দলিল লেখক সমিতির নামে সিন্ডিকেট গঠন করে এখনো হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলতে থাকে কৃষকের রক্তচোষা কায়কারবার। অর্থের জোরে হন ইউপি চেয়ারম্যন থেকে পদধারী আওয়ামী লীগের নেতা।
অবশেষে সেই দলিল লেখক নাসিরসহ দুই স্ত্রী মিসেস খোদেজা বেগম, মিসেস মাহফুজা বেগম (ছোট শ্যালিকা) ও স্বজন মিকাইল হোসেন জোয়ার্দ্দারের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঝিনাইদহ সিনিয়র স্পেশাল ট্রাইবুনাল জজ আদালতের বিচারক মো. আবু আহছান হাবিব এই আদেশ দেন।
গত ১১ জানুয়ারি আদালতের এই আদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে পৌঁছে গেছে। মঙ্গলবার দুপুরে এ তথ্য জানায় যশোর দুর্নীতি দমন কমিশন অফিস।
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, মামলার প্রধান আসামি কালীগঞ্জ উপজেলার সিমলা-রোকনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কালীগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক নাসির উদ্দিন চৌধুরীর চারটি একাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সোনালী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখা, রূপালী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখা ও ব্র্যাক ব্যাংক যশোর শাখার একটি হিসাব।
এছাড়া তার প্রথম স্ত্রী মিসেস খোদেজা বেগমের ব্র্যাক ব্যাংকের দুইটি হিসাব, দ্বিতীয় স্ত্রী মিসেস মাহফুজা বেগমের সোনালী ব্যাংক যশোরের চুড়ামনকাটি শাখার দুইটি হিসাব রয়েছে। এই আদেশে নাসিরের স্বজন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুলফাডাঙ্গা গ্রামের রেজাউল করিম জোয়ার্দ্দারের ছেলে মিকাইল হোসেন জোয়ার্দ্দারের ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড যশোর শাখার তিনটি হিসাব রয়েছে। সব মিলিয়ে ওই চার ব্যক্তির ১১টি হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দুদক ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক ও পুকুরিয়া গ্রামের জামসের আলীর ছেলে নাসির উদ্দিন চৌধুরীর নামে প্রায় ৬ কোটি টাকা অবৈধ পন্থায় উপার্যনের অভিযোগে দুদুক যশোর সমন্মিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহা. মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। গত ২৪ নভেম্বর দুদক কর্মকর্তা এই মামলা দায়ের করেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, আসামি নাসির চৌধুরী তার নিজ নামে ব্র্যাক ব্যাংক লি. যশোর শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব ও ১২টি এফডিআর হিসাব খোলেন। এগুলোতে তিনি বিভিন্ন সময়ে মোটা অংকের টাকা লেনদেন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তর করে অন্য এফডিআর এ জমা করা হয়েছে। সর্বপরি সকল ক্ষেত্রে এফডিআর থেকে হস্তান্তর করে মূল সঞ্চয়ী হিসাবে এনে আবার সেখান থেকে উত্তোলন করা হয়েছে।
নাসির উদ্দিন চৌধুরী ২০১২ সালের ৭ ফেব্রয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মোট ৭ টিএফডিআর এ ১ কোটি ৭৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা করেছিলেন। যা থেকে তিনি ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করে একই ব্যাংকে স্ত্রী খাদিজা বেগমের নামে সঞ্চয়ী হিসাবে হস্তান্তর করেন।
এছাড়া তিনি ওই শাখায় স্ত্রী খাদিজা বেগমের নামে একটি সঞ্চয়ী ও ৫টি এফডিআর খুলে লেনদেন করেন। যার মধ্যে সঞ্চয়ী হিসাবটি এখনও চলমান রয়েছে। ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে ওই ৬টি সঞ্চয়ী ও এফডিআরের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেন করেন। তিনি স্ত্রীর নামের এই সকল এফডিআর ও সঞ্চয়ী হিসাব থেকে ১ কোটি ২৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪১৬ টাকা উত্তোলনপূর্বক স্থানান্তর করেন।
অভিযুক্ত নাসির উদ্দিন তার শালিকা (দ্বিতীয় স্ত্রী) মোছা. মাহফুজা খাতুনের নামে যশোরের ব্র্যাক ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব ও ৪টি এফডিআর খুলে লেনদেন করেন। যার মধ্যে বর্তমানে একটিও চলমান নেই। ওই ৫টি হিসাব পর্যালোচনা করে দুদক নিশ্চিত হয়েছে যে, অভিযুক্ত নাসির উদ্দিন তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঞ্চয়ী হিসাবের টাকা জমা করে সেখান থেকে এফডিআর হিসাবে জমা করেছেন। যেখান থেকে আবার সঞ্চয়ী নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
গত ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ১৪ মে তারিখ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬২৮ টাকা উত্তোলনপূর্বক স্থানান্তর করেছেন নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তার শ্যালক জিয়াকুব আলীর নামে একই ব্র্যাক ব্যাংক ও যশোরের এবি ব্যাংকে এফডিআর ও এম.আই.ডি.এস হিসাব খুলে ৮০ লাখ টাকা জমা করেছিলেন। যা সম্পূর্ণ উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করেন। তার শ্যালক তদন্তকারী সংস্থাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নাসির উদ্দিনের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মারুফ হোসেন রিয়াজের নামে রূপালী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখায় আর.এস.এস হিসাব খুলে সেখানে ৩০ লাখ টাকা জমা করেন। এ সকল বিষয় মামলায় উল্লেখ করেছে দুদক।
মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্ত নাসির উদ্দিন চৌধুরী অবৈধ পন্থায় দুর্নীতির মাধ্যমে ৫ কোটি ৭০ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪ টাকা অর্জন করেছেন।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কৃষকরা জমি রেজিস্ট্রি করতে আসলে দুর্নীতিবাজ নাসির জনপ্রতিনিদের নাম ভাঙিয়ে সরকারি ফি’র চেয়ে বেশি টাকা হাতিয়ে নেন। এই টাকা তিনি কোনো দলিল লেখককে ভাগ না দিয়ে নিজে পকেটস্থ করে দিন দিন টাকার কুমির বনে যান। এছাড়া স্ত্রীর বোনকে বিয়ে করে দুই বোনকে নিয়ে সংসার করে যাচ্ছেন।
এদিকে আদালতে মামলা হলেও নাসির বুক ফুলিয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে জনমনে হতাশা ও মিশ্র পতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে।
এ বিষয়ে দুদক যশোর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নাজমুচ্ছসাদাত ইতিপূর্বে জানিয়েছিলেন, দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমতি পেয়ে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত ও পরবর্তীতে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত চলছে, এখনও আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।