একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক সংখ্যক রাজনৈতিক মামলা হয়েছিল। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। ঢালাও মামলা দিতে গিয়ে এমন অনেককে আসামি করা হয়েছিল যারা আদতে উল্লেলিখ ঘটনাস্থলে এমনটি দেশেও ছিলেন না। মামলার বর্ণনা অনুযায়ি ঘটনাস্থলের সাক্ষী প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে না খুব একটা। এতে বিপাকে পড়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। নির্বাচনের আগে দায়ের হওয়া এমন বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব এবং আসামিদের বিষয়ে তথ্যে গরমিল থাকায় এসব মামলার তদন্তে তৈরি হচ্ছে জটিলতা। ভুতুড়ে মামলার আসামিদের নিয়ে যদিও অনেকদিন ধরেই খোঁজ খবর করছে পুলিশ। এসব মামলায় কবে নাগাদ প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো সময় উল্লেখ করতে পারছেন না তদন্ত কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক খতিবুর রহমান খোকন। গত বছরের ১০ই আগস্ট থেকে ২৩শে সেপ্টেম্বর ছিলেন হজে। অথচ পুলিশের ভাষ্যে, এই সময়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা চালানোর চেষ্টা করেছেন,পুলিশের উপর ককটলে ছুড়ে মেরেছেন। চকবাজার থানার ৪৪ নম্বর মামলার একটি এজাহার থেকে জানা যায়, মামলাটি করা হয় ১৮ই সেপ্টেম্বর। এতে বলা হয়, ওই দিন তিনি চকবাজার থানার বিএনপির সেক্রেটারি হাজী টিপু সুলতানের নেতেৃত্বে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে ইসলামবাগ থেকে ওয়ার্কস রোড হাজী বালুগেট দিয়ে আসছেন এবং নাশকতা চালাবেন, এমন তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ যখন ওয়ালটনের শো রুমের সামনে যায় তখন বিএনপির কর্মীরা পুলিশের উপর ককটেল এবং ইটপাটকেল ছুড়ে মারেন। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। অথচ এই মামলার ২৯ নম্বর আসামি খতিবুর রহমান ছিলেন হজে।
তিনি দেশে ফিরেছেন ২৩শে সেপ্টেম্বর। তার বিরুদ্ধে হজে থাকার সময় মামলা হয়েছিল মোট ৬টি। এই মামলায় তিনি জেলও খেটেছেন। নভেম্বর থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। খতিবুর রহমান বলেন, এসব মামলা শুধুমাত্র আমাদের হয়রানী করার জন্য দিয়েছে। আমি যখন হজে ছিলাম এসব মামলা তখনই হয়েছে। পরে আমি নিজেও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি সেই দিন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও এই মামলায় আমাদের ৫৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিনা কারণে পাঁচ মাস জেল খেটেছি। এখনো ভয়ে এলাকায় যাই না। যদিও কিছু মামলায় জামিন নেয়া আছে। তারপরও পুলিশ বলে কথা। পুলিশ এখন আর তেমন হয়রানি করছে না বলেও জানা তিনি। পুলিশের তদন্তের ব্যপারে তিনি বলেন, আমি মামলার সময় কোথায় ছিলাম, কী করছিলাম এসব তখন পুলিশ জানতে চায়নি । তবে দুই একদিন আগে থানা থেকে ফোন দিয়েছিল, হজের কাগজপত্রগুলো দিয়ে আসার জন্য। আমি লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।
রাজধানীর চকবাজার থানা বিএনপির আহ্বায়ক ও ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আজিজুল্লাহ মারা গেছেন ২০১৬ সালের ৩রা মে মাসে। মৃত্যুর প্রায় আড়াই বছর পর তার বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা দেয় চকবাজার থানা পুলিশ। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত বছরের ৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে তিনি ইটপাটকেল ছুড়েছেন। এমনকি অন্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটিয়েছেন। এই মামলার আরেক আসামি বিএনপির সমর্থক আব্দুল মান্নাফ ওরফে চাঁন মিয়া গত ৪ঠা আগস্ট হজ করতে সৌদি আরবে যান। তাকেও এই মামলার চার নম্বর আসামি করা হয়।
চকবাজার থানায় দায়ের করা এমন একটি মামলার একজন আসামি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব মামলা নির্বাচনের আগে শুধু মাত্র নেতাকর্মীদের হয়রানী এবং বাড়ি ছাড়া করার উদ্দেশ্যই করা হয়েছিল। এখন পুলিশ তেমন একটা হয়রানী করে না। যা করার তো আগেই করেছে। কিন্তু আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব মামলার মূল উদ্দেশ্যই ছিল হয়রানী। প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বছরের ১লা সেপ্টেম্ব্বর থেকে নভেম্ব্বর পর্যন্ত সারা দেশে ভাঙ্গচুর অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৪২৯টি। এসব মামলায় ১ লাখ ৯ হাজার ৪৪১ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়। রয়েছেন জ্ঞাত ও অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা ৪ লাখ ৩৪ লাখ ৯৭৫ জন। যার অধিকাংশ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। এসব মামলা হওয়ার পর দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি পুলিশ। তদন্তেও নেই কোনো গতি। ফলে রাজনৈতিক কর্মীদের পাশাপাশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারন মানুষকে। কিছুদিন আগেও উচ্চ আদালতে এসব মামলার আগাম জামিন নেয়ার জন্য আসামিদের ভিড় দেখা গেছে। এত সংখ্যক মামলার হাজার হাজার আসামিদের যাচাই বাছাই করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের। শুধু তাই নয়, নামে বেনামে এসব মামলার আসামিদের শনাক্ত করতেও বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।
একাধিক তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মামলাগুলো তদন্ত করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছেন তারা। ঘটনাস্থলে ঘটনা না ঘটা, দুর্বল সাক্ষী, নিরপরাধ মানুষকে মামলায় জড়ানোসহ নানান অসঙ্গতির কারণে তদন্ত ঠিকমতো এগুচ্ছে না। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হওয়া মামলাগুলো ঘেটে দেখা যায়, বেশির ভাগ মামলাই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে দায়ের করা। আর এসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এক থানা থেকে আরেক থানায় বদলি হয়ে যাওয়ার কারণে পরিবর্তন হচ্ছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। বেশ কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা যায়। তবে তদন্তে এত ধীরগতি কেন জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, একটি মামলায় শতাধিক আসামি থাকে। প্রতিটি আসামি যাচাই বাছাই করতে সময় লাগে। বাড়ি,নাম,ঠিকানা একেকজন করে তদন্ত করতে হয়। সেটা তো অনেক সময় লাগার কথা।
চকবাজার থানায় দায়ের করা এমন একটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিব চন্দ্র দরজী। তিনি এ থানার ১৫ নম্বর মামলার তদন্ত করার কথা থাকলেও মাস তিনেক আগে বদলি হয়ে যান লালবাগ থানায়। ফলে মামলাটি তদন্ত করছেন আরেক কর্মকর্তা। অতীব চন্দ্র বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হলে কোনো সমস্যা থাকার কথা না। পরে যিনি আসবেন, তিনি আবার তার মতো করে তদন্ত করবেন। তার তদন্তধীন মামলাটিতে আজিজুল্লাহ নামে একজন মৃত ব্যক্তি আসামি আছেন এ ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কম্পিউটারের মিসটেক ছিল। ফলে এমনটা হয়েছে। আরেক আসামি হজে থাকার সময় কিভাবে আসামি হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি এমনটা হয় তাহলে কাগজপত্র নিয়ে থানায় যোগাযোগ করতে বলেন। চকবাজার থানার ৪৪ নম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর মো.জিহাদ হোসেন বলেন, ঘটনা ঘটেছে তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্তে ধীরগতি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো ধীরগতি নেই। আমরা আমাদের মতো কাজ করছি। তার তদন্তধীন মামলায় হজে থাকার সময় এক ব্যাক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কেন জানতে চাইলে তিনি এর কোনো উত্তর না দিয়ে এ প্রতিবেদকে থানা থেকে বিস্তারিত জেনে নিতে বলেন।