বাজারে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এসব পণ্যের কিছু কিছু আইটেমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ শতাংশের উপরে। ডলার সংকটের দোহাই দিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুচরা দোকানিরা। তারা জানান, আরও কিছু জন্মনিয়ন্ত্রণ পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ বন্ধ রেখেছে কোম্পানিগুলো। নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির এ কঠিন সময়ে হঠাৎ করে বেড়ে যায় কনডম ও পিলের মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ পণ্যের দাম। এতে করে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতির কারণেই দেশে বেসরকারি খাতে বাজারজাতকৃত জন্মনিরোধক সামগ্রীর দাম বাড়ছে। এরফলে দেশে পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার প্রায় স্থবির হয়ে আছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যাও আর বাড়ছে না। দেশের জনসংখ্যার ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কিন্তু বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ঢিলেঢালা চলছে।
তার উপরে এসব পণ্যের দাম বাড়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জন্মনিয়ন্ত্রণে। তারা বলছেন, এতটা দাম বাড়ায় দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে প্রভাব পড়বে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে এসব উপকরণ বিনামূল্যে পাওয়া যায়। মানুষ চাইলে সেখান থেকে সংগ্রহ করতে পারে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বিক্রি করেন সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি বা এসএমসি। সেসব সামগ্রীর দাম ও চাহিদা বেশি, সেগুলোরই দাম বেড়েছে বেশি।
রাজধানীর কয়েকটি ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক প্যাকেট (৩টি) প্যানথার কনডমের দাম ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জ সেকশনে কথা হয় বিক্রমপুর ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধি এন হাসানের সঙ্গে। তিনি জানান, আরও কিছু জন্মনিয়ন্ত্রণ পণ্যের সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ডলার সংকটের অজুহাতে কোম্পানিগুলো সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বলে তাদেরকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ওইসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দোকানে দিবে কোম্পানিগুলো। এজন্যই বন্ধ রেখেছে। ২৫ টাকার সেনসেশন কনডমের প্যাকেট ৪০ টাকা হয়েছে, দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ৪০ টাকার ইউঅ্যান্ডমি কনডমের প্যাকেটের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। ৭০ টাকার এক্সট্রিম কনডমের প্যাকেটের দাম এখন ৯০ টাকা। এই পণ্যে দাম বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। নারীদের জন্মবিরতিকরণ পিলের দামও বেড়েছে। আগে এক প্যাকেট ফেমিকনের দাম ছিল ৩৪ টাকা। এখন ৪০ টাকা হয়েছে। ফেমিকন সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির পণ্য। এই কোম্পানির আরেকটি পণ্য মিনিকনের দাম বাড়েনি। নোভিস্তার তৈরি ওভাস্টেট গোল্ডের দাম ৭ টাকা বেড়েছে। ৭০ টাকার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৭৭ টাকায়। একই কথা বলেছেন মুগদার খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী সবুজ মিয়াও। বিক্রেতারা বলছেন, এসব পণ্যই বাজারে বেশি চলে। অন্য পণ্যগুলো তেমন চলে না, সেগুলোর দামও তেমন বাড়েনি। দোকানিরা বলেন, এসএমসি প্রতি সপ্তাহে তাদের পণ্য সরবরাহ করেন। তবে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এসব পণ্যের সরবরাহ ছিল না। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বর্ধিত দামে জন্ম নিয়ন্ত্রণের এসব পণ্য দিয়েছে।
বাজারে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি। তাদের পণ্যের মধ্যে প্যানথার কনডম এবং ফেমিকন পিলের চাহিদা বেশি। দামও বেশি বেড়েছে এই দুটি পণ্যের। দাম এতটা বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে এসএমসি এন্টারপ্রাইজের একজন বললেন, বাজারে প্রায় সব ওষুধের দাম বেড়েছে। অনেক খরচ বেড়েছে। তাই জন্মনিয়ন্ত্রণের পণ্যের দামও বেড়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে জন্মদানে সক্ষম দম্পতিদের মাত্র ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৬৩ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। দেশে এখন যেসব পদ্ধতি ব্যবহার হয়, তার মধ্যে খাবার বড়ির ব্যবহার সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ; ইনজেকশন ১১ শতাংশ। আর কনডমের ব্যবহার ৭ শতাংশ।
জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা মেরিস্টোপস বাংলাদেশ-এর লিড অ্যাডভোকেসি মনজুন নাহার। তিনি বলেন, জরুরি এসব পণ্যের দাম বাড়লে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে প্রভাব পড়বে। আমি হয়তো সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে বলতে পারবো না, তবে এতে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে নারীরা তাদের পছন্দের পদ্ধতি নিতে পারে না। স্বামীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে। তার নিজের আয় না থাকায় পণ্যটি কিনতে পারবে না বা কেনার সংখ্যা কমে যাবে। মনজুন নাহার বলেন, সরকার জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত উপকরণ বিনামূল্যে দেয়, কিন্তু সরকারি কার্যক্রম সম্পর্কে মানুষ খুব একটা জানে না। আবার ঢাকায় তাদের কার্যক্রমও সীমিত। ফলে মানুষ সরকারি সেবাটা নিতে পারে না। সরকারি জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণগুলো কিন্তু ভালো। তবে ঢাকায় তিন বা চারটা জায়গা ছাড়া সরকারি এসব উপকরণ পাওয়া যায় না। ফলে বেশির ভাগ মানুষ ফার্মেসির ওপর নির্ভর করে।
সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সাত ধরনের উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ বিতরণ করেন। তবে ঢাকায় এই কার্যক্রম সীমিত।
এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রামের (সিসিএসডিপি) লাইন ডিরেক্টর ডা. নুরুন নাহার বলেন, সরকারি এসব পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। বাজারে এসব সামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণে কিছুটা প্রভাব পড়লেও বেশি প্রভাব পড়বে না বলে তিনি মনে করেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ এসব পণ্যের দাম ঠিক করে দেয় ঔষধ প্রশাসন। তিনি জানান, ঢাকার আজিমপুর মাতৃসদন হাসপাতাল, মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টার, মিরপুরের লালকুঠি মাতৃসদন, তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং বাসাবো ক্লিনিক ছাড়াও মেরিস্টোপস, এফপিএবি, বিএভিএস প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরকারি এই সেবা পান আগ্রহী জনগণ। পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সরকার সাতটি পদ্ধতি বিতরণ করে। বেসরকারি পর্যায়ে দাম বাড়লে কিছুটা সমস্যা মানুষের হতে পারে। সেক্ষেত্রে যারা টাকা দিয়ে কিনতে পারবেন না, তারা এসব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এলে বিনামূল্যেই পাবেন।