ডেস্ক:: সরকারের ধারাবাহিক তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেটের কারণে মানুষজন আশা দেখছেন কিছু পাওয়ার। তাই টাকার অঙ্কে আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) বাজেট যেমন বিশাল, তেমনি এ বাজেটে মানুষের প্রত্যাশাও বিশাল।
আবার ২০২০ সালে পালিত হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি হবে তার পরের বছর। জাতির এ বড় দুটি অর্জন উপলক্ষে সরকারের নানা পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি থাকবে এ বাজেটে। এ দুই কারণে আসছে বাজেটের ওপর নজর থাকবে সবার।
এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) হিসাব বলছে, দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সংস্থাটির ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, দেশে কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। তবে সংখ্যা যাই হোক না কেন নতুন সরকারের কাছে কর্মসংস্থানের সুযোগের প্রত্যাশা রয়েছে কোটি বেকারের।
জাতীয় সংসদে জাতির সামনে যিনি বাজেট বক্তৃতা তুলে ধরবেন, সেই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাজেট যে কোনো দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, একটি বার্ষিক দলিল। এতে রাষ্ট্রের আয় ব্যয়ের পরিকল্পনা থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের নতুন বাজেটে থাকবে নতুন নতুন উদ্যোগ। এতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী পালনের প্রতিফলন থাকবে। বাজেটে বেশি মনোযোগ থাকবে নির্বাচনী ইশতেহারে। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে নজর থাকবে। গ্রামকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হবে। এ বাজেট হবে একটি স্মার্ট বাজেট। বাজেট বক্তব্যের আকার গতানুগতিক বিশাল সাইজের থাকছে না, এটি হবে সংক্ষিপ্ত এবং টু-দ্য পয়েন্ট। তাই বলে বাজেটের আকার ছোট হবে না, বরং যে কোনো সময়ের তুলনায় এটি হবে রেকর্ড বাজেট।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের বাজেটে অনেক কিছুই প্রথমবারের মতো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যিনি গেল মেয়াদে ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে। সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেটও এটি। এবারই প্রথম দেশের বাজেটের আকারও রেকর্ড ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে প্রায় সোয়া ৫ লাখ কোটিতে দাঁড়াচ্ছে। প্রথমবারের মতো নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ বাজেটে। এমন অনেককিছুই থাকছে নতুন বাজেটে।
আকার ও ব্যয়ের খাত: আসন্ন বাজেট প্রস্তাবে মোট আকার চূড়ান্ত করা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। চলতি বাজেটের আকার হচ্ছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। আকার বাড়ছে ৫৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। বিশাল আকারের এ বাজেটের অর্থ মূলত তিন ভাগে ব্যয় করা হবে। এর মধ্যে সিংহভাগ অংশ ব্যয় হবে পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে। এতে ব্যয় হবে ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫৯.৩০ শতাংশ। অপর বড় অংশ ব্যয় হবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে। আগামী অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে ব্যয় হবে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বা ৩৮.৭৫ শতাংশ। এর বাইরে অন্যান্য খাতে ব্যয় হবে ১০২০৭ কোটি টাকা বা ১.৯৫ শতাংশ অর্থ।
এদিকে অনুন্নয়ন খাতের অন্যান্য ব্যয়ের মধ্যে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করা হবে ৫২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা, বিভিন্ন সরকারি স্কিমে ব্যয় হবে ১ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা, মূলধনী খাতে ব্যয় হবে ৩২ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।
অর্থের উৎস: বিশাল বাজেটের অর্থের জোগান দিতে বরাবরের মতোই রয়েছে বিভিন্ন ধরনের করের ওপর নির্ভরতা। এর মধ্যে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের কথা ভাবা হচ্ছে। এটি জিডিপির ১৩ শতাংশের সমান। চলতি বছর মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। সে হিসাবে বাজেটে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ৩৮ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বেশি ধরা হচ্ছে।
রাজস্ব আয়ের প্রায় ৮৬ ভাগের জন্যই নির্ভর করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর বা সরাসরি কর থেকে। বাজেটের প্রায় ৬২.২৪ শতাংশ অর্থ এনবিআরের মাধ্যমে আয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। যার পরিমাণ ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বা এটি মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। কর ব্যতীত আয় হবে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ আগামী বছরে দাঁড়াবে ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।
আয় ও ব্যয়ের ফারামের কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি হবে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। অন্য বছরের মতোই এটি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এ ঘাটতি মেটাতে বরাবরের মতোই দেশ ও দেশের বাইরে থেকে ঋণ নিতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। দেশের ভেতরের ঋণের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে, যা চলতি বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের তুলনায় ৫ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হতে পারে। আবার সঞ্চয়পত্রে নির্ভরতা কমাতে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমানো হচ্ছে, যা চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্রের ঋণ ধরা রয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা আগামী বাজেটে হবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৩ হাজার কোটি টাকা।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট দেশের অর্থনীতির সংস্কারের দিকনির্দেশনা দেয়। এতে সরকারের আয়, ব্যয় ও ঘাটতি পূরণের হিসাবও উঠে আসে। তাই বাজেটে অর্থনীতির জন্য নানা কিছু আশা করছে সবাই। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি ৫২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রয়েছে। অবার ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে। তাই সমস্যা সমাধানে কি কি ঘোষণা আসবে তা দেখার বিষয়। আবার অগ্রাধিকার বিভিন্ন প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ ও তার ব্যয় ব্যবস্থাপনা ঠিক হচ্ছে কিনা তাও দেখতে হবে। আবার দেশে বেকারত্বের হারও কমিয়ে আনতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা, বৈষম্য কমানোর বিষয়গুলো আশা করছি। তিনি বলেন, নতুন বাজেটে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে বহুস্তরে ভ্যাট প্রায়াগের কথাও শোনা যাচ্ছে। এতে ফাঁকি দেওয়ার বিষয়গুলো থেকেই যাচ্ছে। ঘাটতি পূরণের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতা কমানোর কথা শোনা যাচ্ছে, বছর শেষে তা ধরে রাখা যাবে কিনা তাও দেখার বিষয়। আবার ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ শুরু হলে তারল্য সংকট বাড়বে, যা ব্যক্তি খাতে ঋণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সেটা কীভাবে ম্যানেজ করা হবে তাও ভেবে দেখতে হবে।