টেন্ডার মাফিয়া জি কে শামীম কাজ বাগাতে নগদ অর্থ উৎকোচ দেওয়ার পাশাপাশি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাও করতেন। বহুগামী শামীম ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন শোবিজে সুপরিচিত মডেল-অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্রের উঠতি নায়িকাদের সঙ্গে। টাকার বিনিময়ে তাদের নিজ শয্যাসঙ্গিনী করার পাশাপাশি বড় বড় টেন্ডার বাগিয়ে আনতে তাদের কাজে লাগাতেন। যুবলীগ নেতা শামীমের নিকেতন অফিসে প্রতিদিনই সুন্দরী মডেল ও নায়িকাদের আনাগোনা লেগেই থাকত।
উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই মোটা অংকের টাকা পাওয়ার পরও দাবি করতেন সুন্দরী ললনার সঙ্গ। চলচ্চিত্রের কমবয়সী নতুন নায়িকা ও সুন্দরী মডেলদের তারা শয্যায় পেতে চাইতেন। ধুরন্ধর শামীম কৌশলে দামি গিফটের বিনিময়ে শোবিজ-সুন্দরীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। পরে তাদেরই টেন্ডার বাগানোর অ্যাসাইনমেন্টে পাঠাতেন। অর্ধশতাধিক সুন্দরী শামীমের এন্টারটেইন মিশনে নিয়মিত অংশ নিতেন। এ তালিকায় পাওয়া গেছে সুন্দরী প্রতিযোগিতার খেতাব বিজয়ী মডেলসহ দু’একটি সিনেমায় অভিনয় করে ঢাকাই চলচ্চিত্রে আলোচনায় উঠে আসতে না পারা চার নায়িকা, ছোটপর্দার তারকা অভিনেত্রী, সেলিব্রিটি র্যাম্প মডেল ও এয়ার হোস্টেসের নাম। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে জিকে শামীম টাকার বিনিময়ে তাদের ব্যবহার করতেন।
টেন্ডার মাফিয়া শামীম কাজ পেতে ক্ষমতাবান কর্মকর্তাদের কাছে ছবিসহ সুন্দরীদের ‘সিক্রেট’ তালিকা পাঠিয়ে দিতেন। ওই তালিকা দেখে শয্যাসঙ্গিনী পছন্দ করতেন প্রভাবশালীরা। নিজের হাতের মুঠোয় থাকা সুন্দরীদের পাঠিয়ে দিতেন তারকা হোটেল কিংবা ফ্ল্যাটবাড়িতে গড়ে তোলা মধুকুঞ্জে। রূপসী মডেল-নায়িকা বগলদাবা করে কেউ কেউ বেরিয়ে পড়তেন কক্সবাজার ও সিলেটের প্লেজার ট্রিপে কিংবা ঢাকার আশেপাশের কোনো রিসোর্টে। এমনকি দেশের বাইরেও নিয়ে যাওয়া হতো তাদের। কেবল সরকারী কর্মকর্তারাই নয়, প্রভাবশালী নেতারা শামীমের কাছ থেকে শয্যাসঙ্গিনী গিফট পেয়েছেন। ।
জি কে শামীমের এন্টারটেইন মিশনে যাওয়ার আগেই সুন্দরীদের কাছে পৌছে যেত মোটা খামে পিন-আপ করা ‘সম্মানী’। মোটা অংকের টাকা কামাবার লোভে মডেল-অভিনেত্রী মুখিয়ে থাকতো তার ডাক পাওয়ার আশায়। অনেকেই আবার নির্মাতা-পরিচালকের পূর্বনির্ধারিত শিডিউল ফাঁসিয়ে দিয়ে সাড়া দিতো টেন্ডার-সম্রাটের ডাকে। শামীমের সুদৃষ্টি পড়ায় অল্পদিনেই ঢাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাট বা দামি গাড়ির মালিক হয়েছেন একাধিক আলোচিত মডেল ও অভিনেত্রী। মফস্বল থেকে উঠে আসা ঢাকাই চলচ্চিত্রের এক নায়িকা পর পর তিনটি ছবিতে ফ্লপ করে এখন প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। আরেক ব্যর্থনায়িকা এখন গুলশানে একটি ফ্যাশন হাউজ ও ধানমন্ডিতে একটি রেস্টুরেন্টের মালিক হয়েছেন।
চলচ্চিত্রে শাবানার বিকল্প হিসেবে নিজেকে জাহির করা নিজ নামে নির্মিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পরে চুপসে যাওয়া একনায়িকা জিকে শামীমের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ট বান্ধবী। এই প্রমোদবাহিনীর আরেক সুন্দরী টিভিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে পা রাখেন। পরে তাকে মডেলিংয়ে দেখা যায়। হালে চলচ্চিত্র নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। কলকাতায় নির্মিত যৌথ প্রযোজনার ছবিতেও অভিনয় করছেন। কলকাতাতেই শামীমের পাঠানো অতিথিদের তিনি সঙ্গ দিয়েছেন। নামকরা একটি ব্র্যান্ডের ম্যাংগো জুসের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে পরিচিতি পাওয়া এক মডেল জি কে শামীমকে শয্যায় সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি তার হয়ে প্রায়ই নানা জায়গায় গেছেন। সেলিব্রিটি এক ডিজেগার্লকেও বিভিন্ন পার্টিতে তার বাহুসংলগ্ন হয়ে থাকতে দেখা গেছে। লাক্সসুন্দরী হিসেবে খেতাব বিজয়ী একজন মডেল-অভিনেত্রীকে তিনি বড় কাজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। বিমানের দুজন আর রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একজন কেবিন ক্রু শামীমের হয়ে সঙ্গ দেন প্রভাবশালীদের।
রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে যুবলীগ নেতা জি কে শামীম। গোয়েন্দা পুলিশকে তিনি জানান, চিত্তবিনোদনের জন্য গুলশান ও বনানীর একটি তারকা হোটেল ও কাকরাইলের একটি হোটেল ব্যবহার করা হতো। গাজীপুরের একাধিক রিসোর্টেও টেন্ডার পাওয়ার পার্টি দেয়া হতো। এসব পার্টিতে নিজ দলের নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও সহযোগীরা উপস্থিত থাকতেন। পার্টিতে পশ্চিমা পোশাকে হাজির হতেন সুন্দরীরা। মাদকে বুঁদ হয়ে সুন্দরীদের মধ্য থেকে যাকে খুশি কাছে টেনে নিতেন। বেশ কয়েক পার্টি হয়েছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। দেশ-্ বিদেশের এইসব সেলিব্রেশন পার্টিতে কখনও কখনও অতিথি হতেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক শীর্ষনেতা, ঢাকা মহানগর যুবলীগের প্রভাবশালী একজন নেতা ও একজন সংসদ সদস্য।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে একচ্ছত্র ঠিকাদার বাণিজ্য দখলে রাখতে মাফিয়া ডন জি কে শামিম ১ হাজার ১ শ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। বিদায়ী উপ প্রধান প্রকৌশলীসহ ২০ কর্মকর্তাকে দিয়েছেন ৪ শ কোটি টাকা। র্যাবের অভিযানে আটক জি কে শামিম চলতেন সাত জন গানম্যান, ২০টি আধুনিক মোটরসাইকেল বহরে সাইরেন বাজিয়ে।স্বঘোষিত মাফিয়া মুঘল যিনি যুবদল থেকে যুবলীগে এসে টাকা ও ক্ষমতার খনি পেয়েছিলেন।
কোথায় কোথায় কত টাকা দিয়েছেন, কোথায় কোন কোন নায়িকা মডেল যৌন বাণিজ্যের সেক্সগার্লদের পাঠাতেন সব রিমান্ডে বলছেন। বলছেন নিজের অঢেল সম্পদ গড়ার কাহিনী। পুলিশ তদন্তের স্বার্থে সব জানাতে চাইছে না। সামনে তার সূত্রে আরো অপরাধী যাচাই বাছাই করে পাকড়াও করা হবে। এমনটাই নিশ্চিত করেছেন দায়িত্বশীলরা। অভিযানে যে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ও মদ পাওয়া গেছে জিজ্ঞাসাবাদে তার চেয়ে ভয়ংকর সব কাহিনী ও অর্থ সম্পদের তথ্য বেরিয়ে এসেছে।