ঢাকা ১০:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম

নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে/ আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই

আজম রেহমান::প্রিয় শিল্পি সুবির নন্দীর নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে আজ। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তার গেয়ে যাওয়া স্বর্নালী কন্ঠের সেই গান আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাদতে শিখেছি, আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই, জেনেও আমরা অশ্রু সংবরন করতে পারিনা। লেখাটি লেখার প্রারম্ভে আমিও কেদেছি অঝোর ধারায়। দুটি নয়ন হয়েছে শ্রাবনের বিরামহীন অশ্রুধারা যেন এ কান্নার আর শেষ হবেনা। তবুতো মেনে নিতে হয় তার এই চলে যাওয়া।

দিন যায় কথা থাকে

আমাদের ছোটবেলার অনেকটা সময় রেডিও শুনে কেটেছে। যারা রেডিওতে গান গাইতেন, আমরা তাদের চিনতাম না বা তারা দেখতে কেমন সে বিষয়ে আমদের কোনো ধারণা ছিল না। কারণ এখনকার মত এত টিভি চ্যানেল, অনলাইন পত্রিকা, ইন্টারনেট ছিল না। এমনকি সিনেমাভিত্তিক যে পত্রিকা প্রকাশ হতো, সব বাড়িতে সেসব পত্রিকা রাখাও হতো না।

মফস্বল শহরের কথা বলা বাতুলতা মাত্র। তাই আমাদের শিল্পীর গলা শুনে বুঝতে হতো কে গান গাইছেন। আমাদের এই চর্চাই শুধু তাদেরকে চিনতে শেখায়নি বরং তাদের নিজস্ব গায়কী ভঙ্গিও একটা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আজ অবশ্য প্রযুক্তির কারণে সব শিল্পীর গলা এক রকম লাগে। বিশেষ করে একবার শুনে বুঝতে পারি না কার গান শুনছি। দিনের পর দিন চলে যায় ঠিকই কিন্তু অনেক কথাই রয়ে যায়।

কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই

এক প্রিয় শিল্পীকে নিয়ে লিখছি, যিনি আর আমাদের মাঝে নেই। এই বাক্য লিখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। যদিও তার সঙ্গে আমি কাজ করিনি বা আমাদের কোনোদিন দেখাও হয়নি। আমাদের কোনো সম্পর্কও নেই। এটা অবশ্য বলা যায় না। একটা সর্ম্পক আছে, সেটা যদিও একতরফা। সর্ম্পকটা হলো আমি তার গানের ভক্ত। আমি তার গানের শ্রোতা। পেশাগতভাবে তিনি ব্যাংকে সুদীর্ঘ সময় চাকরি করেছেন।

১৯৫৩ সালের ৩০ নভেম্বর সুবীর নন্দী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার নন্দী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সিলেট বেতারে গান করতেন। এরপর ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকায় রেডিওতে লাইভ অনুষ্ঠানে গান করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে রেডিওতে এবং ১৯৭৪ সালে তিনি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক সিংগার হিসেবে গান গাওয়া শুরু করেন। আধুনিক ও চলচ্চিত্রের মোট গানের সংখ্যা আনুমানিক আড়াই হাজারের মতো হবে বা তারও কিছু বেশি। প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান আলমগীর কবির পরিচালিত ‘মহানায়ক’ ছবিতে গান গেয়ে। এরপর তিনি ‘শুভদা’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘মেঘের পর মেঘ’ ও ‘মহুয়া সুন্দরী’ ছবির সুবাদে এ সম্মাননা অর্জন করেন। দুঃখের পর সুখ, প্রেম বলে কিছু নেই, ভালোবাসা কখনো মরে না, সুরের ভুবনে, গানের সুরে আমায় পাবে শীর্ষক অ্যালবাম আছে তার।

তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গান লিখে শেষ করা যাবে না। তার বিখ্যাত কিছু গানের মধ্যে রয়েছে- আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি, দিন যায় কথা থাকে, মাস্টারসাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই, বন্ধু তোর বারাত নিয়ে আমি যাব, হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে, তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে, পাহাড়ের কান্না দেখে, পাখীরে  তুই, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, ও আমার উড়াল পংখীরে, মরিলে কান্দিস না আমার দায়, একটা ছিল সোনার কন্যা, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়, তোমারি পরশে জীবন আমার ইত্যাদি।

৫০ বছর ধরে  তিনি নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করে, শুদ্ধ সংগীত চর্চা করে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই’- এই গানটি হয়তো শ্রোতাদের আর কাঁদতে দেবে না।

মাস্টারসাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই

আজকাল মৃত্যুর খবর শুনলে আমি চমকে উঠি না বরং চিন্তা করি, এই ক্ষতি কীভাবে পূরণ করব। এ বছর আমরা একে একে আমাদের সংস্কৃতির অনেক গুণীজনকে হারিয়েছি। আরো কিছু গুণী বর্তমানে অসুস্থ। এদের সর্ম্পকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কিভাবে জানবে? নাম উল্লেখ না করে বলছি, এ ধরনের গুণীজনদের আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হলে দরকার গবেষণা, পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা। যাতে করে একটি বইয়ে বা এমন কোনো স্থান যেখানে প্রতিটি শিল্পীর রেখে যাওয়া শিল্পকর্ম নিয়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদেরকে সম্মৃদ্ধ করতে পারে। সুবীর নন্দীর মত আমি গবেষণায় নাম দস্তখত শিখতে চাই, যাতে আমাদের সংস্কৃতি দিন দিন আরো সম্মৃদ্ধ হয়। সুবীর নন্দীর মত শিল্পী হয়তো যুগে যুগে আসে, আবার নাও আসতে পারে, তবে আসার জন্য কি আমরা পারি না কিছু সুযোগ তৈরি করতে? একথা যখন চিন্তা করি, তখন নেশার লাটিমের মতন আমি ঝিম ধরে বসে থাকি কিয়ৎক্ষণ।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

ঠাকুরগাঁয়ে যুবলীগ নেতার পলিথিন কারখানা বন্ধ, মালামাল জব্দ

নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে/ আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই

আপডেট টাইম ০৩:৫৬:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ মে ২০১৯

আজম রেহমান::প্রিয় শিল্পি সুবির নন্দীর নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে আজ। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তার গেয়ে যাওয়া স্বর্নালী কন্ঠের সেই গান আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাদতে শিখেছি, আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই, জেনেও আমরা অশ্রু সংবরন করতে পারিনা। লেখাটি লেখার প্রারম্ভে আমিও কেদেছি অঝোর ধারায়। দুটি নয়ন হয়েছে শ্রাবনের বিরামহীন অশ্রুধারা যেন এ কান্নার আর শেষ হবেনা। তবুতো মেনে নিতে হয় তার এই চলে যাওয়া।

দিন যায় কথা থাকে

আমাদের ছোটবেলার অনেকটা সময় রেডিও শুনে কেটেছে। যারা রেডিওতে গান গাইতেন, আমরা তাদের চিনতাম না বা তারা দেখতে কেমন সে বিষয়ে আমদের কোনো ধারণা ছিল না। কারণ এখনকার মত এত টিভি চ্যানেল, অনলাইন পত্রিকা, ইন্টারনেট ছিল না। এমনকি সিনেমাভিত্তিক যে পত্রিকা প্রকাশ হতো, সব বাড়িতে সেসব পত্রিকা রাখাও হতো না।

মফস্বল শহরের কথা বলা বাতুলতা মাত্র। তাই আমাদের শিল্পীর গলা শুনে বুঝতে হতো কে গান গাইছেন। আমাদের এই চর্চাই শুধু তাদেরকে চিনতে শেখায়নি বরং তাদের নিজস্ব গায়কী ভঙ্গিও একটা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আজ অবশ্য প্রযুক্তির কারণে সব শিল্পীর গলা এক রকম লাগে। বিশেষ করে একবার শুনে বুঝতে পারি না কার গান শুনছি। দিনের পর দিন চলে যায় ঠিকই কিন্তু অনেক কথাই রয়ে যায়।

কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই

এক প্রিয় শিল্পীকে নিয়ে লিখছি, যিনি আর আমাদের মাঝে নেই। এই বাক্য লিখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। যদিও তার সঙ্গে আমি কাজ করিনি বা আমাদের কোনোদিন দেখাও হয়নি। আমাদের কোনো সম্পর্কও নেই। এটা অবশ্য বলা যায় না। একটা সর্ম্পক আছে, সেটা যদিও একতরফা। সর্ম্পকটা হলো আমি তার গানের ভক্ত। আমি তার গানের শ্রোতা। পেশাগতভাবে তিনি ব্যাংকে সুদীর্ঘ সময় চাকরি করেছেন।

১৯৫৩ সালের ৩০ নভেম্বর সুবীর নন্দী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার নন্দী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সিলেট বেতারে গান করতেন। এরপর ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকায় রেডিওতে লাইভ অনুষ্ঠানে গান করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে রেডিওতে এবং ১৯৭৪ সালে তিনি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক সিংগার হিসেবে গান গাওয়া শুরু করেন। আধুনিক ও চলচ্চিত্রের মোট গানের সংখ্যা আনুমানিক আড়াই হাজারের মতো হবে বা তারও কিছু বেশি। প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান আলমগীর কবির পরিচালিত ‘মহানায়ক’ ছবিতে গান গেয়ে। এরপর তিনি ‘শুভদা’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘মেঘের পর মেঘ’ ও ‘মহুয়া সুন্দরী’ ছবির সুবাদে এ সম্মাননা অর্জন করেন। দুঃখের পর সুখ, প্রেম বলে কিছু নেই, ভালোবাসা কখনো মরে না, সুরের ভুবনে, গানের সুরে আমায় পাবে শীর্ষক অ্যালবাম আছে তার।

তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গান লিখে শেষ করা যাবে না। তার বিখ্যাত কিছু গানের মধ্যে রয়েছে- আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি, দিন যায় কথা থাকে, মাস্টারসাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই, বন্ধু তোর বারাত নিয়ে আমি যাব, হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে, তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে, পাহাড়ের কান্না দেখে, পাখীরে  তুই, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, ও আমার উড়াল পংখীরে, মরিলে কান্দিস না আমার দায়, একটা ছিল সোনার কন্যা, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়, তোমারি পরশে জীবন আমার ইত্যাদি।

৫০ বছর ধরে  তিনি নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করে, শুদ্ধ সংগীত চর্চা করে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই’- এই গানটি হয়তো শ্রোতাদের আর কাঁদতে দেবে না।

মাস্টারসাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই

আজকাল মৃত্যুর খবর শুনলে আমি চমকে উঠি না বরং চিন্তা করি, এই ক্ষতি কীভাবে পূরণ করব। এ বছর আমরা একে একে আমাদের সংস্কৃতির অনেক গুণীজনকে হারিয়েছি। আরো কিছু গুণী বর্তমানে অসুস্থ। এদের সর্ম্পকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কিভাবে জানবে? নাম উল্লেখ না করে বলছি, এ ধরনের গুণীজনদের আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হলে দরকার গবেষণা, পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা। যাতে করে একটি বইয়ে বা এমন কোনো স্থান যেখানে প্রতিটি শিল্পীর রেখে যাওয়া শিল্পকর্ম নিয়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদেরকে সম্মৃদ্ধ করতে পারে। সুবীর নন্দীর মত আমি গবেষণায় নাম দস্তখত শিখতে চাই, যাতে আমাদের সংস্কৃতি দিন দিন আরো সম্মৃদ্ধ হয়। সুবীর নন্দীর মত শিল্পী হয়তো যুগে যুগে আসে, আবার নাও আসতে পারে, তবে আসার জন্য কি আমরা পারি না কিছু সুযোগ তৈরি করতে? একথা যখন চিন্তা করি, তখন নেশার লাটিমের মতন আমি ঝিম ধরে বসে থাকি কিয়ৎক্ষণ।