নইম নিজাম:: আশির দশকে অন্ধকার জগতে ছিল নিউইয়র্ক শহর। মাফিয়াদের দাপটের মুখে অতিষ্ঠ, অসহায়, জিম্মি ছিল সাধারণ মানুষ। কোথাও আইনশৃঙ্খলা, শান্তি, স্থিতিশীলতা ছিল না। মাফিয়ারা যা খুশি তা করে বেড়াত। কেউ কিছু বলতে পারত না। কারও সাহসও ছিল না। পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখত। মাফিয়ারাই নিয়ন্ত্রণ করত নিউইয়র্ক শহর। মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের অবৈধ ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে শহরে। বিশেষ করে মাদক সাম্রাজ্যের বিকাশ ছিল ভয়াবহ। কালো অপরাধীরা যখন তখন ছিনতাই করত। খুন-খারাবি করত। বাংলাদেশের প্রবাসীরা শান্তিতে ছিল না। ট্রেনে উঠত তারা ভয়ে ভয়ে। নিউইয়র্কের এসব কাহিনি গড়ায় হলিউডে। নির্মাণ করা হয় চলচ্চিত্র। সেই চলচ্চিত্রও বাজার পায় বিশ্বব্যাপী। কিন্তু নিউইয়র্কের পরিবেশ আর উন্নত হয় না। বরং বরং দিন দিন আন্ডারওয়ার্ল্ডের দাপট বাড়তেই থাকে। সবাই ধরে নিয়েছিল পরিস্থিতির আর উন্নতি হবে না। এভাবেই চলতে থাকবে। কিন্তু না, হঠাৎ সবকিছু বদলে যায়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সবকিছু বদলে দেন একজন মেয়র। নাম রুডি জুলিয়ানি। নিউইয়র্কের মেয়র। ভোটে জিতেই মাঠে নামেন অন্যায় আর মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করেন জিরো টলারেন্স। মাফিয়াদের বিরুদ্ধে রুডি জুলিয়ানির পাশে এসে দাঁড়ান একদল সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা। সবার এক কথা, এবার সবকিছুর অবসান দরকার। অনেক হয়েছে, আর না। মাদক, জুয়া, প্রতারণা, হাইজ্যাক, হানাহানি, খুনোখুনি আর মাফিয়া দমনে হবে কঠোরতম শুদ্ধি অভিযান। ছাড়া হবে না গডফাদারদেরও। যেমন কথা তেমন কাজ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দালায় সাধারণ মানুষ। সবার এক প্রশ্নÑ জুলিয়ানি পারবেন তো? আগের মেয়ররা অনেক কথা বলেছেন। বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু পারেননি। সবাইকে চমকে দিয়ে জুলিয়ানি শুরু করলেন অভিযান। লড়াই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মেয়র হিসেবে মাত্র চার বছরের মেয়াদকালে নিউইয়র্ককে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসেন। যেখানে যা দরকার তাই করলেন। খুন, রাহাজানি, হানাহানি বন্ধ করলেন। কথায় কথায় গুলির অবসান হলো। নিউইয়র্ক পরিণত হলো আধুনিক শহরে। মাফিয়াতন্ত্রের কবর হলো। সাদা-কালো সব অপরাধীকে কঠোর হাতে দমন করেন জুলিয়ানি। কাউকে ছাড় দেননি। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধ করেন। প্রয়োজনে ক্রসফায়ারও দেন। নিউইয়র্কে ফিরে আসে আইনের শাসন। মানুষ সাধুবাদ জানায়। ঘুরে দাঁড়ায় সবাই। জুলিয়ানির এই সাহসিকতায় রিপাবলিকানরা নিউইয়র্কে টানা নিয়ন্ত্রণ পায়। জুলিয়ানি এখন নেই মেয়রের আসনে, কিন্তু নিউইয়র্কের মানুষ তাকে মনে রেখেছে। এমনকি ট্রাম্পের সঙ্গে নানা বিতর্কের পরও নিউইয়র্কবাসীর কাছে জুলিয়ানির অবস্থান এখনো আলাদা। সবাই আইনের শাসনে নিয়ে আসে তার নাম।
নিউইয়র্ক শহরকে বদলে দিয়েছিলেন একজন জুলিয়ানি। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়ক এভাবে অভিযান চালিয়ে দেশকে শুদ্ধ করেছেন। সময় এসেছে বাংলাদেশেও অন্যায়-অসংগতির বিপক্ষে লড়ার। আমাদের দেশটা আসলে এমন ছিল না। মানুষ এত অর্থলোভী ছিল না। কিন্তু কী করে যেন সব বদলে গেল। চারদিকে এক অশনিসংকেত সব অতীতকে হার মানিয়েছে। অনেক দিন থেকেই মানুষের ভিতরে এক ধরনের কষ্ট কাজ করছে। কিছু অন্যায়কারীর দাবিয়ে বেড়ানো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে বেমানান। সবার ধারণায় আসে সমস্যার বোধহয় কোনো সমাধান নেই। কারণ রাজনীতি কিছু মানুষের কাছে লাভজনক ব্যবসা। উড়ে এসে জুড়ে বসে এখানে যা খুশি তা করা যায়। কোনো জবাবদিহি নেই। সরকারের টানা শাসনের সুযোগ নিয়ে নিউইয়র্কের মতোই মাফিয়ারা ঢুকে পড়েছে এই শহরে। তারা ক্যাসিনোর নামে আন্ডারওয়ার্ল্ডকে করেছে চাঙ্গা। ঠিকাদারি ব্যবসার নামে করেছে লুটপাট। কাজ না করেই অর্থ তুলে নিত ওরা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিবাজদের সহায়তায়। কতিপয় এমপি ও মন্ত্রীপুত্রের বাড়াবাড়ি ছিল দৃষ্টিকটু। তাদের আত্মীয়স্বজনরা হয়ে ওঠেন লাগামহীন। রাজনীতি জিম্মি হয়ে যায় দুর্বৃত্তায়নের কাছে। কতিপয় নেতা বেরিয়ে আসেন গডফাদার হিসেবে। অর্থ দিলেই মেলে পদ-পদবি। রাজনৈতিক দল, সহযোগী সংগঠন, উপকমিটি, শাখা কমিটি হয়ে ওঠে পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। দিনের পর দিন চলছিল। কেউই কিছু বলেনি। বরং সবাই ব্যস্ত ছিল ছবি তোলা নিয়ে। কারও কিছু বলার নেই। দাপুটে মানুষরাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ওদের সঙ্গে ভোগবিলাসে যুক্ত হয় নবাগত, বহিরাগত হাইব্রিডরা। শনিতে শনিতে আট দিন আওয়ামী লীগ করে জমিদারিত্ব কায়েম করে ওরা। চট্টগ্রামের একজন দিদারুল আলম চৌধুরী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের নেতা। তারা হয়ে ওঠেন অসহায়। ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ নিয়েই দিন কাটান। অথচ ’৭৫ সালের পর এই মানুষগুলোই ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজপথের কান্ডারি। আর হুইপ সাহেবরা ছিলেন প্রথমে বিএনপি পরে জাতীয় পার্টি। দুই পার্টি খাওয়া শেষ। এখন এলাহি ভরসা আওয়ামী লীগ!
সব দলের জন্যই গত ১১ বছর আওয়ামী লীগের দরজা ছিল খোলা। আজব আজব খবর শুনছি এখন। সেদিনও করত ফ্রীডম পার্টি। এখন যুবলীগ নেতা। কেউ বনে গেছেন আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামী লীগের উপকমিটির নামে যাকে তাকে নিয়ে আসা হতো। ছাত্রলীগের লোকজন ঠাঁই পেত না। এই সুযোগে বিএনপি, জামায়াতের অনেক নেতাও আওয়ামী লীগ বনেছেন। কেউ বুঝল না তারা দল করতে আসেননি। এসেছেন ব্যবসা করতে। সুযোগ পেয়েই ঐতিহ্যবাহী দলটিকে নিয়ে বাণিজ্য করছেন। এই নষ্টভ্রষ্ট নতুন নতুন আওয়ামী লীগারদের নিয়েই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জটিলতা বেড়েছে। হারিয়ে গেছে অনেক স্বপ্ন। ভ্রষ্টদের এই বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। ক্ষমতায় টানা থাকার সমস্যা অনেক। কিছু মানুষ রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক হয় লাগামহীনভাবে। শুধু এই শহর নয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে গড়ে উঠছে রাজনীতির নামে বাণিজ্য মাফিয়া। তারা গড়ে তুলছে বিশাল বিশাল প্রাসাদ। সেই প্রাসাদগুলো সাধারণ মানুষের চোখে নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। গত ১১ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ব্যস্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিয়ে। আর রাস্তার আগাছারা এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিত্তশালী। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া- একই চিত্র। সরকারি দলের আড়াল নিয়ে মাদক, জুয়া সব ধরনের অপকর্মই হয়েছে। এই নষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। মাদকসম্রাটদের ধরুন। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ করুন। লুটেরাদের বিরুদ্ধে থাকুন জিরো টলারেন্সে। বঙ্গবন্ধুকন্যার এই অভিযান ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। সবারই মনে রাখা দরকার, জাতির জনক দেশটা স্বাধীন করেননি এই লুটেরাদের জন্য। বড় মাফিয়া সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, দুবাইতে ঘাঁটি গড়েছে। বের করতে হবে কারা ব্যাংকের অর্থ পাচার করেছে এসব দেশে। অর্থ পাচারকারী ব্যাংক লুটেরাদের চিহ্নিত করতে হবে। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধার ওষুধ কেনার টাকা নেই। মূল্যায়ন হয়নি ময়দানে যুদ্ধ করা অনেক শহীদ পরিবারের। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ দানবের কবলে থাকতে পারে না। ঢাকা শহরে এখন চলা যায় না। রাস্তার টোকাইরা যা খুশি তা করছে। ঢাকার বাইরেও একই চিত্র। বন্ধ হোক সব ধরনের নৈরাজ্য। রাজনীতি ফিরে আসুক রাজনীতিবিদদের কাছে। সাধারণ মানুষের কাছে। বাংলাদেশ কারও জমিদারি নয়। শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবার বলতে তাঁরা দুই বোন ও তাদের সন্তানদেরই বোঝায়। এরপর আর কোনো কথা থাকে না। অপরাধী যত প্রভাবশালী হোক আটক করতে হবে। অভিযান ছাত্রলীগ, যুবলীগ দিয়ে শুরু। এ অভিযান এখানে শেষ হলে চলবে না। সব অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ কারও চিরস্থায়ী ইজারার কেন্দ্র নয়। সরকারি অফিস কারও লুটের অংশ হতে পারে না। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তির সোপান তৈরি করতে হবে। বন্ধ করতে হবে সব ধরনের অন্যায়, বৈষম্য, ব্যাংক লুট। বিচার করতে হবে শেয়ারবাজার লুটেরাদের।
সবারই মনে রাখা দরকার, ঠুনকো কাচের মতো ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যায় ক্ষমতার বাড়াবাড়ি। ইতিহাস তা-ই বলে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ নিয়ে ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা একটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ সমস্যার ইতি টানতে হবে। অন্যায়-অসংগতি দূর করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দূর করতে হবে কঠোরভাবে। কর্মকর্তাদের সততা-নিষ্ঠাই পারে রাজনীতিবিদদের লাগাম টানতে। এখন আর সেই কর্মকর্তা নেই। অন্যায়-অসংগতির লাগামহীন দাপটে স্বপ্নবাজ মানুষ হারিয়ে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন সবকিছু থেকে। রাজনীতিবিদদের প্রতি একটা সময় মানুষের গভীর সম্মান ছিল। ভালোবাসা ছিল। একসময় সমাজের ভালো পরিবারের মানুষ রাজনীতি করতেন। আবার অহংকারহীন কিছু মানুষ রাজনীতি করতেন সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই মানুষগুলো আজ আর নেই। ’৮৬ সালের ভোটের কথা। নাঙ্গলকোটে আমার বাড়ির পাশের একটি বাজারে হঠাৎ দেখলাম গামছা পেতে অর্থ তুলছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা। সেই অর্থ দিয়ে কেন্দ্র খরচ চালালেন। এখন সেই নেতাও নেই, সেই রাজনীতিও নেই। এই লেখা শেষ করছি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্য দিয়ে। ’৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতির জনক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এই বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা বাংলার শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান- করাপশন। খাদ্য কিনতে যান করাপশন। বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫% শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি…’ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ অমরতা পেয়েছে। কারণ সময় বদল হয়েছে। আমাদের সমাজ বদল হয়নি। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করেছিলেন। আজ তার মেয়ে সেই বাস্তবতায় নতুন করে লড়াই শুরু করেছেন। শেখ হাসিনার এ লড়াই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।
লেখক : সম্পাদক বাংলাদেশ প্রতিদিন।