ঢাকা ০৭:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত ড. মো. হারুনুর রশীদ পরিচালিত সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া বুধা’ মুক্তি পেয়েছে ভাল মানুষ থেকেইে ভাল মানুষ তৈরী হয়—ঠাকুরগাঁওয়ে আল-হাসানাহ স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরুস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে সাবেক এমপি জাহিদুর রহমান ঠাকুরগাঁয়ে যুবলীগ নেতার পলিথিন কারখানা বন্ধ, মালামাল জব্দ সাগর-রুনি হত্যা মামলা র‌্যাব থেকে তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইয়ের কাছে সংস্কারের পরেই নির্বাচন: ড. ইউনূস বশিরউদ্দীন ও ফারুকীকে কার বুদ্ধিতে নিলেন, প্রশ্ন মান্নার ভূমি সেবায় দুর্নীতি-অনিয়মে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা ভোট কারচুপির তদন্ত সাবেক ডিসি-এসপি-ইউএনওদের ঘুম হারাম আসিফ নজরুলকে হেনস্তা,দূতাবাসের কাউন্সেলরকে দেশে ফেরত, চাকরি হারাচ্ছেন স্টাফ

পঞ্চাশ বছরেও এমন দেখিনি-মতিউর রহমান চৌধুরী

মতিউর রহমান চৌধুরী:: এ কোন্‌ বাংলাদেশ? পঞ্চাশ বছরে তো এমন দেখিনি। তথাকথিত গোপন নথি চুরি করার অভিযোগে একজন সাংবাদিককে গলাটিপে ধরার ঘটনা নজিরবিহীন। তাও তিনি যদি একজন নারী সাংবাদিক হন। রোজিনা ইসলামকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে তা দেখে দেশের মানুষ হতবাক, বিস্মিত। নেটমাধ্যমে যেসব ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে তা দেখে বিবেকবান কোনো মানুষই বিচলিত না হয়ে পারেন না। তাই প্রতিবাদ উঠেছে দেশ-বিদেশে। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে একজন সাংবাদিককে হেনস্তা বা গ্রেপ্তারের ঘটনায় এমন প্রতিবাদ, ধিক্কার আমার পঞ্চাশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে দেখিনি। রাজনীতিতে এমন ঘটনা বিরল নয়।
সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনার অপরাধ কি? বলা হচ্ছে, তিনি নাকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নথি চুরি করার চেষ্টা করছিলেন।স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দাবি, রোজিনা করোনার টিকা নিয়ে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সমপ্রতি স্বাক্ষরিত চুক্তির গোপন নথিপত্র সরানোর চেষ্টা করছিলেন। এ সময় একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন পুলিশ কর্মীর হাতে তিনি ধরা পড়েন। নেটমাধ্যমে দেখা গেল, মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মী কীভাবে রোজিনার গলা টিপে ধরছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেছেন, এসব নথিপত্র প্রকাশ পেলে নাকি রাষ্ট্রের বড় ক্ষতি হয়ে যেত। কি আছে এসব চুক্তিতে, যেটা প্রকাশ করলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়ে যাবে? এটা কি কোনো গোপন চুক্তি? অন্য কোনো দেশে হলে রাষ্ট্র নিজেই প্রকাশ করে দিতো। কী আর বলবো, এই রাষ্ট্রে আলু-পটল চাষের ফাইলেও ‘গোপনীয়’ লেখা থাকে। তর্কের খাতিরে মানলাম, রোজিনা নথি সরাচ্ছিলেন। তাই বলে তাকে মাটিতে ফেলে গলা টিপতে হবে কেন? আইন নিজের হাতে নেয়ার অধিকার তো রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। রাষ্ট্র এতটা অমানবিক হলো কবে? শুনেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যখন এই তাণ্ডব চলছিল তখন ভেতর থেকেই প্রতিবাদ হয়েছে। অনেকেই তখন বলেছেন, এটা ভালো হচ্ছে না। নেটমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো সম্ভবত এসব নীরব প্রতিবাদকারী কোনো একজনের কাজ। কিন্তু কে শুনে কার কথা? দুর্নীতি যাদের নেশা, এই অফিসের পিয়ন-ড্রাইভাররা যেখানে কোটিপতি তারা কি শুনবে? শুনেনি বরং হেনস্তার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। ঘটনা ঘটার ৪০ ঘণ্টা পর একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তাও আবার নিজেরা নিজেরা।
এর আগে দুনিয়া জেনে গেছে- এই বর্বর আচরণের কথা। নিন্দা আর প্রতিবাদে ভারী হয়ে গেছে নেটমাধ্যম। প্রতিবাদ হয়েছে দেশ-বিদেশে। আন্তর্জাতিক এমন কোনো মাধ্যম নেই, যেখানে খবরটি ফলাও করে প্রচার হয়নি। জাতিসংঘেও পৌঁছে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। বিভাজন ভুলে দেশের সাংবাদিকরাও ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। বুদ্ধিজীবীদের আলাদা আলাদা বিবৃতিও সেই বার্তাই দেয়।

দলমতনির্বিশেষে সবাই একবাক্যে বলছেন, রোজিনার মুক্তি চাই। এমনকি শাসক দলের ভেতরেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। নেটমাধ্যমে এমনটা দেখা গেছে। আমি বুঝি না, রোজিনাকে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তার খবর যখন চারদিকে জানাজানি হয়ে গেল তখনো সংশ্লিষ্টরা ঘুমিয়ে ছিলেন কেন? তাকে চিকিৎসা না দিয়ে রিমান্ডে নেয়ার আর্জি দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। যাই হোক, বিচারক এতে সায় দেননি। জামিন দিলে হয়তো সর্বমহলে এমন প্রতিক্রিয়া হতো না। প্রশ্ন উঠেছে- এতে করে কার, কি প্রাপ্তি? সরকারের লাভ-ক্ষতিই বা কি? এক কথায় বলা যায়, সরকার কিছুই পায়নি, নিন্দা ছাড়া। মনে হচ্ছে, হিসেবে বড় গোলমাল হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, একজন রোজিনাকে হেনস্তা করে অন্যদেরকে বার্তা দেয়া। দুর্নীতির খবর লিখতে আসলে এমন পরিণতিই হবে। রাজনীতিতে এমনটা হয়। সাংবাদিকরা এটা মানবেন না বোধ করি সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে পারেননি। এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে গলাটিপে হত্যা করা যায় না। এমনিতেই বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্র ছোট হয়ে আসছে।

অনেকেই বলছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। কেন তিনি পদত্যাগ করবেন? তিনি তো আর একাই এ কাজটি করেননি। তাছাড়া এদেশে পদত্যাগের ঘটনা হাতেগোনা। জিয়াউর রহমানের জমানায় ড. ইকবাল মাহমুদের পদত্যাগের ঘটনা নিজে দেখেছি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুর্নীতির ঢালাও অভিযোগ শুনে ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। অন্যদের জন্য আমি কলঙ্কিত হবো কেন? বুয়েটের এই অধ্যাপক রিকশায় করে বঙ্গভবন থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়েছিলেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি তার সাক্ষাৎকার নেয়ার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। দৈনিক সংবাদ তা প্রচার করেছিল ফলাও করে। বলে রাখি- আমার জীবনে একাধিকবার রিপোর্ট লেখার কারণে জেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় তথ্য প্রকাশ করার কারণে এইভাবে হেনস্তা হতে হয়নি। এক্রিডিটেশন বাতিল হয়েছে তিনবার। দু’টো ঘটনার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।

১৯৭৯ সন। আমি তখন সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার। সচিবালয় বিটে কাজ করতেন সহকর্মী কাশেম হুমায়ন। একদিন আমাকেও সচিবালয় যেতে বললেন প্রয়াত বজলুর রহমান। আমাদের প্রিয় ‘বজলু ভাই’। জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়ে কানাঘুষা চারদিকে। এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান শক্ত অবস্থান নিলেন। মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে শপথ করালেন। কোরআন শরীফ নিয়ে মন্ত্রীরা শপথ করলেন- ঘুষ খাবেন না, তথ্য পাচার করবেন না। এই খবরটা আমার কাছে এলো। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য, কীভাবে নিশ্চিত হবো। সঠিক না হলে তো নিশ্চিত জেলে যেতে হবে। তখন ইত্তেফাকে কাজ করতেন বন্ধু আলমগীর হোসেন। তাকে ফোন করলাম। বললাম, এরকম একটা ঘটনা শুনেছি। খবরটার সত্যতা কতোটুকু তা কি যাচাই করা সম্ভব? আলমগীর হোসেনের সঙ্গে একজন মন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বললেন, দেখা যাক, চেষ্টা করে দেখি। মন্ত্রী ওই রাতেই বিদেশে যাবেন। অপেক্ষায় রয়েছি। এক ঘণ্টা বাদে আলমগীর হোসেন জানালেন, খবরটা সত্য। লিখতে পারেন। বললাম, ঠিক আছে। আপনি কিন্তু লিখবেন না। সে আমলে এতটুকু বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। এখন কারো সঙ্গে কথাই বলা যায় না। যাই হোক, লিখে দিলাম। ভয়ঙ্কর খবর। বজলু ভাই তখন বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে। গভীর রাতে এলেন ক্লাব থেকে। রিপোর্টটি আগেই তার টেবিলে পৌঁছে দিয়েছেন তোজাম্মল আলী। বজলু ভাই লাইন বাই লাইন না পড়ে রিপোর্ট প্রেসে পাঠাতেন না। তাকে ফাঁকি দেয়া খুব কঠিন ছিল। আমাকে ডেকে পাঠালেন। রাত তখন একটা। ঠিক আছে তো! মাথা নাড়তেই বললেন, দেখছি। তার পরদিন পাঁচ কলামে ছাপা হলো। কোরআন শরীফ নিয়ে মন্ত্রীদের শপথ, ঘুষ খাবেন না, তথ্য পাচার করবেন না। সকালে হুলুস্থুল। সচিবালয় যাবো কিনা ভয় পাচ্ছি। প্রেস ক্লাবের আড্ডায় এই রিপোর্টটি তখন মুখ্য আলোচনায়। এরমধ্যে মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর ফোন। দ্রুত অফিসে যেতে হবে। ‘মন্টু দা’ নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। পরে তিনি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। অফিসে পৌঁছামাত্রই সম্পাদক আহমেদুল কবির ডেকে পাঠালেন। তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কিছুটা রাগতস্বরে বললেন, তোমাকে তো গ্রেপ্তার করবে। দাউদ খান মজলিস ফোন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। দাউদ ভাই তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার তথ্য উপদেষ্টা। বঙ্গভবনে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছি। সূত্র জানতে চাইলে কি বলবো? বঙ্গভবনে পৌঁছে দেখি দাউদ খান মজলিস রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বসে আছেন। প্রথম প্রশ্ন- তোমাকে এ খবর দিলো কে? তোমার সূত্র কি? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, রিপোর্টটি সত্য কিনা। সে প্রশ্ন পরে। আগে বলতে হবে, কোন্‌ মন্ত্রী বলেছেন? কি করে বলি, এটা তো আমার পেশার শপথ। জান গেলেও সূত্র প্রকাশ করবো না। দাউদ খান মজলিস নিজেই দীর্ঘকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। বড় মাপের একজন সাংবাদিক। তিনি নিজেও জানেন, আমি সূত্র বলবো না। তিনি পীড়াপীড়ি না করে বললেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব জানতে চেয়েছেন- কে এই খবর প্রকাশ করেছে। তখনই বুঝে গেলাম আমার রিপোর্ট সত্য। সূত্র নিয়েই যত ঝামেলা। দাউদ ভাই বললেন, আজ তুমি যাও। দেখা যাক, কী হয়। অফিসে ফিরে এসে শুনলাম আমার এক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হয়ে গেছে।

পরের ঘটনা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জমানায়। আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক রিপোর্টার। জেনারেল এরশাদ তৃতীয় বারের মতো সেনাপ্রধান হিসেবে এক্সটেনশন নিয়েছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। খবরটা যেভাবেই হোক আমার কাছে আসে। আমি তখন বাসায়। ফোনে খবরটা দিলাম নাজিম উদ্দিন মোস্তানের কাছে। মোস্তান ভাই তখন ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার। তিনি লিখে দিলেন। ছাপা হয়ে গেল প্রথম পাতায়। পরম শ্রদ্ধেয় আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তখন এরশাদের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য। এরশাদ প্রশাসনের ধারণা, এটা বোধহয় তিনি প্রকাশ করেছেন। আসলে তার সঙ্গে ওই রাতে আমার কোনো কথাই হয়নি। কথা হলেও তিনি কিছুই বলতেন না। মঞ্জু ভাইয়ের কাছ থেকে কথা বের করা সহজ নয়। প্রায় ৪৫ বছরের সম্পর্ক। দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি, এখনো দেই। তিনি শুধু শুনেন, বলেন না। সকাল হতে না হতেই বাড়িতে ফোন, অফিসে যেতে হবে। বাতেন ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বললেন, এখনই আপনাকে এনএসআই অফিসে যেতে হবে। আমাকে পৌঁছে দেয়া হলো সেগুনবাগিচায়। জেনারেল আনোয়ার তখন এনএসআই’র মহাপরিচালক। ভদ্রলোক, অত্যন্ত প্রফেশনাল। হাসতে হাসতে বললেন, কি লিখেছেন? প্রেসিডেন্ট সাহেব জানতে চান, কে আপনাকে এই খবর দিয়েছে। বললাম, আপনি তো জানেন সূত্র বলা সম্ভব নয়। জানি, তবুও আমাকে এই প্রশ্ন করতে হবে। জানেন তো প্রশাসন কীভাবে চলে। একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে পারি, মঞ্জু ভাই আমার সূত্র ছিলেন না। জেনারেল হাসলেন। বললেন, এটা আমরা নিশ্চিত। এক ফাঁকে লাল টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে বললেন, রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো আপনার ধারণা অমূলক। এরশাদ কি বললেন শোনা গেল না। জেনারেল আনোয়ার বললেন, ঠিক আছে এবার আপনি আসুন। যথারীতি আমার এক্রিডিটেশন বাতিল হয়ে গেল। সচিবালয় যাওয়া বন্ধ। এখানেই কিন্তু শেষ। কোনো মামলা হয়নি, একারণে জেলেও যেতে হয়নি।

শেষ কথা- রোজিনাকে মুক্তি দিন।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত

পঞ্চাশ বছরেও এমন দেখিনি-মতিউর রহমান চৌধুরী

আপডেট টাইম ১০:৩৫:৫৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ মে ২০২১

মতিউর রহমান চৌধুরী:: এ কোন্‌ বাংলাদেশ? পঞ্চাশ বছরে তো এমন দেখিনি। তথাকথিত গোপন নথি চুরি করার অভিযোগে একজন সাংবাদিককে গলাটিপে ধরার ঘটনা নজিরবিহীন। তাও তিনি যদি একজন নারী সাংবাদিক হন। রোজিনা ইসলামকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে তা দেখে দেশের মানুষ হতবাক, বিস্মিত। নেটমাধ্যমে যেসব ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে তা দেখে বিবেকবান কোনো মানুষই বিচলিত না হয়ে পারেন না। তাই প্রতিবাদ উঠেছে দেশ-বিদেশে। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে একজন সাংবাদিককে হেনস্তা বা গ্রেপ্তারের ঘটনায় এমন প্রতিবাদ, ধিক্কার আমার পঞ্চাশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে দেখিনি। রাজনীতিতে এমন ঘটনা বিরল নয়।
সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনার অপরাধ কি? বলা হচ্ছে, তিনি নাকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নথি চুরি করার চেষ্টা করছিলেন।স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দাবি, রোজিনা করোনার টিকা নিয়ে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সমপ্রতি স্বাক্ষরিত চুক্তির গোপন নথিপত্র সরানোর চেষ্টা করছিলেন। এ সময় একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন পুলিশ কর্মীর হাতে তিনি ধরা পড়েন। নেটমাধ্যমে দেখা গেল, মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মী কীভাবে রোজিনার গলা টিপে ধরছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেছেন, এসব নথিপত্র প্রকাশ পেলে নাকি রাষ্ট্রের বড় ক্ষতি হয়ে যেত। কি আছে এসব চুক্তিতে, যেটা প্রকাশ করলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়ে যাবে? এটা কি কোনো গোপন চুক্তি? অন্য কোনো দেশে হলে রাষ্ট্র নিজেই প্রকাশ করে দিতো। কী আর বলবো, এই রাষ্ট্রে আলু-পটল চাষের ফাইলেও ‘গোপনীয়’ লেখা থাকে। তর্কের খাতিরে মানলাম, রোজিনা নথি সরাচ্ছিলেন। তাই বলে তাকে মাটিতে ফেলে গলা টিপতে হবে কেন? আইন নিজের হাতে নেয়ার অধিকার তো রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। রাষ্ট্র এতটা অমানবিক হলো কবে? শুনেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যখন এই তাণ্ডব চলছিল তখন ভেতর থেকেই প্রতিবাদ হয়েছে। অনেকেই তখন বলেছেন, এটা ভালো হচ্ছে না। নেটমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো সম্ভবত এসব নীরব প্রতিবাদকারী কোনো একজনের কাজ। কিন্তু কে শুনে কার কথা? দুর্নীতি যাদের নেশা, এই অফিসের পিয়ন-ড্রাইভাররা যেখানে কোটিপতি তারা কি শুনবে? শুনেনি বরং হেনস্তার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। ঘটনা ঘটার ৪০ ঘণ্টা পর একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তাও আবার নিজেরা নিজেরা।
এর আগে দুনিয়া জেনে গেছে- এই বর্বর আচরণের কথা। নিন্দা আর প্রতিবাদে ভারী হয়ে গেছে নেটমাধ্যম। প্রতিবাদ হয়েছে দেশ-বিদেশে। আন্তর্জাতিক এমন কোনো মাধ্যম নেই, যেখানে খবরটি ফলাও করে প্রচার হয়নি। জাতিসংঘেও পৌঁছে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। বিভাজন ভুলে দেশের সাংবাদিকরাও ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। বুদ্ধিজীবীদের আলাদা আলাদা বিবৃতিও সেই বার্তাই দেয়।

দলমতনির্বিশেষে সবাই একবাক্যে বলছেন, রোজিনার মুক্তি চাই। এমনকি শাসক দলের ভেতরেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। নেটমাধ্যমে এমনটা দেখা গেছে। আমি বুঝি না, রোজিনাকে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তার খবর যখন চারদিকে জানাজানি হয়ে গেল তখনো সংশ্লিষ্টরা ঘুমিয়ে ছিলেন কেন? তাকে চিকিৎসা না দিয়ে রিমান্ডে নেয়ার আর্জি দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। যাই হোক, বিচারক এতে সায় দেননি। জামিন দিলে হয়তো সর্বমহলে এমন প্রতিক্রিয়া হতো না। প্রশ্ন উঠেছে- এতে করে কার, কি প্রাপ্তি? সরকারের লাভ-ক্ষতিই বা কি? এক কথায় বলা যায়, সরকার কিছুই পায়নি, নিন্দা ছাড়া। মনে হচ্ছে, হিসেবে বড় গোলমাল হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, একজন রোজিনাকে হেনস্তা করে অন্যদেরকে বার্তা দেয়া। দুর্নীতির খবর লিখতে আসলে এমন পরিণতিই হবে। রাজনীতিতে এমনটা হয়। সাংবাদিকরা এটা মানবেন না বোধ করি সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে পারেননি। এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে গলাটিপে হত্যা করা যায় না। এমনিতেই বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্র ছোট হয়ে আসছে।

অনেকেই বলছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। কেন তিনি পদত্যাগ করবেন? তিনি তো আর একাই এ কাজটি করেননি। তাছাড়া এদেশে পদত্যাগের ঘটনা হাতেগোনা। জিয়াউর রহমানের জমানায় ড. ইকবাল মাহমুদের পদত্যাগের ঘটনা নিজে দেখেছি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুর্নীতির ঢালাও অভিযোগ শুনে ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। অন্যদের জন্য আমি কলঙ্কিত হবো কেন? বুয়েটের এই অধ্যাপক রিকশায় করে বঙ্গভবন থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়েছিলেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি তার সাক্ষাৎকার নেয়ার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। দৈনিক সংবাদ তা প্রচার করেছিল ফলাও করে। বলে রাখি- আমার জীবনে একাধিকবার রিপোর্ট লেখার কারণে জেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় তথ্য প্রকাশ করার কারণে এইভাবে হেনস্তা হতে হয়নি। এক্রিডিটেশন বাতিল হয়েছে তিনবার। দু’টো ঘটনার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।

১৯৭৯ সন। আমি তখন সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার। সচিবালয় বিটে কাজ করতেন সহকর্মী কাশেম হুমায়ন। একদিন আমাকেও সচিবালয় যেতে বললেন প্রয়াত বজলুর রহমান। আমাদের প্রিয় ‘বজলু ভাই’। জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়ে কানাঘুষা চারদিকে। এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান শক্ত অবস্থান নিলেন। মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে শপথ করালেন। কোরআন শরীফ নিয়ে মন্ত্রীরা শপথ করলেন- ঘুষ খাবেন না, তথ্য পাচার করবেন না। এই খবরটা আমার কাছে এলো। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য, কীভাবে নিশ্চিত হবো। সঠিক না হলে তো নিশ্চিত জেলে যেতে হবে। তখন ইত্তেফাকে কাজ করতেন বন্ধু আলমগীর হোসেন। তাকে ফোন করলাম। বললাম, এরকম একটা ঘটনা শুনেছি। খবরটার সত্যতা কতোটুকু তা কি যাচাই করা সম্ভব? আলমগীর হোসেনের সঙ্গে একজন মন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বললেন, দেখা যাক, চেষ্টা করে দেখি। মন্ত্রী ওই রাতেই বিদেশে যাবেন। অপেক্ষায় রয়েছি। এক ঘণ্টা বাদে আলমগীর হোসেন জানালেন, খবরটা সত্য। লিখতে পারেন। বললাম, ঠিক আছে। আপনি কিন্তু লিখবেন না। সে আমলে এতটুকু বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। এখন কারো সঙ্গে কথাই বলা যায় না। যাই হোক, লিখে দিলাম। ভয়ঙ্কর খবর। বজলু ভাই তখন বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে। গভীর রাতে এলেন ক্লাব থেকে। রিপোর্টটি আগেই তার টেবিলে পৌঁছে দিয়েছেন তোজাম্মল আলী। বজলু ভাই লাইন বাই লাইন না পড়ে রিপোর্ট প্রেসে পাঠাতেন না। তাকে ফাঁকি দেয়া খুব কঠিন ছিল। আমাকে ডেকে পাঠালেন। রাত তখন একটা। ঠিক আছে তো! মাথা নাড়তেই বললেন, দেখছি। তার পরদিন পাঁচ কলামে ছাপা হলো। কোরআন শরীফ নিয়ে মন্ত্রীদের শপথ, ঘুষ খাবেন না, তথ্য পাচার করবেন না। সকালে হুলুস্থুল। সচিবালয় যাবো কিনা ভয় পাচ্ছি। প্রেস ক্লাবের আড্ডায় এই রিপোর্টটি তখন মুখ্য আলোচনায়। এরমধ্যে মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর ফোন। দ্রুত অফিসে যেতে হবে। ‘মন্টু দা’ নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। পরে তিনি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। অফিসে পৌঁছামাত্রই সম্পাদক আহমেদুল কবির ডেকে পাঠালেন। তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কিছুটা রাগতস্বরে বললেন, তোমাকে তো গ্রেপ্তার করবে। দাউদ খান মজলিস ফোন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। দাউদ ভাই তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার তথ্য উপদেষ্টা। বঙ্গভবনে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছি। সূত্র জানতে চাইলে কি বলবো? বঙ্গভবনে পৌঁছে দেখি দাউদ খান মজলিস রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বসে আছেন। প্রথম প্রশ্ন- তোমাকে এ খবর দিলো কে? তোমার সূত্র কি? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, রিপোর্টটি সত্য কিনা। সে প্রশ্ন পরে। আগে বলতে হবে, কোন্‌ মন্ত্রী বলেছেন? কি করে বলি, এটা তো আমার পেশার শপথ। জান গেলেও সূত্র প্রকাশ করবো না। দাউদ খান মজলিস নিজেই দীর্ঘকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। বড় মাপের একজন সাংবাদিক। তিনি নিজেও জানেন, আমি সূত্র বলবো না। তিনি পীড়াপীড়ি না করে বললেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব জানতে চেয়েছেন- কে এই খবর প্রকাশ করেছে। তখনই বুঝে গেলাম আমার রিপোর্ট সত্য। সূত্র নিয়েই যত ঝামেলা। দাউদ ভাই বললেন, আজ তুমি যাও। দেখা যাক, কী হয়। অফিসে ফিরে এসে শুনলাম আমার এক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হয়ে গেছে।

পরের ঘটনা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জমানায়। আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক রিপোর্টার। জেনারেল এরশাদ তৃতীয় বারের মতো সেনাপ্রধান হিসেবে এক্সটেনশন নিয়েছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। খবরটা যেভাবেই হোক আমার কাছে আসে। আমি তখন বাসায়। ফোনে খবরটা দিলাম নাজিম উদ্দিন মোস্তানের কাছে। মোস্তান ভাই তখন ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার। তিনি লিখে দিলেন। ছাপা হয়ে গেল প্রথম পাতায়। পরম শ্রদ্ধেয় আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তখন এরশাদের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য। এরশাদ প্রশাসনের ধারণা, এটা বোধহয় তিনি প্রকাশ করেছেন। আসলে তার সঙ্গে ওই রাতে আমার কোনো কথাই হয়নি। কথা হলেও তিনি কিছুই বলতেন না। মঞ্জু ভাইয়ের কাছ থেকে কথা বের করা সহজ নয়। প্রায় ৪৫ বছরের সম্পর্ক। দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি, এখনো দেই। তিনি শুধু শুনেন, বলেন না। সকাল হতে না হতেই বাড়িতে ফোন, অফিসে যেতে হবে। বাতেন ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বললেন, এখনই আপনাকে এনএসআই অফিসে যেতে হবে। আমাকে পৌঁছে দেয়া হলো সেগুনবাগিচায়। জেনারেল আনোয়ার তখন এনএসআই’র মহাপরিচালক। ভদ্রলোক, অত্যন্ত প্রফেশনাল। হাসতে হাসতে বললেন, কি লিখেছেন? প্রেসিডেন্ট সাহেব জানতে চান, কে আপনাকে এই খবর দিয়েছে। বললাম, আপনি তো জানেন সূত্র বলা সম্ভব নয়। জানি, তবুও আমাকে এই প্রশ্ন করতে হবে। জানেন তো প্রশাসন কীভাবে চলে। একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে পারি, মঞ্জু ভাই আমার সূত্র ছিলেন না। জেনারেল হাসলেন। বললেন, এটা আমরা নিশ্চিত। এক ফাঁকে লাল টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে বললেন, রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো আপনার ধারণা অমূলক। এরশাদ কি বললেন শোনা গেল না। জেনারেল আনোয়ার বললেন, ঠিক আছে এবার আপনি আসুন। যথারীতি আমার এক্রিডিটেশন বাতিল হয়ে গেল। সচিবালয় যাওয়া বন্ধ। এখানেই কিন্তু শেষ। কোনো মামলা হয়নি, একারণে জেলেও যেতে হয়নি।

শেষ কথা- রোজিনাকে মুক্তি দিন।