ষ বিক্রি হওয়া পশুর সংখ্যা বের হয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, আরও লাখখানেক কোরবানির পশু পরোক্ষভাবে বিভিন্নভাবে অনলাইন শপ থেকে বিক্রি করা হয়েছে এবং অন্তত পাঁচ লাখ গরু ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে প্রদর্শিত হয়েছে।