ঢাকা ০৪:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
সাংবাদিক আব্দুর রহমান মারা গেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কার্যালয় গুঁড়িয়ে দিলেন শিক্ষার্থীরা হজরত সোলায়মান (আ.) ও রানি বিলকিসের ঘটনা লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন কখন পড়বেন সরকারি প্রকল্পের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে আসন পেতে মায়েদের ছোটাছুটি শনিবার খোলা থাকায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন বিআরটিএ গ্রাহক আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের ‘কঠোর বার্তা’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী: সিইসি পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে পদ্মা সেতু ‘দুর্নীতি’ মামলা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ দিন সময়

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ দিন সময়

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জারির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ দিন সময় ঠিক করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ সমাবেশে দুই সংগঠনের শীর্ষ নেতারা এ দাবি জানান। সরকার আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’ ঘোষণা না করলে ছাত্রজনতা আবারও রাজপথে নামতে বাধ্য হবে বলে আল্টিমেটাম দেয়া হয় সমাবেশ থেকে।

কর্মসূচি উপলক্ষে সকাল থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-জনতা মিছিল আর ব্যানার, পতাকা, ফেস্টুন নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেন। তারা ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘উই ওয়ান্ট উই ওয়ান্ট, জাস্টিস, জাস্টিস, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’-এমন নানা সেøাগান দিতে থাকেন। সমাবেশস্থলে পুলিশ, পুলিশের ডগ স্কোয়াড, র‌্যাব, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন।

হাসনাত আবদুল্লাহ
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এত দিন পর্যন্ত আমাদের এই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কোনো ঘোষণাপত্র ছিল না। আমরা বলতে চাই, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে আমাদের এই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে।’

সমবেতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আপনারা ঘোষণাপত্রের পক্ষে জেলায়, মহল্লায় মানুষের কাছে যাবেন। তাদের কথা শুনবেন যে তারা কী বলতে চায়। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিপক্ষে, মুজিববাদীদের বিপক্ষে, যারা এমন ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েম করেছে, তাদের বিপক্ষে আমাদের এই লড়াই জারি থাকবে।’ বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে ১৫ জানুয়ারিতে আমাদের ঘোষণাপত্র নিয়ে।’

এ সময় হাসনাত উপস্থিত জনতার সঙ্গে হাত তুলে বিচার ও সংস্কারের শপথ করেন। স্লোগান দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে দরকার, বিচার আর সংস্কার।’

আখতার হোসেন
সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন ‘জুলাইয়ের প্রোক্লেমেশন’ নিয়ে রাজপথে জমায়েত করার ঘোষণা দিয়েছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে, সব রাজনৈতিক পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সরকার ঘোষণাপত্র পাঠ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক অন্যতম বিজয় হিসেবে উল্লেখ করে আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাতে চাই, অবিলম্বে জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে এই জুলাইয়ের প্রোক্লেমেশন ঘোষণা করতে হবে।’

সামান্তা শারমিন
সমাবেশে নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণা না করলে ছাত্রজনতা আবারও রাজপথে নামতে বাধ্য হবে। ছাত্রজনতার প্রতি অনুরোধ, আপনারা বিচার ও সংস্কার নিশ্চিত না করে রাজপথ ছাড়বেন না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই কিন্তু এই প্রক্লেমেশন নিয়ে আমরা কোনো কালক্ষেপণ চাই না। আওয়ামী লীগের বিচারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের প্রতি ন্যায়বিচার হয় নাই।’

নিরবতা
বিকেল ৩টায় কথা থাকলে অনুষ্ঠান শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়। শুরুর আগে ডিজিটাল পর্দায় দেখানো হয় ‘জুলাই আন্দোলনের তথ্যচিত্র, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দমন-পীড়নের চিত্র’। এ সময় শহীদ মিনার এলাকায় আয়োজক সংগঠন দুটির নেতাকর্মী এবং সাধারণ ছাত্র-জনতার ঢল নামে। বিকেল ৪টায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’র কর্মসূচি শুরু হয়।

এর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শাহরিয়ার হাসান আলভীর বাবা মো. আবুল হাসান ছেলের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে শাহরিয়ার নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০ এ শহীদ হয়েছে। আমাদের কান্না কখনো থামবে না, এই বেদনা শেষ হওয়ার নয়। খুনি হাসিনা ও তার হেলমেট বাহিনী আমাদের ওপর পাখির মতো গুলি চালিয়েছে। আমরা খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।’

নাসীরুদ্দীন
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আগামীতে যে ঘোষণাপত্র আসবে, সেখানে প্রত্যেক শহীদের রক্তের ফোটার কথা উল্লেখ থাকতে হবে। যদি আমরা সে কথাগুলো না পাই, তাহলে বাংলার চব্বিশের বাঘের বাচ্চারা তা মেনে নেবে না। ঘোষণাপত্রে ৫৩ বছরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়েছে, তা সংস্কারের ইঙ্গিত থাকতে হবে। আমরা এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই। নতুন বাংলাদেশে কোনো শহীদ বা আহতের উপর চোখ রাঙানো চলবে না। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি হবে না।’

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বলেন, ‘আপনারা অতিদ্রুত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপে সক্রিয় হোন। সক্রিয় না হলে চব্বিশের বাঘের বাচ্চারা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেবে। আমাদের আগামীর কাজ হবে শেখ হাসিনাকে বাংলার মাটিতে এনে বিচার নিশ্চিত করা। বিচারিক প্রক্রিয়ায় (আওয়ামী লীগকে) নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।’

সারজিস
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সমাবেশে বলেন, ‘আমাদের সামনে এখনো খুনিরা উন্মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করে। এদের বিচার হতে হবে। গোপালগঞ্জে কীভাবে এখনো আমাদের সহযোদ্ধাদের ওপর হামলা হয়। পুলিশের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা নিরাপত্তা দিতে না পারলে ওই চেয়ারে বসে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। যে স্বপ্ন নিয়ে এত মানুষ জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে সেই রক্তের সঙ্গে যদি কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা করে তাদের সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে।’

সারসিজ বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে এই গণহত্যার বিচার চাই। আমরা পাচার অর্থ ফেরত চাই, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ চাই এবং আহত যোদ্ধাদের সুচিকিৎসা চাই। সরকারকে আহ্বান জানাতে চাই, আমাদের দেশ সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে যাবে। কিন্তু সেই সুযোগে যদি কেউ আমাদের মাথায় উঠে বসতে চায় তাদের আমরা মাথা থেকে ফেলে দিতে হবে।’

গণপরিষদ নির্বাচন
নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমাদেরকে বলা হয়, নতুন সংবিধান করবে তার ম্যান্ডেট কোথায়? আমরা বলি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান হবে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে যারা জয়ী হবে, তারা একইসঙ্গে সংবিধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। নতুন সংবিধান গঠন করবে এবং আইনসভার সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের বিচার, সংস্কারসহ নানা আকাক্সক্ষা চাওয়া আছে। ছাত্রজনতা অবশ্যই তাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে।’

সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, কিন্তু খুনি হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার হয়নি। ভারতে পলাতক খুনি হাসিনাকে দেশে এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একসঙ্গে নতুন বাংলাদেশকে বিনির্মাণ না করা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না ছাত্ররা।’

চট্টগ্রামের ছাত্র সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, ‘পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিপ্লব ঘোষণা করা হবে।’

সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাহিন সরকার, নুসরাত তাবাসসুম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি নাঈম আবেদীন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কোবরাসহ অনেকে।

সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন, জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় জড়িতদের বিচার, আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত ও সংস্কার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার দাবিও সমন্বয়কদের বক্তব্যে উঠে আসে। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে সমাবেশ শেষ হয়।

ঘোষণাপত্র, অন্তর্বর্তী সরকার
মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি থেকেই মঙ্গলবার ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের ঘোষণা ছিল। সেই প্রস্তুতি নিয়ে সারাদেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে শহীদ মিনারে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল।

বলা হয়েছিল, এই ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’ হবে ‘আগামীর বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র’। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে এর মাধ্যমে ‘নাৎসি বাহিনীর’ মত ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করা হবে। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালের ‘মুজিববাদী’ সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে।

ঐকমত্য গঠনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছিল ঘোষণাপত্রের খসড়া।

মঙ্গলবারের এই কর্মসূচি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যে গত রোববার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক কোনো সম্পর্ক নেই।

কিন্তু এক দিনের ব্যবধানে সোমবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একই ধরনের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়ার হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

৩০ ডিসেম্বর সোমবার রাতে জরুরি বিফ্রিংয়ে তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে। ‘আমরা আশা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।’

এরপর গভীর রাতে জরুরি বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা দেয়, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তারা তাতেই সমর্থন দেবে। অর্থাৎ, ঘোষণাপত্র সরকারই দেবে। তবে মঙ্গলবার শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিও বহাল থাকবে।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

সাংবাদিক আব্দুর রহমান মারা গেছেন

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ দিন সময়

আপডেট টাইম ১০:৩৫:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ জানুয়ারী ২০২৫

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জারির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ দিন সময় ঠিক করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ সমাবেশে দুই সংগঠনের শীর্ষ নেতারা এ দাবি জানান। সরকার আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’ ঘোষণা না করলে ছাত্রজনতা আবারও রাজপথে নামতে বাধ্য হবে বলে আল্টিমেটাম দেয়া হয় সমাবেশ থেকে।

কর্মসূচি উপলক্ষে সকাল থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-জনতা মিছিল আর ব্যানার, পতাকা, ফেস্টুন নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেন। তারা ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘উই ওয়ান্ট উই ওয়ান্ট, জাস্টিস, জাস্টিস, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’-এমন নানা সেøাগান দিতে থাকেন। সমাবেশস্থলে পুলিশ, পুলিশের ডগ স্কোয়াড, র‌্যাব, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন।

হাসনাত আবদুল্লাহ
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এত দিন পর্যন্ত আমাদের এই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কোনো ঘোষণাপত্র ছিল না। আমরা বলতে চাই, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে আমাদের এই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে।’

সমবেতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আপনারা ঘোষণাপত্রের পক্ষে জেলায়, মহল্লায় মানুষের কাছে যাবেন। তাদের কথা শুনবেন যে তারা কী বলতে চায়। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিপক্ষে, মুজিববাদীদের বিপক্ষে, যারা এমন ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েম করেছে, তাদের বিপক্ষে আমাদের এই লড়াই জারি থাকবে।’ বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে ১৫ জানুয়ারিতে আমাদের ঘোষণাপত্র নিয়ে।’

এ সময় হাসনাত উপস্থিত জনতার সঙ্গে হাত তুলে বিচার ও সংস্কারের শপথ করেন। স্লোগান দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে দরকার, বিচার আর সংস্কার।’

আখতার হোসেন
সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন ‘জুলাইয়ের প্রোক্লেমেশন’ নিয়ে রাজপথে জমায়েত করার ঘোষণা দিয়েছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে, সব রাজনৈতিক পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সরকার ঘোষণাপত্র পাঠ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক অন্যতম বিজয় হিসেবে উল্লেখ করে আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাতে চাই, অবিলম্বে জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে এই জুলাইয়ের প্রোক্লেমেশন ঘোষণা করতে হবে।’

সামান্তা শারমিন
সমাবেশে নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণা না করলে ছাত্রজনতা আবারও রাজপথে নামতে বাধ্য হবে। ছাত্রজনতার প্রতি অনুরোধ, আপনারা বিচার ও সংস্কার নিশ্চিত না করে রাজপথ ছাড়বেন না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই কিন্তু এই প্রক্লেমেশন নিয়ে আমরা কোনো কালক্ষেপণ চাই না। আওয়ামী লীগের বিচারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের প্রতি ন্যায়বিচার হয় নাই।’

নিরবতা
বিকেল ৩টায় কথা থাকলে অনুষ্ঠান শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়। শুরুর আগে ডিজিটাল পর্দায় দেখানো হয় ‘জুলাই আন্দোলনের তথ্যচিত্র, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দমন-পীড়নের চিত্র’। এ সময় শহীদ মিনার এলাকায় আয়োজক সংগঠন দুটির নেতাকর্মী এবং সাধারণ ছাত্র-জনতার ঢল নামে। বিকেল ৪টায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’র কর্মসূচি শুরু হয়।

এর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শাহরিয়ার হাসান আলভীর বাবা মো. আবুল হাসান ছেলের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে শাহরিয়ার নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০ এ শহীদ হয়েছে। আমাদের কান্না কখনো থামবে না, এই বেদনা শেষ হওয়ার নয়। খুনি হাসিনা ও তার হেলমেট বাহিনী আমাদের ওপর পাখির মতো গুলি চালিয়েছে। আমরা খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।’

নাসীরুদ্দীন
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আগামীতে যে ঘোষণাপত্র আসবে, সেখানে প্রত্যেক শহীদের রক্তের ফোটার কথা উল্লেখ থাকতে হবে। যদি আমরা সে কথাগুলো না পাই, তাহলে বাংলার চব্বিশের বাঘের বাচ্চারা তা মেনে নেবে না। ঘোষণাপত্রে ৫৩ বছরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়েছে, তা সংস্কারের ইঙ্গিত থাকতে হবে। আমরা এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই। নতুন বাংলাদেশে কোনো শহীদ বা আহতের উপর চোখ রাঙানো চলবে না। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি হবে না।’

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বলেন, ‘আপনারা অতিদ্রুত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপে সক্রিয় হোন। সক্রিয় না হলে চব্বিশের বাঘের বাচ্চারা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেবে। আমাদের আগামীর কাজ হবে শেখ হাসিনাকে বাংলার মাটিতে এনে বিচার নিশ্চিত করা। বিচারিক প্রক্রিয়ায় (আওয়ামী লীগকে) নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।’

সারজিস
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সমাবেশে বলেন, ‘আমাদের সামনে এখনো খুনিরা উন্মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করে। এদের বিচার হতে হবে। গোপালগঞ্জে কীভাবে এখনো আমাদের সহযোদ্ধাদের ওপর হামলা হয়। পুলিশের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা নিরাপত্তা দিতে না পারলে ওই চেয়ারে বসে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। যে স্বপ্ন নিয়ে এত মানুষ জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে সেই রক্তের সঙ্গে যদি কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা করে তাদের সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে।’

সারসিজ বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে এই গণহত্যার বিচার চাই। আমরা পাচার অর্থ ফেরত চাই, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ চাই এবং আহত যোদ্ধাদের সুচিকিৎসা চাই। সরকারকে আহ্বান জানাতে চাই, আমাদের দেশ সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে যাবে। কিন্তু সেই সুযোগে যদি কেউ আমাদের মাথায় উঠে বসতে চায় তাদের আমরা মাথা থেকে ফেলে দিতে হবে।’

গণপরিষদ নির্বাচন
নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমাদেরকে বলা হয়, নতুন সংবিধান করবে তার ম্যান্ডেট কোথায়? আমরা বলি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান হবে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে যারা জয়ী হবে, তারা একইসঙ্গে সংবিধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। নতুন সংবিধান গঠন করবে এবং আইনসভার সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের বিচার, সংস্কারসহ নানা আকাক্সক্ষা চাওয়া আছে। ছাত্রজনতা অবশ্যই তাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে।’

সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, কিন্তু খুনি হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার হয়নি। ভারতে পলাতক খুনি হাসিনাকে দেশে এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একসঙ্গে নতুন বাংলাদেশকে বিনির্মাণ না করা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না ছাত্ররা।’

চট্টগ্রামের ছাত্র সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, ‘পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিপ্লব ঘোষণা করা হবে।’

সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাহিন সরকার, নুসরাত তাবাসসুম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি নাঈম আবেদীন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কোবরাসহ অনেকে।

সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন, জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় জড়িতদের বিচার, আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত ও সংস্কার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার দাবিও সমন্বয়কদের বক্তব্যে উঠে আসে। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে সমাবেশ শেষ হয়।

ঘোষণাপত্র, অন্তর্বর্তী সরকার
মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি থেকেই মঙ্গলবার ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের ঘোষণা ছিল। সেই প্রস্তুতি নিয়ে সারাদেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে শহীদ মিনারে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল।

বলা হয়েছিল, এই ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’ হবে ‘আগামীর বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র’। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে এর মাধ্যমে ‘নাৎসি বাহিনীর’ মত ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করা হবে। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালের ‘মুজিববাদী’ সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে।

ঐকমত্য গঠনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছিল ঘোষণাপত্রের খসড়া।

মঙ্গলবারের এই কর্মসূচি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যে গত রোববার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক কোনো সম্পর্ক নেই।

কিন্তু এক দিনের ব্যবধানে সোমবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একই ধরনের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়ার হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

৩০ ডিসেম্বর সোমবার রাতে জরুরি বিফ্রিংয়ে তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে। ‘আমরা আশা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।’

এরপর গভীর রাতে জরুরি বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা দেয়, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তারা তাতেই সমর্থন দেবে। অর্থাৎ, ঘোষণাপত্র সরকারই দেবে। তবে মঙ্গলবার শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিও বহাল থাকবে।