আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, একেএম এহসানুর রহমান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. ফজলুর রহমান (এফ. আর খান) ও সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল স্বপন কুমার দাস। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বেগম জিয়া কারাবন্দি। বিভিন্ন মামলা দিয়ে তাকে কী করে আরও বেশি দিন জেলখানায় রাখা যায়, সে ব্যবস্থা করেছে সরকার। যে দুটি মামলা আজকে হাইকোর্ট পর্যন্ত এসেছে। অথচ সেটা হাইকোর্ট পর্যন্ত আসার কথা না। আরো কতটি মামলায় জামিন পেলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আর দুটি মামলায় তিনি জামিন পেলেই মুক্তি পাবেন। একটি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা, অপরটি- জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা। এ দুই মামলাতেই তার সাজা হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্ট ১০ বছরের কারাদন্ডাদেশ দিয়েছে। অপরদিকে, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আদালত তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল মামলায়ও জামিন আবেদন করা হয়েছে। ওই মামলায় নথি আসতে ১২দিন বাকি আছে। আশাকরি ১২ দিন পর ওই মামলায় তার জামিন শুনানি হবে। অপরদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এফ আর খান সাংবাদিকদের বলেন, জামিনযোগ্য সেকশন হওয়ার কারণে আদালত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুই মামলায় জামিন দিয়েছেন। জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল-এর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২১শে অক্টোবর জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী বাদী হয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মানহানীর দুটি মামলা করেন। একটি মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ১৪ই অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরে আছে। আসলে দলটি ধর্মহীনতায় বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগের কাছে কোনো ধর্মের মানুষ নিরাপদ নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেছে। হিন্দুদের ওপর হামলা করেছে। খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্য যেমন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, তেমনি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে শ্রেণিগত বিভেদ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে এ বি সিদ্দিকী ২০১৭ সালের ২৫শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো একটি মানহানির মামলা করেন। এই মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, ২০১৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ে কটূক্তি করেন। এই দুই মামলাতেই গত বছরের ৩০শে জুন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় শাহবাগ থানা পুলিশ। আদালত দুই তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গত ২০শে মার্চ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
খালেদা জিয়ার মামলায় প্রথার ব্যতিক্রম ঘটছে: ব্যারিস্টার কায়সার
বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী ও দলের আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলার মধ্যে মাত্র দুইটি মামলায় জামিন বাকি রয়েছে। সেই দুইটি হচ্ছে- জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা। মামলা দুইটির গতিপ্রকৃতি ও জামিন প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় নিম্ন আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৫ বছরের সাজার রায় দিয়েছিল। বিচার ব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী উচ্চ আদালতে সাধারণত বিবাদীপক্ষ সুবিবেচনা পান। কিন্তু এখানে হয়েছে উল্টো ঘটনা। ২০১৬-২০১৭ সালের মামলাগুলোর যেখানে আপিল শুনানি হয়নি, সেখানে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের মামলায় আপিল শুনানি সম্পন্ন করা হয়েছে। সে আপিল শুনানি সম্পন্ন করতে বেঁধে দেয়া হয়েছিল মাত্র ৪ মাস সময়। যা এই উপমহাদেশে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। তিনি বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দুদক খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার আবেদন করেছিল। দুদকের সেই আবেদনের ওপর বেগম খালেদা জিয়ার কোন আইনজীবীকে শুনানির সুযোগ দেয়া হয়নি। হাইকোর্ট দুদকের আইনজীবীদের শুনানি শুনেই রায় দিয়েছেন। যেখানে হাইকোর্ট সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণা করেছেন। ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আমরা হাইকোর্ট বিভাগে জামিন শুনানির আবেদন করেছি। কিন্তু আদালত বলে দিয়েছে নিম্ন আদালত থেকে নথি আসার পর জামিন শুনানি হবে। সাধারণত ৫-৭ বছরের সাজার রায়ের ক্ষেত্রে এমনটি করা হয় না। মাননীয় আদালত, যেদিন আপিল গ্রহণ করেন সেদিনই জামিনের আবেদনের উপরে শুনানি করে থাকেন। কিন্তু কেবল বেগম খালেদা জিয়ার মামলার ক্ষেত্রে এমন প্রথার ব্যতিক্রম ঘটেছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানান, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালতের পাঁচ বছরের সাজা ঘোষণা হলে আপিল করেন তারা। গত ৩০শে অক্টোবর হাইকোর্ট এ মামলায় সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের রায় দেন। গত ২৮শে জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। এখন এ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করতে হবে। অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় গত ২৯শে অক্টোবর বিচারিক আদালতের সাত বছরের কারাদণ্ড ঘোষণার পর ১৮ই নভেম্বর হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে সাজার বিরুদ্ধে। এই মামলাতেও জামিন আবেদন করতে হবে। এছাড়া গ্যাটকো, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও নাইকো মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি চলছে। তার আইনজীবীরা জানান, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলে ৪টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের গত দশ বছরে ৩৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। এরমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা ৫টি, রাজধানীর গুলশানসহ খুলনার ফুলতলা, পঞ্চগড়, নাশকতার ১৬টি, মানহানির ৪টি, ৩টি হত্যা, সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে দেয়া মানহানিকর বক্তব্যের অভিযোগে ২টি, রাষ্ট্রদ্রোহের একটি, ভুয়া জন্মদিন পালনের একটি, সাবেক নৌমন্ত্রীর ওপর বোমা হামলার একটি, জাতীয় পতাকার অবমাননার একটি, ড্যান্ডি ডাইংয়ের অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন একটি এবং বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের মালিকানা নিয়ে রয়েছে একটি দেওয়ানী মামলা। এর মধ্যে দুই মামলায় রায় হলেও ১৬টিতে অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে এবং উচ্চ আদালতে ১১টির বিচার স্থগিত আছে। আর বাকি মামলাগুলোর কোনোটিতে অভিযোগপত্র জমা পড়েছে, বা কোনোটি তদন্তের পর্যায়ে আছে। রাজধানী ঢাকাসহ কুমিল্লা ও কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি মামলায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামী করা হয়েছে।