ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি::ঠাকুরগাঁও জেলার প্রায় সবকটি উপজেলায় গবাদিপশুর মাঝে ব্যাপক হারে (ভাইরাল ডিজিজ) লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এই রোগে মৃত্যুর নজির খুব কম হলেও আক্রান্ত পশু শারিরিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় কৃষকের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারন ও চরম আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে। এদিকে প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরন করে, সভা সমাবেশ করে কৃষক ও খামারীদের সচেতন থাকার পরামর্শ দেয়া হলেও এ রোগের ভাল কোন চিকিৎসা ও প্রতিষেধক না থাকায় আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
গবাদিপশু এই রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে শরীরের যত্রতত্র ফুলে গোটা গোটা টিউমার অথবা চাকা চাকা হয়ে যায়, গলকম্বলের নীচে এবং পায়ের গিরায় পানি জমে অত্যন্ত ফুলে যায় এবং প্রচন্ড রকমের জ্বর আসে। খাবারে অরুচি দেখা দেয়। এক পর্যায়ে চামড়ায় ফোসকা পড়ে রক্ত বা পূজ আসে এবং ইনফেকশন দেখা দেয়।
চলতি বছরের মে মাস থেকে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে শুরু করে বলে জানা গেছে। এ রোগে গবাদিপশুর মৃত্যুর ভয় না থাকলেও দুধের উৎপাদন কমে যায় এবং চামড়ার গুণগত মান খারাপ হয়ে যায়। আক্রান্ত পশুর চামড়ায় সংক্রমণ দেখা দেয়ায় সেটা বিক্রির অযোগ্য হয়ে যায়। আবার গাভী আক্রান্ত হলে এর দুধের উৎপাদন কমতে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে সদ্যজন্মা বাছুর ও গর্ভবতি গাভীগুলো।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো.আলতাফ হোসেন বলেন, উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এই রোগের বিস্তার বেশি হয়। আবার ভাইরাসজনিত এই রোগটি বেশ সংক্রামক এবং মশা/মাছির মাধ্যমে সেটি ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত কোনও গরুর শরীরে একটি মশা কামড় দিয়ে যদি সুস্থ গরুর ওপর বসে তাহলে সেটাও আক্রান্ত হতে পারে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা.অমল কুমার রায় বলেন,ভাইরাসজনিত এই রোগের এখন পর্যন্ত কোনও ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার হয়নি। এক্ষেত্রে ওই গরুগুলোকে টার্গেটেড থেরাপি অর্থাৎ যে ধরণের উপসর্গ দেখা দিয়েছে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে এবং ভেট সার্জনরা সে ভাবেই করছেন। অর্থাৎ কোনও গরুর যদি জ্বর আসে বা গা ব্যথা থাকে, তাহলে তাকে প্যারাসিটামল দেয়া হয়, চামড়ায় সংক্রমণ দেখা দিলে সংক্রমণ প্রতিরোধী ওষুধ।
সুস্থ গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধরে রাখা বিবেচনায়, বিকল্প উপায়ে চিকিৎসার কথা ভাবছেন তারা। তারা মূলত, খাবার সোডা, লবণ, চিটা গুড়, নিমের পাতার সাথে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট মিশিয়ে স্যালাইন তৈরি করে খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা করালে দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে গরুর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান পীরগঞ্জ উপজেলার জেলার ভিএস ডা.আবু সরফরাজ হোসেন। তবে তিনি দু:খ করে বলেন শুক্র শনি বন্ধের দিন সহ প্রতিদিন অবিরাম পরিশ্রম করে গরুর মালিক ও পল্লী চিকিৎসকদের সচেতন করার চেষ্টা করছি তবুও আশানুরপ ফল পাওয়া যাচ্ছেনা। এন্টিবায়োটিকের ব্যাপক প্রয়োগ আক্রান্ত পশুদের ক্ষতির কারন হয়ে দাড়াচ্ছে। লোকজন হাতের কাছে পাওয়া পল্লী চিকিসকদের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে বিপদে পড়ছে। তিনি আরো বলেন ইতিমধ্যে বেশ কিছু লিফলেট বিতরন ও বেশ কয়েকটি উঠান বৈঠক, সিআইজি মিটিংয়ে এ রোগের সম্পর্কে গরু মালিকদের সচেতন করা হয়েছে এবং এ কাজটি প্রায় প্রতিদিনই চলছে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, সিগগীরই হয়ত এ রোগের প্রাদুর্ভাব কমে যাবে এবং ইতিমধ্যে এটি বিভিন্ন এলাকায় কমতেও শুরু করেছে।
প্রোণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছর বিদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবাদিপশু বাংলাদেশে আনা হয়। এবং তখন এই গরুগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না। এই স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করার কারণেই এই ভাইরাসজনিত রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের মধ্যে এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, এই রোগ প্রতিরোধে আমরা গরুগুলোকে মশারির ভেতরে রাখতে বলছি, বাড়ির আঙিনা পরিস্কার রাখতে বলছি যেন মশা-মাছি না হয়। এজন্য লিফলেট দেয়া হচ্ছে,উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। কিন্তু সাধারন মানুষ এই উপদেশগুলোর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেননা।
এছাড়া এই বিভাগের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে, একটি বৃহৎ উপজেলার জন্য ১ জন মাত্র রেজিষ্ট্রার্ড চিকিৎসক রয়েছেন, যার পক্ষে অফিসিয়াল ডিউটির পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা দেয়া সম্ভবপর হয়না। সচেতনমহল দুধ ডিম ও মাংশ উৎপাদনকারী এই বিভাগে প্রতি ইউনিয়নে চিকিৎসক নিয়োগের দাবী করেছে।