টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড ফাঁস হয়ে ফেঁসে যাওয়াদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ব্যক্তিগত টেলিফোন আলাপ ও বক্তব্যের রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর তোপের মুখে পড়া ব্যক্তিরা দলীয় পদের সঙ্গে হারাচ্ছেন নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তিও। গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের একটি বিতর্কিত বক্তব্যের অডিও প্রচারের পর দলীয় পদ এবং মেয়রের চেয়ার হারিয়েছেন তিনি। একটি লাইভ অনুষ্ঠানে নারী বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে আলোচনা আসার পর নায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে কুরুচীপূর্ণ টেলিফোন আলাপ ফাঁস হওয়ার জেরেই মূলত পদ হারাতে হয়েছে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে। প্রতিমন্ত্রী ও দলীয় পদ হারিয়ে অনেকটা আত্মগোপনে আছেন এই সংসদ সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে টেলিফোন আলাপ ফাঁসের পর মেয়র, দলীয় পদ হারিয়ে কারাবরণ করতে হয়েছে রাজশাহীর কাটাখালীর মেয়র আব্বাস আলীকে। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টারের সঙ্গে একজন বিএনপি নেতার ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় সম্প্রতি তোলপাড় চলছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বহিষ্কার দাবি করছেন।
বাস্তবতা নিয়ে কথা বলে তোপের মুখে পড়া এই নেতার ভাগ্যে কি আছে সেটা এখন দেখার বিষয়।
গত সেপ্টেম্বর মাসে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি অডিও-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন। এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। এ নিয়ে গাজীপুরে মেয়র-সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। ৩রা অক্টোবর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। ১৮ই অক্টোবরের মধ্যে জাহাঙ্গীরকে এর জবাব দিতে বলা হয়। তিনি জবাবও দেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ‘সুপার এডিট’ করা বলে বারবার দাবি করেন জাহাঙ্গীর আলম। গত ১৯শে নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলমকে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের পর ২৫শে নভেম্বর মেয়র পদ হারান তিনি। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়া জাহাঙ্গীর আলম দলীয় পদ ও মেয়র হারানোর পর এখন অনেকটা বিচ্ছিন্ন। এক সময়ে তার ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরাও এখন তাকে এড়িয়ে চলছেন। অডিও প্রকাশের পর দফায় দফায় ক্ষমাও চেয়েছেন জাহাঙ্গীর। তাতে দলীয় শাস্তি থেকে রেহাই পাননি।
জাহাঙ্গীর আলমের পর আলোচনায় আসেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে বক্তব্য দিয়ে প্রথমে আলোচনায় আসেন এই এমপি। পরে অবশ্য একটি লাইভ অনুষ্ঠানে নারী বিদ্বেষী কথা বলে তোপের মুখে পড়েন। নানা দিকে তাকে অপসারণের দাবির মধ্যে ফাঁস হয় নায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে কুরুচীপূর্ণ ফোনালাপ। ওই ফোনালাপ ফাঁসের পর চারদিকে হইচই শুরু হয়। তাকে বহিষ্কার ও গ্রেপ্তারের দাবি ওঠে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়। পরে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের পদ হারান মুরাদ। মন্ত্রিত্ব, দলীয় পদ হারানোর পর তোপের মুখে থাকা মুরাদ দেশ ছাড়েন কানাডায় আশ্রয় নেয়ার আশায়। কিন্তু সেখানেও আশ্রয় না পেয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন তিনি। নানা সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আলোচনায় আসা মুরাদ দেশে ফিরে অনেকটা আত্মগোপনে আছেন। এ পর্যন্ত তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে টেলিফোন আলাপের একটি টেপ প্রকাশ এবং তা ভাইরাল হওয়ার জেরে পদ হারাতে হয় রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলীর। জাতির পিতার ম্যুরাল স্থাপনের বিরোধিতায় বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন দলীয় পদ হারানো এই আওয়ামী লীগ নেতা। তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের তরফে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে ‘কটূক্তি ও অশালীন বক্তব্য’, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে কাটাখালী পৌরসভার ১২ জন কাউন্সিলর মেয়র আব্বাস আলীর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তাকে অপসারণের আবেদন করেছিলেন বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
নৌকা প্রতীক নিয়ে টানা দুইবার রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। অডিও টেপ ফাঁস হওয়ার পর তাকে পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক পদের পাশাপাশি রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই অডিও টেপে বলতে শোনা যায়, রাজশাহী সিটি গেটে বঙ্গবন্ধুর যে ম্যুরাল করার নকশা দেয়া হয়েছে, সেটা ‘ইসলামি শরিয়ত মতে সঠিক নয়’। এটা করতে দিলে ‘পাপ হবে’। ওই অডিও ভাইরাল হলে রাজশাহীতে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। তার অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ।
রাজশাহী নগরের রাজপাড়া, বোয়ালিয়া ও চন্দ্রিমা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলা হয় আব্বাসের বিরুদ্ধে। মেয়র আব্বাস প্রথমে দাবি করেছিলেন, ওই অডিও ‘এডিট করা’। তবে পরে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি স্বীকার করেন, ওই অডিও তিন-চার মাস আগের, ওই বক্তব্যও তার। মেয়র সেখানে বলেন, স্থানীয় একটি মাদ্রাসার বড় হুজুরের কথায় প্রভাবিত হয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল না রাখার বিষয়টি বলেছিলেন ‘কথাচ্ছলে’। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে থাকেন, যদি এটা এত বড় ভুল হয়ে থাকে, সেজন্য তিনি ক্ষমা চান। ‘চক্রান্ত হচ্ছে’ দাবি করে সবাইকে পাশে দাঁড়ানোরও অনুরোধ করেন। যদিও শেষতক কাউকে পাশে পাননি। তোপের মুখে পড়ে এলাকা থেকে লাপাত্তা হন। মামলা হওয়ার পর ৩০শে নভেম্বর রাতে ঢাকার কাকরাইলের হোটেল রাজমনি ঈশা খাঁ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করার পর র্যাব জানায়, আব্বাস ‘দেশ ছাড়ার’ চেষ্টায় ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করা হলে বিচারক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় আব্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে তিনদিনের রিমান্ডে পাঠান।
ওদিকে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টারের সঙ্গে এক বিএনপি নেতার ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এতে দল ও দলের নেতৃবৃন্দকে কটাক্ষ করার অভিযোগে ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। গতকাল দুপুরে জেলার দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে উপজেলা সদরের নিউমার্কেট এলাকার স্বাধীনতা চত্বরে কয়েক হাজার নেতাকর্মীর অংশগ্রহণে এ প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণাসহ তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। এ ব্যাপারে তারা দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপের দাবি জানান। প্রতিবাদী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও যুবলীগের সভাপতি হাজী আবুল কাশেম ওমানী, কুমিল্লা উত্তর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও জেলা পরিষদ সদস্য শিরিন সুলতানা, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ভিপি বাবুল হোসেন রাজুসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা। তারা রোশন আলী মাস্টারকে দল থেকে বহিষ্কার না করা পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। গত সোমবার রাতে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টার এবং জেলার দেবিদ্বার উপজেলা বিএনপি নেতা ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রুহুল আমীনের ফোনালাপের একটি অডিও ফাঁস হয়। দলীয় রাজনীতি নিয়ে ওই ফোনালাপের টেপ ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে।