পীর হাবিবুর রহমান:: করোনা থেকে পৃথিবী কবে মুক্ত হয়ে বুকভরে শ্বাস নেবে, কবে ফিরে আসবে জীবনের ছন্দ? কিছু ভালো লাগে না। এমন জীবন মাঝে মাঝে বিষাদই নয়, অভিশপ্ত লাগে। মায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা আহ্লাদি মেয়েটি আমার চন্দ্রস্মিতা। তার টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ। মা তার এভার কেয়ারের আইসিইউ থেকে কেবিনে ফিরে ফের আইসিইউতে। করোনায় ১৩ দিন হাসপাতালে। সোমবার সকালেও গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। আগের রাতেও ঘুমাতে যাওয়ার আগে পাশে শুয়ে বকবক করেছে। এখন আইসোলেশনে তার রুমে। দরজা খুলে ডাকে। বলে, তোমার মন খারাপ কেন? বলি না তো! বলে জানি, তোমার মুখ দেখেই বুঝি। আহারে! আমার কান্না আসে কেন? কি মর্মস্পর্শী রোগ করোনা। মেয়ে বাবাকে এসে ছুঁতে পারে না! মৃত্যু তো আরও কত মর্মান্তিক! যত পরিবার হারিয়েছে স্বজন, যত পরিবারে আক্রান্ত প্রিয়জন, কেবল তারাই জানে বেদনায় কতটা ভারী করোনায় জীবন! জীবন-জীবিকা লণ্ডভণ্ড। লড়াই করেই বেঁচে আছে মানুষ। লড়াই করে টিকে থাকাই তার ধর্ম। মানবজমিনে এত মৃত্যু এত আক্রান্ত, ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়, কর্মহারা মানুষ! মানবজাতির জন্য এক বড় শিক্ষা। করোনা জয় হলে নতুন করে মানবিক পৃথিবী গড়ার তাগিদ নেবে কি? এখনো অস্ত্রবাণিজ্য রমরমা। রণতরী পড়ে আছে, শুয়ে আছে যুদ্ধজাহাজ! তবু থেমে নেই রণহুঙ্কার, যুদ্ধের মহড়া, উত্তেজনা শক্তিমানদের!
আমাদের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা সাহসী দৃঢ় নেতৃত্ব ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে করোনা মোকাবিলার লড়াই করছেন। জনগণ তাঁকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন দিচ্ছে। তাঁর মতোন মমত্ববোধ নিয়ে দায়িত্বশীল সবাই যদি লড়তেন করোনাকালে, মানুষের দুর্গতি কষ্ট কমে যেত। মৃত্যু ও আক্রান্তের দীর্ঘ মিছিলে আজ কঠিন পরিস্থিতির মুখে দেশ। কত মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে মরছে। কেউ রাস্তায়, কেউ বাড়িতে, কেউ হাসপাতালের ভিতরে, কেউবা সামনে! কত কত অমানবিক ঘটনার খবর হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে বাসি হচ্ছে। হাসপাতালে লাশের হাত বেঁধে রেখে বিল চাইছে। বাবার লাশ আনতে সন্তান যায় না। পরিবার কবরে শায়িত বা চিতায় পোড়ানোর দায় নেয় না। ভয়-আতঙ্কে পরিবার পাশে নেই। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় মৃত্যুর তিন ঘণ্টা পর শবদেহ থেকে সংক্রমণ ছড়ায় না। তবু ভয়!
স্বাস্থ্য বিভাগের চরম ব্যর্থতা, চিকিৎসক-নার্সদের ভয় মানুষকে আরও বিষাদগ্রস্ত করেছে। সংসদে মুজিবুল হক চুন্নু স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে যথার্থই বলেছেন, ‘আপনি সিন্দুক থেকে বের হন। হাসপাতালে যান। মাঝেমধ্যে বের হয়ে যে কথা বলেন, তা মানুষ গ্রহণ করছে না।’ আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, তাকে সরিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগে বড় পরিবর্তন না আনলে সামনে আরও ভয়াবহ দুঃসময়। এদিকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর শয্যার পাশে নেই ডাক্তার-নার্স! বেসরকারি হাসপাতালে বিলের ফর্দ ভুতুড়ে হয়ে আসে কিন্তু ডাক্তার-নার্স দূরত্ব মাপে! ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক দলের দুই মাসের থাকা-খাওয়ার খরচ ২০ কোটি। ঝড় উঠেছে। তদন্ত হোক। স্বাস্থ্য খাতের ডাকাতি আজ বহুল আলোচিত বেদনা। এখনো মাস্ক কেলেঙ্কারি। কার্ডিওলজির সার্জন সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও তার প্রতারক লম্পট মাদকসেবী স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী মিলে টেস্ট জালিয়াতি করে হাতিয়েছেন জনগণের বিপুল টাকা। এখন রিমান্ডে আরিফ। কারা এদের প্রশ্রয়দাতা? রাত গভীরে মৃত্যুর খবর। সকাল হলেই শোকসংবাদ! অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় করোনার ভ্যাকসিনের তৃতীয় ট্রায়াল দিয়েছে, চীনও বলছে আবিষ্কার করেছে। পৃথিবীর সঙ্গে আমরাও তাকিয়ে আছি। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা যত নির্ঘুম লড়ছেন মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় ততই দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের লোভের লকলকে ফণাও বের হচ্ছে। করোনার মরণ থাবাও অমানবিক শক্তিকে রুখতে পারে না! বড় করুণা হয় দুর্নীতিবাজদের জন্য। এদের মনুষ্যত্ববোধ কবে হবে? লাজ লজ্জাহীন বেহায়া লোভীদের মানুষ আড়ালে কি প্রবল ঘৃণায় বলে তুই চোর! তুই দুর্নীতিবাজ! তুই ব্যাংক লুটেরা! তুই অর্থ পাচারকারী ডাকাত! এদের কবে আত্মগ্লানি অনুশোচনা হবে? নাকি কখনোই না! লোভী দুর্নীতিবাজদের লজ্জা শরম থাকতে নেই। মানুষকেই আজ গ্রাম থেকে শহর, নগর, বিদেশে এদের বলতে হবে দেশদ্রোহী চোর। সামাজিক বয়কট করতে হবে। ১০ বছরে মৃত শেয়ারবাজার হঠাৎ একদিনে চাঙ্গা রেকর্ড! ভয় লাগে। বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে বলি, জুয়াড়িরা না আবার খেলে বসে!
রাষ্ট্র দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে বলা হতো ‘অর্ধেক পৃথিবীর রাজা’। প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনের পরাক্রমশালী এ রাজা উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়াজুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে মিসর থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া এই বীর মাত্র ৩৩ বছর বয়সে জীবনের ইতি টানেন মাতৃভূমির বাইরে বাগদাদের ব্যাবিলনে। মৃত্যুশয্যায় বিষণ্ন আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতিদের ডেকে বললেন, ‘আমার অন্তিম তিনটি ইচ্ছা যেন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়।’ সেনাপতিরা সজল চোখে আলেকজান্ডারের কথায় সম্মতি জানালেন। আলেকজান্ডার বললেন, ‘প্রথম ইচ্ছা- আমার শবদেহ সমাধিক্ষেত্রে বহন করে নিয়ে যাবে কেবল আমার চিকিৎসকরা।’ একটু থেমে তিনি টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবার বললেন, ‘আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা- সমাধিপানে আমার শবদেহ বয়ে নিয়ে যাবে যে পথে, সে পথে আমার অর্জিত সব সোনা-রুপা, মণি-মুক্তা, ধনরত্ন ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘আমার তৃতীয় এবং শেষ ইচ্ছা হলো- শবদেহ বহনের সময় আমার হাত দুটো কফিনের ভিতর থেকে বাইরে বের করে রাখবে।’
আলেকজান্ডারের প্রিয় সেনাপতি তাঁর হাতে গভীর শ্রদ্ধামাখা চুম্বন করে বললেন, ‘আমরা অবশ্যই আপনার এসব ইচ্ছা পূরণ করব।’ কিন্তু মহান সম্রাট! আমাদের বড় কৌতূহল জাগছে আপনি অনুগ্রহ করে বলবেন, কেন এমন আদেশ?’ আলেকজান্ডারের চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করে উঠল, কিন্তু ঠোঁটের কোণে খেলছে রহস্যময় হাসি। তিনি বললেন, ‘আমি আমার জীবনের বিনিময়ে তিনটি বিষয় শিখেছি, তা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিতে চাই। প্রথমত, আমার শবদেহ চিকিৎসকরা বহন করবে, যেন সবাই উপলব্ধি করতে পারে মানুষের জীবন প্রদীপ ফুরিয়ে এলে পৃথিবীর কোনো চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয় তাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয় ইচ্ছার ব্যাখ্যায় আলেকজান্ডার বলেন, ‘সমাধিপানের পথে ধনরত্ন ছড়িয়ে দেবে, যেন সবাই জেনে যায় আমি সারাটি জীবন ব্যয় করেছি সম্পদ অর্জনের পেছনে, কিন্তু তার কিছুই সঙ্গে করে নিতে পারছি না! তৃতীয়ত, কফিনের বাইরে হাত বের করে রাখবে। কারণ আমি বিশ্বকে জানাতে চাই আমি পৃথিবীতে শূন্য হাতে এসেছিলাম; আবার যাওয়ার সময় শূন্য হাতেই ফিরে যাচ্ছি। প্রিয় সেনাপতিদের সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে চোখ দুটি বুজে আসে সম্রাটের, পরিসমাপ্তি ঘটে এক অসম বীরত্বমাখা অধ্যায়ের। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মৃত্যুশয্যায় উপলব্ধি করেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে সময় এবং জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মানুষের জন্য কিছু করা।
এখনো আমরা বলি, কাফনের কোনো পকেট থাকে না। মানে অর্থবিত্তের এত লোভ নেশা কিন্তু মৃত্যুই তো নিশ্চিত বাকিসব অনিশ্চিত। আর মৃত্যুতে তো কিছুই নিয়ে যাওয়া যায় না। তবু কেন এত লোভ! অনিয়ম ঘুষ দুর্নীতি চুরি ব্যাংক লুট, শেয়ার লুট, বিদেশে অর্থ পাচার? দেশ-বিদেশে অবৈধ সম্পদ? স্বাস্থ্য খাতের মতোন মানুষের মৌলিক অধিকারের বরাদ্দে এমন নির্লজ্জ লুটপাট? সামনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এত চুরি? তবু আমরা জীবনের উপলব্ধিতে না দিই সময়ের মূল্য, না মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়ার চেষ্টা করি! আমরা জানি মৃত্যুতে কর্মই নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু অসহনীয় লোভের বিষের যন্ত্রণা নিয়ে আমাদের সময় নষ্ট করে বা মানুষের জন্য কিছু না করে দুর্নীতিবাজের তকমা নিয়ে চলে যাচ্ছি কেন?
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অবৈধ অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে তোলপাড় হলো কদিন। এটা এমন কী টাকা! এ তো একটি সরকারি ব্যাংক থেকেই হলমার্কের মতোন ফড়িয়া লুটে নিয়ে যায়! দেশে এক দশকের দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, বিদেশে অর্থ পাচারের ঝড় এখনো থামেনি। করোনার মরণযন্ত্রণাও দেশের অর্থনীতি লুটপাটের জখম ভুলতে দেয়নি। কারণ ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের ওয়াদা এখনো পূরণ হয়নি। ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় না এনে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এ যেন যেসব দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী দেশের অভ্যন্তরে বিশাল বিনিয়োগ করে চড়া ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়ে কর্মসংস্থান করছেন, দেশের অর্থনীতিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখছেন, দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করছেন তাদের সাহস, সততা, অবদান, যুদ্ধের সঙ্গে উপহাস! ঋণখেলাপি ব্যাংক ডাকাতদের সঙ্গে সৃষ্টিশীল কমিটেড শিল্পপতিদের একপাল্লায় তুলে বিদ্রপ!
অন্যদিকে এখনো বিদেশে অর্থ পাচার রোধ হয়নি। বছরে গড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছেই। ব্যাংক লুটেরাদের দণ্ডিত করা যায় না। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার লুটের পর সেদিনের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে বলেছিলেন, ওদের হাত অনেক লম্বা! আমার সাধারণ বুদ্ধিতে নিয়ত একটাই প্রশ্ন কেন এমন হবে? আইনের হাত, নাকি অপরাধীদের হাত অনেক বড়? কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সব নাগরিকের অধিকার সমান, এটা কি তবে কেবল রাজনীতির স্লোগান? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সংবিধান দিয়েছিলেন তাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে সেটিতে কাটাছেঁড়া করে রাষ্ট্রের চরিত্র বদল হয়েছে। তবু জনগণের ক্ষমতার মালিকানা রয়ে গেছে। সেটি কতটা আজ কার্যকর? তবু তো রাষ্ট্রের হাত শক্তিশালী, তবু কেন আমরা শেয়ারবাজার লুটেরা ও তাদের পৃষ্ঠপোষক, ব্যাংক লুটেরা ও তাদের প্রশ্রয়দাতা, বিদেশে অর্থ পাচারকারী এবং দেশের উন্নয়ন বরাদ্দের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটকে আইনের শক্ত হাতে বাঁধতে পারিনি?
সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান আবারও মনে করিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়, যে কোনো খাতের অনিয়ম-অন্যায়, দুর্নীতি রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল। অকালপ্রয়াত আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, রাজনীতি করলে দুর্নীতি ছাড়ুন। আর দুর্নীতি করলে রাজনীতি ছাড়ুন। সুতরাং কেউ দুর্নীতি কিংবা অপরাধ করে পার পাবে না, সে যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে জয়ী, মাদকের বিরুদ্ধে লড়াকু মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার দুর্নীতিবিরোধী অ্যাকশন তিনি একা নির্লোভ সৎ সাহসী হলেই তো সফল হবে না। সবাইকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করতে হবে। জনগণের ভরসা বিশ্বাসের জয়গায় তো শেখ হাসিনাই। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক রাজনীতির একমাত্র গণমানুষের নেত্রী। বহুবার বলেছি বিশ্বাস থেকে, কাল তিনি ক্ষমতায় না থাকলে দেশ দোজখে পরিণত হবে। এমনিতেই আগের মতোন দেশে গণমুখী রাজনীতিবিদ নেই। আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞ প্রবীণ নেতা যে দু-চার জন বেঁচে আছেন তারাও ক্ষমতার বাইরে, ঘরবন্দী। দলটাও সুসংগঠিত নয়। বাম রাজনীতি শেষ। আদর্শিক তারুণ্যের ছাত্র রাজনীতির যৌবন কবে মরে গেছে। সমাজের চরিত্রও নষ্ট হয়েছে অনেক। এমনকি ১৪ দল থেকে গঠিত মহাজোট নেতাদেরও সংঘবদ্ধভাবে মুজিবকন্যার পাশে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না দুর্যোগে। তাই রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক নেতা ও আদর্শিক কর্মীদের নিয়ে জনগণের সমর্থনেই শক্তি সুসংহত করে চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে হবে। দলের নেতা ও মহাজোট নেতাদের নিয়ে সভা, পরামর্শ, করণীয় নির্ধারণ জরুরি। করোনার যুদ্ধের সঙ্গে জঙ্গিবাদের মতোন দুর্নীতির বিরুদ্ধেও জয় আনতেই হবে। রাজনীতি সমাজ দেশ চোরদের হাতে নয় রাজনীতিবিদদের হাতেই আনতে হবে। রাজনীতিবিদ, এমপি, মন্ত্রীরা যত গাল খাক জনগণকেও খুশি রাখে নেতৃত্বের প্রতিও আনুগত্য রাখে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণকে নয়, বসদের সন্তুষ্ট রাখতেই ব্যস্ত। রাজনীতিবিদ, এমপিদের দুয়ার মানুষের জন্য খোলাই থাকে। সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজ লুটেরারা বিপদে কেটে পড়ে। রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ও সুশাসন দিতে হবে। ভঙ্গুর গণতন্ত্রের দুর্বল সংসদকে বিতর্কে প্রাণবন্ত করতে হবে। এ দেশের ইতিহাসের শিক্ষা গণতন্ত্র ভঙ্গুর হলেও রাজনৈতিক সরকার ও গণতান্ত্রিক শাসনই উত্তম গ্রহণযোগ্য। শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। কিন্তু প্রশ্ন আসে দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দলীয় তদন্ত কখনো হলো না কেন? হাইকমান্ড জানেন না কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের কারা ক্ষমতার রাজনীতিতে দলকে বিক্রি করে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হলো, শানশওকতের জীবন পেল, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া? কারা ১০ বছরে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে আলিশান বাড়ি, অভিজাত ফ্ল্যাট, বিদেশে বাড়ি করেছে?
পাপুলের বউসহ এমপি কেনা থেকে তৃণমূলের পদবাণিজ্যের নেপথ্যে দল বা সরকারের কারা ছিল? পাপিয়া জেলা যুব মহিলা লীগের নেত্রী থেকে ঢাকার তারকা হোটেলে যৌনবাণিজ্য ও দুর্নীতি তদবিরের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ধরা খেয়েছে দৃশ্যপটে আসায়। এসব রাস্তার মক্ষীরানীরা কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এতদূর এলো? পাপিয়া ধরা পড়েছে তাও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। পাপিয়ার শক্তি কারা ছিলেন? পাপিয়ার মতোন দলে নানা রঙে বর্ণে কারা আছেন যাদের স্পর্শ করা যায়নি? নানা পথে দলীয় বাণিজ্যে অঢেল অর্থসম্পদ গড়েছেন? ক্ষমতা ভোগ করছেন? পাপিয়া তো প্রতীক, গ্রাম থেকে আসা নষ্ট রাজনীতির নষ্ট মুখ। দলে এমন নর-নারীর মুখ কত? তার পুরুষ সংস্করণও তো আছে। অভিজাত হোটেলের তিন কামরায় তার প্রসাধনী ও পোশাক নিতেই তিন ট্রাক লাগবে! শতাধিক স্যান্ডেল! বাপরে! রাস্তার নষ্ট কর্মীর এ চরিত্র ফিলিপাইনের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসকের ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মার্কোসের সহস্র জোড়া জুতোর গল্প মনে করিয়ে দেয়! ভোগবিলাসে মত্ত একনায়ক মার্কোসের পতনের পর তার অভিজাত স্ত্রী ইমেলদার সহস্র জোড়া জুতো খবর হয়, এখানে নষ্ট রাজনীতির বাজাইরা বাইজির রাজনৈতিক ক্ষমতার বিলাসের কুৎসিত চিত্র। ফরিদপুরের দুই ভাই আটক, ১০ বছরে ২ হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ। তারা বিএনপি থেকে আসা। ঢাকায় দুই ক্যাসিনো ব্রাদার্সের টাকার খনি দেখেছে দেশ। জি কে শামীমও মির্জা আব্বাসের কর্মী ছিলেন। লোকমানও খালেদা জিয়ার দেহরক্ষী। কারা তাদের দুধকলায় ভাগেজুগে লাভে পুষলেন? অনুপ্রবেশকারী কত বলা হলো! কাকে বের করে দেওয়া হয়েছে? হাওয়া ভবনের টোকাইদের কারা আজ এক দশকে বড় আওয়ামী ঠিকাদার? বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর বজলুল হুদার শ্যালক কীভাবে বিসিবির পরিচালক? রাজনীতি তো বালাখানায় আসা যাওয়া কুৎসিত বিকৃত নর-নারীর কখনো ছিল না! দুর্নীতিবাজদের জন্য ছিল না! আদর্শিক মর্যাদাবান কর্মীবান্ধব গণমুখী নর-নারীর ছিল!
বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শিক চরিত্রের কেউ হবেন আশা করি না, কিন্তু দুর্নীতি লোভ প্রতারণারও তো সীমা আছে! সেটা কই? আমাদের রাজনীতির অতীত কি অহংকার গৌরব মর্যাদার ছিল। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের। আজ? আদর্শবানরা কেন নির্বাসিত? স্বাস্থ্যের মিঠু সাম্রাজ্য গড়েছিল আ ফ ম রুহুল হকের হাতে। আজ ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে কেন! দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অনুসন্ধানের সব তথ্য জনগণ জানতে পারবে। কোনো তথ্যই গোপন থাকবে না। আমরা আশাবাদী সব দুর্নীতিবাজ ও অবৈধ অঢেল অর্থবিত্তের মালিককে আইনের আওতায় আনতে পারবেন। দুদকে অনেক তদন্ত চলছে। কোনো ক্ষমতাবানের হস্তক্ষেপে যেন বন্ধ বা রিপোর্ট বদলে না যায়। কেউ প্রভাব খাটাতে এলে নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন। আইনের চেয়ে অপরাধী দুর্নীতিবাজদের হাত যে লম্বা নয় এবং দুর্নীতি করে রেহাই পাওয়া যায় না, এটা প্রমাণ করেই জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্নীতির বেপরোয়া লাগাম টেনেই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। করোনা ও দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধে গোটা দেশকেই মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার পাশে থাকতে হবে। তিনি জয়ী হলে মানুষ ও দেশ জয়ী হবে। (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন)
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন