ঢাকা ০৩:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
পীরগঞ্জে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় ভ্যান চালকের চালকের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা ঠাকুরগাঁও জেলা আ.লীগের সভাপতি হলেন বাবলু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ঠাকুরগাঁওয়ে শহীদ জায়া’রা ভিক্ষাবৃত্তি করে পীরগঞ্জ থানা পুলিশের পৃথক অভিযানে ৬ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার পীরগঞ্জে রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় র‌্যালী পীরগঞ্জে দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস উপলক্ষে র‌্যালি ও আলোচনা সভা ছাদে অবৈধ রেস্তোরাঁ, সিলিন্ডারে লিকেজ: ল্যাবএইড হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা অকটেনে ৪ টাকা, পেট্রোলে ৩ টাকা, ডিজেলে ৭৫ পয়সা কমল মজুতদারি-কালোবাজারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে সিআইডির ১২ টিম যেভাবে রক্ষা পেয়েছিল ৭ই মার্চের ভাষণের ভিডিও

ঠাকুরগাঁও মুক্ত হয় ১০ হাজার প্রাণের বিনিময়ে

আজম রেহমান,সারাদিন ডেস্ক::আজ ৩ ডিসেম্বর। ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এইদিনে ঠাকুরগাঁও মহকুমায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের দুর্বার প্রতিরোধে পতন হয় পাকবাহিনীর। বিজয় ছিনিয়ে আনতে ১০ হাজার নারী পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়। পাশবিক নির্যাতনের শিকার ২ হাজার মা-বোন। আজকের এদিনে পাকবাহিনীর পতনের পর এ এলাকার সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির উল্লাস। আনন্দ উদ্বেলিত কণ্ঠে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি আর হাতে প্রিয় স্বদেশের পতাকা নিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে তরুণ-যুবক সবাই। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় আনন্দের মিছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ঠাকুরগাঁও শহর।

যে মানুষগুলোর আত্মত্যাগে দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছিল তাদের স্মরণে হানাদার মুক্ত দিবস পালনে এবার উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেই সব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হবে দিবসটি। দিবসটি পালনে সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা দাবি মুক্তিযোদ্ধাসহ সবার।

ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কমান্ডার ছিলেন পাক বাহিনীর স্কোয়াড্রেন লিডার খাদেমুল বাশার। সমগ্র সেক্টরে ১ হাজার ১২০টির মত গেরিলা বেইস গড়ে তোলা হয়। ৮ মের আগ পর্যন্ত সুবেদার কাজিম উদ্দিন এর দায়িত্বে ছিলেন। ৯ মে ক্যাপ্টেন নজরুল, কাজিম উদ্দিনের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে স্কোয়াড্রেন সদরু উদ্দিন ও ১৭ জুলাই ক্যাপ্টেন শাহারিয়া সাব সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকসেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালির ওপর। তাদের প্রতিরোধ করতে সারাদেশসহ ঠাকুরগাঁওবাসীও গড়ে তুলেছিল দুর্বার আন্দোলন। ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ে পাক বাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ হয় রিক্সা চালক মোহাম্মদ আলী। পরদিন ২৮ মার্চ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করায় শিশু নরেশ চৌহানকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনীর সদস্যরা। সেময় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব ফজলুল করিমের নির্দেশে ১০টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। পাকিস্তানী বাহিনীকে ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য ২০টি জায়গা নির্ধারন করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ১০ এপ্রিল থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের সঙ্গে অন্যান্য মহকুমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সৈয়দপুরে পাকিস্তানী সেনারা শক্ত ঘাটি করে এগিয়ে আসতে শুরু করে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনাদের সঙ্গে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন সংগ্রাম কমিটি ১৩ এপ্রিল তাদের কন্ট্রোল রুম ও ২০টি প্রতিরোধ ক্যাম্প তুলে নিয়ে সীমান্তে অবস্থান নেয়।

১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও। পাক সেনারা ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে মুহুর্মুহু সেল বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকে পড়ে। পাশ্ববর্তী পঞ্চগড় থানা’র তেতুলিয়াকে কেন্দ্র করে ১৫০ বর্গমাইলের ১টি মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠে। সেখানে পাক বাহিনী কখনও ঢুকতে পারেনি। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় চুড়ান্ত লড়াই। শুরু হয় হত্যা, ধর্ষন, নির্যাতন, লুটপাট আর বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা।

আওয়ামীলীগের ঘাটি বলে পরিচিত ঠাকুরগাঁও রোড ইসলাম নগর থেকে ছাত্র নেতা আহাম্মদ আলী, সহ ৭ জনকে হানাদার বাহিনী ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে আটক করে রাখে। পর বেয়নেট চার্জ করে হত্যার পর তাদের লাশ শহরের টাঙ্গন ব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বে গণকবর দেয়। এভাবে তারা রুহিয়া রামনাথ হাঠ, ফারাবাড়ী, রোড, ভাতারমারি ফার্ম, ভোমরাদহ ও বালিয়াডাঙ্গী এলাকায় গনহত্যা চালায়।

সবচেয়ে বড় বর্বরোচিত গণহত্যাকাণ্ড চালায় সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা এলাকায়। ২৩ এপ্রিল সেখানে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ২ হাজার ৬শ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে পাথরাজ নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে। স্বামী হারিয়ে সে দিনের বিভৎস ক্ষত নিয়ে এখনও বেচে আছে ৪ শতাধিক বিধবা।

দ্বিতীয় গণহত্যা চালানো হয় রানীশংকৈল উপজেলার খুনিয়াদিঘীর পাড়ে। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার নিরিহ লোকজনকেও ধরে নিয়ে যেতো ওই পুকুরের পাড়ে। সেখানে একটি শিমূল গাছে সাথে হাতে পায়ে লোহার পেরেক গেঁথে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে বর্বর নির্যাতন চালাতো লোকজনের উপর। তারপর লাইন করে দাঁড় করিয়ে সাধারন মানুষকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করা হতো। দিনের পর দিন গণহত্যায় মানুষের রক্তে এক সময় লাল হয়ে উঠে ওই পুকুরের পানি। তাই পরবর্তিতে এ পুকুর খুনিয়াদিঘি নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

নভেম্বর মাসের ৩য় সপ্তাহ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক অভিযান চালায়। ২১ নভেম্বর হতে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয় বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল ও হরিপুর থানা অঞ্চলে। এ যুদ্ধে বেশির ভাগ ফলাফল মুক্তি বাহিনীর অনুকুলে আসে।

২ ডিসেম্বর সারারাত প্রচন্ড গোলাগুলির পর শত্র“বাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে শত্র“মুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। ওই রাতেই মুক্তি বাহিনী ও সর্বস্তরের জনগন মিছিল সহ ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয় এবং লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় উল্লাস করতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ।

বীরমুক্তিযোদ্ধা মন্টু দাস বলেন, রক্তের বিনিময়ে পাক বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করা হয় ঠাকুরগাঁও জেলা। কিন্তু যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগিরা এখনও প্রকাশ্যে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। তাই সরকার দ্রুত এসব রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিবে বলে তিনি আশা করেন।

জাটিভাঙ্গা এলাকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী নির্মলা রাণী বলেন, শহীদদের বিধবা স্ত্রীদের এখন পর্যন্ত বিধবা ভাতা ও পুনর্বাসন করা হয়নি। তাই স্বামী হারা বিধবাদের পুর্নবাসনের দাবি জানান।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদরুদ্দোজা বদর বলেন, ২ ডিসেম্বর সারারাত প্রচন্ড গোলাগুলির পর শত্র“বাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে শত্র“মুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। ওই রাতেই মুক্তি বাহিনী ও সর্বস্তরের জনগন মিছিল সহ ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়।

ঠকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আওয়াল বলেন, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত হয়েছিল। সে লক্ষে এ বছর দিবসটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য পালন করা হবে। এছাড়াও ঠাকুরগাঁও জেলার মানুষ ৩ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত দিবসকে মর্যাদা দিয়ে পালন করে। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা শহীদ হয়েছে তাদের স্ত্রীকে বিধবা ভাতা দেয়ার জন্য সরকার কাজ করছে যাচ্ছে। দ্রুত তাদেরকে বিধবা ভাতা দেয়া হবে।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

পীরগঞ্জে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় ভ্যান চালকের চালকের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা

ঠাকুরগাঁও মুক্ত হয় ১০ হাজার প্রাণের বিনিময়ে

আপডেট টাইম ০৩:৩৩:৪০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭

আজম রেহমান,সারাদিন ডেস্ক::আজ ৩ ডিসেম্বর। ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এইদিনে ঠাকুরগাঁও মহকুমায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের দুর্বার প্রতিরোধে পতন হয় পাকবাহিনীর। বিজয় ছিনিয়ে আনতে ১০ হাজার নারী পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়। পাশবিক নির্যাতনের শিকার ২ হাজার মা-বোন। আজকের এদিনে পাকবাহিনীর পতনের পর এ এলাকার সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির উল্লাস। আনন্দ উদ্বেলিত কণ্ঠে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি আর হাতে প্রিয় স্বদেশের পতাকা নিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে তরুণ-যুবক সবাই। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় আনন্দের মিছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ঠাকুরগাঁও শহর।

যে মানুষগুলোর আত্মত্যাগে দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছিল তাদের স্মরণে হানাদার মুক্ত দিবস পালনে এবার উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেই সব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হবে দিবসটি। দিবসটি পালনে সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা দাবি মুক্তিযোদ্ধাসহ সবার।

ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কমান্ডার ছিলেন পাক বাহিনীর স্কোয়াড্রেন লিডার খাদেমুল বাশার। সমগ্র সেক্টরে ১ হাজার ১২০টির মত গেরিলা বেইস গড়ে তোলা হয়। ৮ মের আগ পর্যন্ত সুবেদার কাজিম উদ্দিন এর দায়িত্বে ছিলেন। ৯ মে ক্যাপ্টেন নজরুল, কাজিম উদ্দিনের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে স্কোয়াড্রেন সদরু উদ্দিন ও ১৭ জুলাই ক্যাপ্টেন শাহারিয়া সাব সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকসেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালির ওপর। তাদের প্রতিরোধ করতে সারাদেশসহ ঠাকুরগাঁওবাসীও গড়ে তুলেছিল দুর্বার আন্দোলন। ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ে পাক বাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ হয় রিক্সা চালক মোহাম্মদ আলী। পরদিন ২৮ মার্চ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করায় শিশু নরেশ চৌহানকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনীর সদস্যরা। সেময় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব ফজলুল করিমের নির্দেশে ১০টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। পাকিস্তানী বাহিনীকে ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য ২০টি জায়গা নির্ধারন করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ১০ এপ্রিল থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের সঙ্গে অন্যান্য মহকুমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সৈয়দপুরে পাকিস্তানী সেনারা শক্ত ঘাটি করে এগিয়ে আসতে শুরু করে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনাদের সঙ্গে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন সংগ্রাম কমিটি ১৩ এপ্রিল তাদের কন্ট্রোল রুম ও ২০টি প্রতিরোধ ক্যাম্প তুলে নিয়ে সীমান্তে অবস্থান নেয়।

১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও। পাক সেনারা ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে মুহুর্মুহু সেল বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকে পড়ে। পাশ্ববর্তী পঞ্চগড় থানা’র তেতুলিয়াকে কেন্দ্র করে ১৫০ বর্গমাইলের ১টি মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠে। সেখানে পাক বাহিনী কখনও ঢুকতে পারেনি। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় চুড়ান্ত লড়াই। শুরু হয় হত্যা, ধর্ষন, নির্যাতন, লুটপাট আর বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা।

আওয়ামীলীগের ঘাটি বলে পরিচিত ঠাকুরগাঁও রোড ইসলাম নগর থেকে ছাত্র নেতা আহাম্মদ আলী, সহ ৭ জনকে হানাদার বাহিনী ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে আটক করে রাখে। পর বেয়নেট চার্জ করে হত্যার পর তাদের লাশ শহরের টাঙ্গন ব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বে গণকবর দেয়। এভাবে তারা রুহিয়া রামনাথ হাঠ, ফারাবাড়ী, রোড, ভাতারমারি ফার্ম, ভোমরাদহ ও বালিয়াডাঙ্গী এলাকায় গনহত্যা চালায়।

সবচেয়ে বড় বর্বরোচিত গণহত্যাকাণ্ড চালায় সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা এলাকায়। ২৩ এপ্রিল সেখানে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ২ হাজার ৬শ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে পাথরাজ নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে। স্বামী হারিয়ে সে দিনের বিভৎস ক্ষত নিয়ে এখনও বেচে আছে ৪ শতাধিক বিধবা।

দ্বিতীয় গণহত্যা চালানো হয় রানীশংকৈল উপজেলার খুনিয়াদিঘীর পাড়ে। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার নিরিহ লোকজনকেও ধরে নিয়ে যেতো ওই পুকুরের পাড়ে। সেখানে একটি শিমূল গাছে সাথে হাতে পায়ে লোহার পেরেক গেঁথে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে বর্বর নির্যাতন চালাতো লোকজনের উপর। তারপর লাইন করে দাঁড় করিয়ে সাধারন মানুষকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করা হতো। দিনের পর দিন গণহত্যায় মানুষের রক্তে এক সময় লাল হয়ে উঠে ওই পুকুরের পানি। তাই পরবর্তিতে এ পুকুর খুনিয়াদিঘি নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

নভেম্বর মাসের ৩য় সপ্তাহ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক অভিযান চালায়। ২১ নভেম্বর হতে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয় বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল ও হরিপুর থানা অঞ্চলে। এ যুদ্ধে বেশির ভাগ ফলাফল মুক্তি বাহিনীর অনুকুলে আসে।

২ ডিসেম্বর সারারাত প্রচন্ড গোলাগুলির পর শত্র“বাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে শত্র“মুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। ওই রাতেই মুক্তি বাহিনী ও সর্বস্তরের জনগন মিছিল সহ ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয় এবং লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় উল্লাস করতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ।

বীরমুক্তিযোদ্ধা মন্টু দাস বলেন, রক্তের বিনিময়ে পাক বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করা হয় ঠাকুরগাঁও জেলা। কিন্তু যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগিরা এখনও প্রকাশ্যে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। তাই সরকার দ্রুত এসব রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিবে বলে তিনি আশা করেন।

জাটিভাঙ্গা এলাকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী নির্মলা রাণী বলেন, শহীদদের বিধবা স্ত্রীদের এখন পর্যন্ত বিধবা ভাতা ও পুনর্বাসন করা হয়নি। তাই স্বামী হারা বিধবাদের পুর্নবাসনের দাবি জানান।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদরুদ্দোজা বদর বলেন, ২ ডিসেম্বর সারারাত প্রচন্ড গোলাগুলির পর শত্র“বাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে শত্র“মুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। ওই রাতেই মুক্তি বাহিনী ও সর্বস্তরের জনগন মিছিল সহ ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়।

ঠকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আওয়াল বলেন, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত হয়েছিল। সে লক্ষে এ বছর দিবসটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য পালন করা হবে। এছাড়াও ঠাকুরগাঁও জেলার মানুষ ৩ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত দিবসকে মর্যাদা দিয়ে পালন করে। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা শহীদ হয়েছে তাদের স্ত্রীকে বিধবা ভাতা দেয়ার জন্য সরকার কাজ করছে যাচ্ছে। দ্রুত তাদেরকে বিধবা ভাতা দেয়া হবে।