দ্য স্ক্রল ডট ইন জানিয়েছে, কামাখ্যা মন্দির আগে থেকেই নানাকারণে বিতর্কিত। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়, তান্ত্রিক চর্চার জন্য বেশ পরিচিত মন্দিরটি।
এসব চর্চার সঙ্গে প্রায়ই জুড়ে দেয়া হয় নরবলির কথা। তাই নতুন এই ঘটনা স্থানীয়দের মনে নরবলি হিসেবে বেশ মজবুত হয়ে উঠেছে। এমনকি হত্যার সময় বিবেচনাতেও এটি নরবলি হিসেবেই ইঙ্গিত দেয়। মন্দিরের দিনপঞ্জিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ‘আম্বুবাচি মেলা’র ঠিক আগ দিয়ে খুন হয়েছেন ওই নারী। তার পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পূজার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। উল্লেখ্য, আম্বুবাচি মেলায় ওই মন্দিরে যোগ দেন অগণিত পূজারি ও সন্যাসী। এটি একটি বার্ষিক মেলা। দেবি কামাখ্যার ঋতুস্রাবের সময়কে উদযাপন করতে এর আয়োজন করা হয়। প্রচলিত ধারণা অনুসারে, বছরের এই সময়েই ঋতুস্রাব হয়ে থাকে দেবি কামাখ্যার। ওই সময় পুরো মন্দির বন্ধ করে রাখা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, দেবি কামাখ্যা তখন অপবিত্র থাকেন। অপর এক বিশ্বাস অনুসারে, দেবির ঋতুস্রাবের অপবিত্র রক্ত হচ্ছে জীবন ও জীবনীশক্তির অগ্রদূত। বন্ধ থাকার পর মন্দিরটি যখন ফের খুলে দেয়া হয় তখন দেবির পূজারিদের মধ্যে লাল কাপড় বিতরণ করা হয়। কাপড়টি দেবির রক্তের নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়। সাধারণত তিন দিন পরই মন্দির খুলে দেয়া হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ জানায়, নরবলি কখনোই আম্বুবাচি মেলার অংশ ছিল না। মন্দিরটি পরিচালনা করেন ‘কামাখ্যা বরদেউরি সমাজ’ নামের একটি পারিবারিক দাতব্য সংস্থার সদস্যরা। দাতব্য সংস্থাটির এক সদস্য রাজিব শর্মা বলেন, বহু বছর ধরে কোনো নরবলির ঘটনা ঘটেনি। আগে কেবল দুর্গা পূজার সময় নরবলি দেয়া হতো।
ইতিহাস আর পুরা কথা
রাজিবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন ‘কামাখ্যা: অ্যা সোশিও-কালচারাল স্টাডি’র লেখক নিহার রঞ্জন মিশরা। তিনি বলেন, কিছু লেখায় নরবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই চর্চা বহু আগেই থেমে গেছে। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক নথিপত্রগুলোর স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই। তবে তার ধারণা, ১৫ শতাব্দীর দিকেই বন্ধ হয়ে গেছে নরবলি। কিন্তু সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
এদিকে, অনেক মন্দির গবেষকরা দাবি করেন যে, কামাখ্যা মন্দিরে কখনোই নরবলি দেয়া হয়নি। গবেষক সুরিয়া দাস বলেন, ঐতিহাসিক নথিপত্র অনুসারে, কামাখ্যায় নরবলি দেয়ার কোনো প্রমাণ নেই। যদিও ‘কলিকা পুরাণ’-এ এমনটা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেটি আধা-ইতিহাস। প্রসঙ্গত, কলিকা পুরাণ হচ্ছে হিন্দু ধর্মের দেবিকেন্দ্রিক শাক্ত প্রথার ১৮টি উপপুরাণের মধ্যে একটি। ওই পুরাণের ওপর ভিত্তি করে কামাখ্যা মন্দিরের অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। পুরাণের একটি পঙ্ক্তি হচ্ছে- যখন কোনো মানুষকে বলি দেয়া হয়, দেবি ১০০০ বছরের জন্য তুষ্ট থাকে, আর যখন তিনটি নরবলি দেয়া হয় তখন দেবি ১ লাখ বছর পর্যন্ত তুষ্ট থাকে।
কিন্তু দাস জানান, কামাখ্যা মন্দিরে ওই পঙ্ক্তি কখনোই আক্ষরিকভাবে নেয়া হয়নি। সেখানে মানুষের বদলে ময়দা ও আটার তৈরি প্রতিমূর্তি ব্যবহার করা হতো। হয়তো তেমনটা এখনো হয়। কিন্তু মন্দিরের সব কাজকর্ম এত গোপনীয়তা আর রহস্যে ঢাকা যে, নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন।
নরবলির অন্যান্য স্থান
আসামের বিভিন্ন মন্দিরে নরবলির চর্চা হয়েছিল বলে গুঞ্জন শোনা যায়। কিন্তু সেগুলোর মূল জায়গা কামাখ্যা মন্দির ছিল না। ঐতিহাসিক নথিপত্র অনুসারে, কামাখ্যার চেয়ে তাম্রেশ্বরি মন্দিরে নরবলির চর্চা ছিল নিয়মিত। চুতিয়া রাজবংশের আমলে মন্দিরটি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ১৭৮০ সালের দিকে আহম রাজবংশ চুতিয়াদের পরাজিত করলে নরবলির চর্চা বন্ধ হয় সে মন্দিরেও। এখন সেটি প্রায় ধ্বংসের মুখে।
অপরাধ ঢাকতে সাজানো নরবলি
এদিকে, রাজিব শর্মার ধারণা, সাম্প্রতিক খুনটি কোনো নরবলি নয়, বরং পুলিশ ভুল পথে পরিচালিত করতে নরবলির মতো সাজানো হয়েছে। মন্দির বিষয়ক গবেষক অবন্তিকা পারাশার বলেন, দেখে মনে হচ্ছে এটা কোনো ভ-ের কাজ। কলিকা পুরাণের বরাত দিয়ে তিনি বলেন যে, কোনো নরবলি গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য সেটি কোনো দাগহীন তরুণ যুবকের হতে হবে। খুব সম্ভবত এটি কোনো যৌন হামলা ও খুনের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা।