ঢাকা ১২:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত ড. মো. হারুনুর রশীদ পরিচালিত সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া বুধা’ মুক্তি পেয়েছে ভাল মানুষ থেকেইে ভাল মানুষ তৈরী হয়—ঠাকুরগাঁওয়ে আল-হাসানাহ স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরুস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে সাবেক এমপি জাহিদুর রহমান ঠাকুরগাঁয়ে যুবলীগ নেতার পলিথিন কারখানা বন্ধ, মালামাল জব্দ সাগর-রুনি হত্যা মামলা র‌্যাব থেকে তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইয়ের কাছে সংস্কারের পরেই নির্বাচন: ড. ইউনূস বশিরউদ্দীন ও ফারুকীকে কার বুদ্ধিতে নিলেন, প্রশ্ন মান্নার ভূমি সেবায় দুর্নীতি-অনিয়মে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা ভোট কারচুপির তদন্ত সাবেক ডিসি-এসপি-ইউএনওদের ঘুম হারাম আসিফ নজরুলকে হেনস্তা,দূতাবাসের কাউন্সেলরকে দেশে ফেরত, চাকরি হারাচ্ছেন স্টাফ

স্মরণে শেখ রাসেল

সুজাত মনসুর::শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। মাত্র এগারো বৎসর বয়সে ঘাতকের গুলিতে জীবন প্রদীপ নিভে যায় পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সন্তান হবার কারণে। ঘাতকরা যখন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে নারকীয় হত্যাকান্ড চালায় তখন রাসেল নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত মোহিতুলের কাছে। ভেবেছিলো যেহেতু সে এখনো শিশু তখন নিশ্চয় ঘাতকরা তাকে হত্যা করবে না। যত নির্মমই হউক, তারা কি জানেনা শিশু হত্যা মহাপাপ? এছাড়া সে তো রাজনীতি করে না। কিন্তু রাসেল ভুল ভেবেছিলো। সে বুঝতে পারেনি এরা সাধারণ ঘাতক নয়। এদের মিশন শুধু এ বাড়ির সদস্যদের হত্যা করা বা ক্ষমতার পালাবদলই নয়। এদের রয়েছে সুদূঢ় প্রসারী পরিকল্পনা। তারা ক্ষমতা বদলের পাশাপাশি গোটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোটাই পাল্টে দিতে চায় চিরতরে। বানাতে চায় পাকিস্তানী আদলে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বদলে দিতে চায় মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন। সুতরাং তাদের কাঙ্খিত পথযাত্রার সামান্য বাধা হতে পারে বা ভবিষ্যতে তাদের সাধিত কর্ম ও পরিকল্পনা চ্যালেঞ্জ করতে পারে কিংবা দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারে তেমন কাউকেই জীবিত রাখা যাবে না। আর সে যদি হয় বঙ্গবন্ধুর সন্তান তাহলে তো কোনভাবেই বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। হউক না সে শিশু কিংবা নারী। ভবিষ্যতে রাজনীতি করবো না, এরকম অঙ্গিকার করার পরও তাই রাসেলও বাঁচতে পারেনি। শত্রুর সামান্যতম অবশেষও অক্ষত রাখতে নেই সেই নীতিই বাস্তবায়ন করেছে তাকে হত্যা করে।

রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ই অক্টোবর, বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। ঐ সময় সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী কায়দে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নার বোন ফাতেমা জিন্নাহ। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় সেদিনও বঙ্গবন্ধু ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারনায় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। সেইদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “রাসেলের জন্মের আগের মুহুর্তেগুলো ছিলো ভীষন উৎকন্ঠার। অমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলে আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হযেছিলো রাসেল।”

বঙ্গবন্ধু দার্শনিক বার্টেন্ড রাসেলের লেখার খুব ভক্ত ছিলেন। যখনই সময় পেতেন বেগম মুজিবকে তাঁর লেখা থেকে পড়ে শোনাতেন। স্বামীর মতো বেগম মুজিবও দার্শনিক রাসেলের একজন ভক্ত হয় যান। তাই তিনি বড় দুই ছেলে কামাল ও জামালের নামের সাথে মিল না থাকা সত্বেও সর্বকনিষ্ঠ সন্তানটির নাম রাখেন রাসেল। রাসেল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রয়াত সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মুসা লিখেছেন, “৩২ নম্বরের বাড়িতে আমার প্রায় দিন সকালে আনাগোনার সময় একদিন সকালে প্রাতরাশ টেবিলে সকৌতুক মন্তব্য করেছিলাম, “মুজিব ভাই বড় দুই ভাইয়ের নাম কামাল-জামাল, এই দুষ্টটির নাম দামাল রাখলেন না কেন?” মুজিব ভাই হেসে বললেন, “তোর ভাবীকে জিজ্ঞেস কর।” ভাবী কিছু বলার আগেই ‘পাগলী মায়ের দামাল ছেলে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আদরের ছেলেটি স্কুলে চলে গেলো অথচ সঙ্গে কোন বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিলো না।

সত্যিকার অর্থেই রাসেল ছিলো পরিবারের সবার আদরের। তার বয়স যখন দুই বৎসরেরও কম তখনই পিতা মুজিবের দীর্ঘস্থায়ী কারাবাসের সুচনা হয়। বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়দফা ঘোষনার পর আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মোকাবেলা করে উনসত্তরের বাইশে ফেব্রæয়ারী নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেন। তাই পিতার আদর সে পায়নিই বলা চলে শিশু বয়সে। পনেরোদিন পর পর দেখা হতো কারাগারে। প্রতিবারই সে কারাগারে বাবার সাথে থেকে যেতে চাইতো। সে মনে করতো জেলখানাই বঙ্গবন্ধুর আসল বাড়ি। শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “রাসেল তো জন্মের পর আব্বাকে বাইরে কমই দেখেছে। ও জেলখানায় গেলে আর ফিরতে চাইতো না। বলতো এটা আব্বুর বাড়ি। আমি আমাদের বাড়িতে যাব না। আসো আমরা আব্বুর বাড়িতেই থাকি। কতই বা বয়স ছিলো তার। তিন বা চার। ওতো বুঝতে না। আমাদের জেল গেট থেকে ফিরে আসতেই হতো। সে রাতে রাসেল আর ঘুমুতে পারতো না। গভীর রাতে সে কাঁদতে শুরু করতো।”

পিতার অভাব মা ও ভাইবোনেরা পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। আদরে আদরে মাতিয়ে রাখতেন আদরের ছোট্ট ভাইটিকে। তবে সে ছিলো বড়বোন শেখ হাসিনার নেউটা। যিনি সবার হাসুবু। শেখ হাসিনাও রাসেলকে নিয়ে মেতে থাকতেন সারাক্ষণ। যেন এ ছিলো তাঁর পুতুল নিয়ে খেলা। যখন হাঁটতে শিখেনি তখন স্কুল বন্ধ থাকলে ওকে পাশে শুইয়ে বই পড়তেন। সে তাঁর চুলের বেণি নিয়ে খেলতো। তিনি লিখে রেখেছেন সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। “ ছোট্ট রাসেল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মা রাসেলকে শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করতেন। স্কুল বন্ধ থাকলে তার পাশে শুয়ে আমি বই পড়তাম। আমার বেণি ধরে খেলতে খুব পছন্দ করতো ও। আমার লম্বা চুলের বেণিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম। ও হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসতো। কারণ নাড়াচাড়ায় মুখে চুল লাগতো তাতে খুব মজা পেত। জন্মের প্রথমদিন থেকেই ওর ছবি তুলতাম। ক্যামেরা আমাদের হাতে থাকতো। কত যে ছবি তুলেছি। ওর জন্য আলাদা একটা অ্যালবাম করেছিলাম, যাতে ওর জন্মের দিন, প্রথম মাস, প্রতি তিনমাস, ছয়মাস অন্তর ছবি অ্যালবামে সাজানো হতো।” সেই অ্যালবামটিও পাক হানাদার বাহিনী বত্রিশ নম্বরের লুট করা জিনিষপত্রের সাথে নিয়ে যায়।

শুধু কি তাই? শেখ হাসিনা রাসেলের কান্না-হাসি-কথাবার্তা একটা টেপ রেকর্ডারে ধারণ করে রাখতেন। পরে তারা ভাইবোন মিলে তা শুনতেন। রাসেলকেও শোনাতেন। শেখ হাসিনার তথ্যমতে রাসেল যখন কান্নাকাটি করতো তখন তিনি তার রেকর্ডকৃত কান্না বাজিয়ে শোনালে সে কান্না থামিয়ে চুপচাপ রেকর্ডকৃত কান্না শুনতো। শেখ হাসিনা আরো লিখেছেন রাসেল নাকি খুবই মেধাবী ছিলো। খুব সহজেই সবকিছু রপ্ত করে ফেলতো। কামাল-জামালকে ভাই বলে সম্মোধন করতো। কনিষ্ঠ বোন শেখ রেহানাকে প্রথম প্রথম দেনা আপা, পরে ডাকতো রেয়না আপা। জেলে বঙ্গবন্ধুর সাথে পারিবারিক দেখা-সাক্ষাতের পর যখন তারা ফিরে আসতেন এবং রাতে রাসেল অসুস্থ্য হয়ে কান্নাকাটি শুরু করতো তখন সে সবাইকে কাছে পেতে চাইতো। এ প্রসঙ্গে শেখ রেহানা উল্লেখ করেছেন, “গভীর রাতে সে কাঁদতে শুরু করতো আর বলতো, হাসু আপাকে ডাকো, দেনা আপাকে ডাকো, বড় ভাইকে ডাকো, ছোট ভাইকে ডাকো। আমরা সবাই ছুটে যেতাম। কি হয়েছে? কোনদিন বলতো পেটে ব্যথা। কোনদিন বলতো হাতে ব্যথা। আসলে আব্বার জন্য মন খারাপ করতো। ঘুমুতে পারতো না।

শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে, রাসেল শিশু বয়স থেকেই সাহসী ও সাবধানী ছিলো। সহসা কোনকিছুতেই ভয় পেতো না। বড় বড় কালো পিপড়া ধরতে পছন্দ করতো। একদিন একটি বেশ বড় কালো পিঁপড়া ধরার সাথে সাথে পিঁপড়াটি কামড় দেয় এবং আঙ্গুল ফুলে যায়। এর থেকে আর সে কালো পিঁপড়া ধরতো না। তবে কালো পিঁপড়ার একটা নাম সে দিয়েছিলো, ‘ভুট্টো’।

পিতা মুজিকে তো রাসেল এমনিতেই খুব কম সময়ই কাছে পেয়েছে। শুধু রাসেল কেনো, স্ত্রী রেণু ও বাকী সন্তানরাই বা কয়দিন তাঁকে কাছে পাবার সুযোগ পেয়েছেন? তাই বঙ্গবন্ধু যখন জেলের বাইরে এবং স্বাধীনতার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে সন্তানরা চেষ্টা করতো বাবার সান্নিধ্যটুকু যতবেশি পারা যায় উপভোগ করে নিতে। রাসেল পুষিয়ে নিতো আরো বেশি, সুদে-আসলে। সে সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতো। জামা-জুতা, হাঁটার ভঙ্গি সবকিছু। এমনকি বঙ্গবন্ধু কোন জুতা বা সেন্ডেল পরে যাবেন তাও বলে দিতো কখনো কখনো। রাসেলের দেনা আপার স্মৃতিচারণে এভাবেই উঠে এসেছে এসব কথা। তিনি লিখেছেন, “রাসেল আব্বাকে জেলখানার বাইরে পেলে কাছ ছাড়া করতে চাইতো না। আব্বার মতো করে কাপড়চোপড় পড়তো। আব্বার মতো পাজামা-পাঞ্জাবী, মুজিব কোট, আব্বার মতো শেরওয়ানী। আবার তার একটা ছোট লুঙ্গিও ছিলো। আব্বার তো সবেেচয়ে প্রিয় পোশাক ছিলো লুঙ্গি ও গেঞ্জি। রাসেলও আব্বাকে অনুকরণ করে পোশাক পরতো। আব্বার মতো করে হঁটাতো। আবার আব্বা হয়তো পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে জুতা পরে বাইরে যাচ্ছেন, রাসেল দৌড়ে গিয়ে সেন্ডেল-শু এনে দিতো। আব্বা বলতেন, কাদা-পানিতে হাঁটতে হবে বাবা। রাসেল বলতো, তাহলে আরেক জোড়া সঙ্গে করে নিয়ে যাও।”

রাসেল যেমন পিতা মুজিবকে এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চাইতো না। তেমনি বঙ্গবন্ধুও রাসেলকে যতটুকু সম্ভব কাছে রাখার চেষ্টা করতেন। প্রধানমন্ত্রী হবার পর বেশিরভাগ সময়ই গণভবন বা সচিবালয় অথবা সংসদ কিংবা বিভিন্ন সরকারী ও দলীয় কর্মসুচিতে অংশ নিতে হতো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সবদিকে নজর রেখে ছুটতে হয়েছে উলকার বেগে। তবুও প্রিয় সন্তানদের সময় দেবার চেষ্টা করতেন, বিশেষ করে আদরের রাসেলকে। বিদেশে কিংবা দেশের অভ্যন্তরে কোথাও গেলে সাথে করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেন। এমনকি গণভবনেও কখনো কখনো নিয়ে যেতেন সাথে করে।

রাসেলের একটা বাইক ছিলো। সারাক্ষণ সে বাড়ির সামনে লন থেকে পেছনের খালি জায়গায় বাইক নিয়ে ঘুরতো। যে কোন সময় পাশেই বড়বোন শেখ হাসিনার বাসা সেখানে চলে যেত বাইক চালিয়ে। সে নিয়ে উৎকন্ঠিত মায়ের কি দুশ্চিন্তা। রাসেল ও তার বাইক সম্পর্কে এবিএম মুসা লিখেছেন, “একদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে একেবারে পপাতধরণীতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি। তারপর সরাসরি প্রশ্ন, ‘ঢ়াচা, আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?’ বললাম, ‘যাইনি, তবে ফেরার পথে ভাবীর সাথে দেখা করে যাবো। অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছেলেটি। মুজিব দম্পতির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, বড় আদরের প্রশ্রয় পাওয়া দুরন্ত রাসেল। ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পুর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা। সেই বাড়িতে দোতালায় থাকতেন শেখ হাসিনা ও ওয়াজেদ মিয়া। এদিকে, ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্ট ছেলেটির সাইকেল পরিক্রমা যেন সীমাবদ্ধ থাকে।

এবিএম মুসা উল্লেখিত সাদা বাড়িটিতে যাবার কারণ প্রিয় হাসুবু ছাড়া ছিলো জয়-পুতুলের সাথে খেলার আনন্দ। জয় রাসেল থেকে প্রায় সাত বছরের ছোট। জয়ের নিকট থেকে খেলনা, বিশেষ করে গাড়ি নেবার জন্য রাসেল ওকে চকলেট দিতো। চকলেট শেষ হয়ে গেলেই জয় গাড়ি ফেরত চাইতো। রাসেলও চকলেট ফেরত চাইতো। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হতো, কান্নাকাটি শুরু হয়ে যেতো। পুতুলকে প্রামে বসিয়ে রাসেল ঠেলে নিয়ে বেড়াতো। পুতুল খুব মজা পেতো। ৩০শে জুলাই, ১৯৭৫ শেখ হাসিনা যখন জার্মানীতে স্বামীর সাথে বসবাসের জন্য জার্মানী চলে যান তখন রেহানা ও রাসেল দু‘জনই যাবার কথা ছিলো। কিন্তু রাসেলের জন্ডিস হবার কারনে বেগম মুজিব তাকে সে সময় বোনদের সাথে যেতে দেননি। রাসেল জয়-পুতুলের সাথে খেলতে পারবে না বলে খুব মন খারপ করেছিলো।

দুর্ভাগ্য বোধহয় একেই বলে। নতুবা কেনই বা ঐ সময় রাসেলের হঠাৎ করে জন্ডিস হয়ে যাবে। যদি সেদিন জন্ডিস না হতো তাহলে সেও বোনদের সাথে জার্মানি চলে যেতো। রেহাই পেতো ঘাতকদের হাত থেকে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যেমন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ১৯৮১ সালে, তেমনি রাসেল বেঁচে থাকলে তিনিই হয়তো শেখ হাসিনা অবসর নেবার পর বড়বোনের রেখে যাওয়া পিতার স্বপ্ন পুরনের বাকী কাজগুলো তিনিই কাঁধে তুলে নিতেন। বাঙালি জাতি পেতো বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনার মতো আরেকজন মুক্তির দুত। জন্মদিনে শেখ রাসেলসহ পনেরো আগষ্টে শহীদ সবার আত্মার শান্তি কামনা করছি। শুভ হোক তোমার জন্মদিন আমাদের সবার প্রিয় শেখ রাসেল।

লেখকঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক-কলামিস্ট suzatmansur@yahoo.com

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত

স্মরণে শেখ রাসেল

আপডেট টাইম ০৩:২২:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০১৯

সুজাত মনসুর::শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। মাত্র এগারো বৎসর বয়সে ঘাতকের গুলিতে জীবন প্রদীপ নিভে যায় পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সন্তান হবার কারণে। ঘাতকরা যখন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে নারকীয় হত্যাকান্ড চালায় তখন রাসেল নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত মোহিতুলের কাছে। ভেবেছিলো যেহেতু সে এখনো শিশু তখন নিশ্চয় ঘাতকরা তাকে হত্যা করবে না। যত নির্মমই হউক, তারা কি জানেনা শিশু হত্যা মহাপাপ? এছাড়া সে তো রাজনীতি করে না। কিন্তু রাসেল ভুল ভেবেছিলো। সে বুঝতে পারেনি এরা সাধারণ ঘাতক নয়। এদের মিশন শুধু এ বাড়ির সদস্যদের হত্যা করা বা ক্ষমতার পালাবদলই নয়। এদের রয়েছে সুদূঢ় প্রসারী পরিকল্পনা। তারা ক্ষমতা বদলের পাশাপাশি গোটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোটাই পাল্টে দিতে চায় চিরতরে। বানাতে চায় পাকিস্তানী আদলে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বদলে দিতে চায় মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন। সুতরাং তাদের কাঙ্খিত পথযাত্রার সামান্য বাধা হতে পারে বা ভবিষ্যতে তাদের সাধিত কর্ম ও পরিকল্পনা চ্যালেঞ্জ করতে পারে কিংবা দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারে তেমন কাউকেই জীবিত রাখা যাবে না। আর সে যদি হয় বঙ্গবন্ধুর সন্তান তাহলে তো কোনভাবেই বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। হউক না সে শিশু কিংবা নারী। ভবিষ্যতে রাজনীতি করবো না, এরকম অঙ্গিকার করার পরও তাই রাসেলও বাঁচতে পারেনি। শত্রুর সামান্যতম অবশেষও অক্ষত রাখতে নেই সেই নীতিই বাস্তবায়ন করেছে তাকে হত্যা করে।

রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ই অক্টোবর, বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। ঐ সময় সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী কায়দে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নার বোন ফাতেমা জিন্নাহ। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় সেদিনও বঙ্গবন্ধু ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারনায় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। সেইদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “রাসেলের জন্মের আগের মুহুর্তেগুলো ছিলো ভীষন উৎকন্ঠার। অমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলে আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হযেছিলো রাসেল।”

বঙ্গবন্ধু দার্শনিক বার্টেন্ড রাসেলের লেখার খুব ভক্ত ছিলেন। যখনই সময় পেতেন বেগম মুজিবকে তাঁর লেখা থেকে পড়ে শোনাতেন। স্বামীর মতো বেগম মুজিবও দার্শনিক রাসেলের একজন ভক্ত হয় যান। তাই তিনি বড় দুই ছেলে কামাল ও জামালের নামের সাথে মিল না থাকা সত্বেও সর্বকনিষ্ঠ সন্তানটির নাম রাখেন রাসেল। রাসেল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রয়াত সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মুসা লিখেছেন, “৩২ নম্বরের বাড়িতে আমার প্রায় দিন সকালে আনাগোনার সময় একদিন সকালে প্রাতরাশ টেবিলে সকৌতুক মন্তব্য করেছিলাম, “মুজিব ভাই বড় দুই ভাইয়ের নাম কামাল-জামাল, এই দুষ্টটির নাম দামাল রাখলেন না কেন?” মুজিব ভাই হেসে বললেন, “তোর ভাবীকে জিজ্ঞেস কর।” ভাবী কিছু বলার আগেই ‘পাগলী মায়ের দামাল ছেলে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আদরের ছেলেটি স্কুলে চলে গেলো অথচ সঙ্গে কোন বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিলো না।

সত্যিকার অর্থেই রাসেল ছিলো পরিবারের সবার আদরের। তার বয়স যখন দুই বৎসরেরও কম তখনই পিতা মুজিবের দীর্ঘস্থায়ী কারাবাসের সুচনা হয়। বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়দফা ঘোষনার পর আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মোকাবেলা করে উনসত্তরের বাইশে ফেব্রæয়ারী নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেন। তাই পিতার আদর সে পায়নিই বলা চলে শিশু বয়সে। পনেরোদিন পর পর দেখা হতো কারাগারে। প্রতিবারই সে কারাগারে বাবার সাথে থেকে যেতে চাইতো। সে মনে করতো জেলখানাই বঙ্গবন্ধুর আসল বাড়ি। শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “রাসেল তো জন্মের পর আব্বাকে বাইরে কমই দেখেছে। ও জেলখানায় গেলে আর ফিরতে চাইতো না। বলতো এটা আব্বুর বাড়ি। আমি আমাদের বাড়িতে যাব না। আসো আমরা আব্বুর বাড়িতেই থাকি। কতই বা বয়স ছিলো তার। তিন বা চার। ওতো বুঝতে না। আমাদের জেল গেট থেকে ফিরে আসতেই হতো। সে রাতে রাসেল আর ঘুমুতে পারতো না। গভীর রাতে সে কাঁদতে শুরু করতো।”

পিতার অভাব মা ও ভাইবোনেরা পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। আদরে আদরে মাতিয়ে রাখতেন আদরের ছোট্ট ভাইটিকে। তবে সে ছিলো বড়বোন শেখ হাসিনার নেউটা। যিনি সবার হাসুবু। শেখ হাসিনাও রাসেলকে নিয়ে মেতে থাকতেন সারাক্ষণ। যেন এ ছিলো তাঁর পুতুল নিয়ে খেলা। যখন হাঁটতে শিখেনি তখন স্কুল বন্ধ থাকলে ওকে পাশে শুইয়ে বই পড়তেন। সে তাঁর চুলের বেণি নিয়ে খেলতো। তিনি লিখে রেখেছেন সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। “ ছোট্ট রাসেল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মা রাসেলকে শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করতেন। স্কুল বন্ধ থাকলে তার পাশে শুয়ে আমি বই পড়তাম। আমার বেণি ধরে খেলতে খুব পছন্দ করতো ও। আমার লম্বা চুলের বেণিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম। ও হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসতো। কারণ নাড়াচাড়ায় মুখে চুল লাগতো তাতে খুব মজা পেত। জন্মের প্রথমদিন থেকেই ওর ছবি তুলতাম। ক্যামেরা আমাদের হাতে থাকতো। কত যে ছবি তুলেছি। ওর জন্য আলাদা একটা অ্যালবাম করেছিলাম, যাতে ওর জন্মের দিন, প্রথম মাস, প্রতি তিনমাস, ছয়মাস অন্তর ছবি অ্যালবামে সাজানো হতো।” সেই অ্যালবামটিও পাক হানাদার বাহিনী বত্রিশ নম্বরের লুট করা জিনিষপত্রের সাথে নিয়ে যায়।

শুধু কি তাই? শেখ হাসিনা রাসেলের কান্না-হাসি-কথাবার্তা একটা টেপ রেকর্ডারে ধারণ করে রাখতেন। পরে তারা ভাইবোন মিলে তা শুনতেন। রাসেলকেও শোনাতেন। শেখ হাসিনার তথ্যমতে রাসেল যখন কান্নাকাটি করতো তখন তিনি তার রেকর্ডকৃত কান্না বাজিয়ে শোনালে সে কান্না থামিয়ে চুপচাপ রেকর্ডকৃত কান্না শুনতো। শেখ হাসিনা আরো লিখেছেন রাসেল নাকি খুবই মেধাবী ছিলো। খুব সহজেই সবকিছু রপ্ত করে ফেলতো। কামাল-জামালকে ভাই বলে সম্মোধন করতো। কনিষ্ঠ বোন শেখ রেহানাকে প্রথম প্রথম দেনা আপা, পরে ডাকতো রেয়না আপা। জেলে বঙ্গবন্ধুর সাথে পারিবারিক দেখা-সাক্ষাতের পর যখন তারা ফিরে আসতেন এবং রাতে রাসেল অসুস্থ্য হয়ে কান্নাকাটি শুরু করতো তখন সে সবাইকে কাছে পেতে চাইতো। এ প্রসঙ্গে শেখ রেহানা উল্লেখ করেছেন, “গভীর রাতে সে কাঁদতে শুরু করতো আর বলতো, হাসু আপাকে ডাকো, দেনা আপাকে ডাকো, বড় ভাইকে ডাকো, ছোট ভাইকে ডাকো। আমরা সবাই ছুটে যেতাম। কি হয়েছে? কোনদিন বলতো পেটে ব্যথা। কোনদিন বলতো হাতে ব্যথা। আসলে আব্বার জন্য মন খারাপ করতো। ঘুমুতে পারতো না।

শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে, রাসেল শিশু বয়স থেকেই সাহসী ও সাবধানী ছিলো। সহসা কোনকিছুতেই ভয় পেতো না। বড় বড় কালো পিপড়া ধরতে পছন্দ করতো। একদিন একটি বেশ বড় কালো পিঁপড়া ধরার সাথে সাথে পিঁপড়াটি কামড় দেয় এবং আঙ্গুল ফুলে যায়। এর থেকে আর সে কালো পিঁপড়া ধরতো না। তবে কালো পিঁপড়ার একটা নাম সে দিয়েছিলো, ‘ভুট্টো’।

পিতা মুজিকে তো রাসেল এমনিতেই খুব কম সময়ই কাছে পেয়েছে। শুধু রাসেল কেনো, স্ত্রী রেণু ও বাকী সন্তানরাই বা কয়দিন তাঁকে কাছে পাবার সুযোগ পেয়েছেন? তাই বঙ্গবন্ধু যখন জেলের বাইরে এবং স্বাধীনতার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে সন্তানরা চেষ্টা করতো বাবার সান্নিধ্যটুকু যতবেশি পারা যায় উপভোগ করে নিতে। রাসেল পুষিয়ে নিতো আরো বেশি, সুদে-আসলে। সে সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতো। জামা-জুতা, হাঁটার ভঙ্গি সবকিছু। এমনকি বঙ্গবন্ধু কোন জুতা বা সেন্ডেল পরে যাবেন তাও বলে দিতো কখনো কখনো। রাসেলের দেনা আপার স্মৃতিচারণে এভাবেই উঠে এসেছে এসব কথা। তিনি লিখেছেন, “রাসেল আব্বাকে জেলখানার বাইরে পেলে কাছ ছাড়া করতে চাইতো না। আব্বার মতো করে কাপড়চোপড় পড়তো। আব্বার মতো পাজামা-পাঞ্জাবী, মুজিব কোট, আব্বার মতো শেরওয়ানী। আবার তার একটা ছোট লুঙ্গিও ছিলো। আব্বার তো সবেেচয়ে প্রিয় পোশাক ছিলো লুঙ্গি ও গেঞ্জি। রাসেলও আব্বাকে অনুকরণ করে পোশাক পরতো। আব্বার মতো করে হঁটাতো। আবার আব্বা হয়তো পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে জুতা পরে বাইরে যাচ্ছেন, রাসেল দৌড়ে গিয়ে সেন্ডেল-শু এনে দিতো। আব্বা বলতেন, কাদা-পানিতে হাঁটতে হবে বাবা। রাসেল বলতো, তাহলে আরেক জোড়া সঙ্গে করে নিয়ে যাও।”

রাসেল যেমন পিতা মুজিবকে এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চাইতো না। তেমনি বঙ্গবন্ধুও রাসেলকে যতটুকু সম্ভব কাছে রাখার চেষ্টা করতেন। প্রধানমন্ত্রী হবার পর বেশিরভাগ সময়ই গণভবন বা সচিবালয় অথবা সংসদ কিংবা বিভিন্ন সরকারী ও দলীয় কর্মসুচিতে অংশ নিতে হতো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সবদিকে নজর রেখে ছুটতে হয়েছে উলকার বেগে। তবুও প্রিয় সন্তানদের সময় দেবার চেষ্টা করতেন, বিশেষ করে আদরের রাসেলকে। বিদেশে কিংবা দেশের অভ্যন্তরে কোথাও গেলে সাথে করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেন। এমনকি গণভবনেও কখনো কখনো নিয়ে যেতেন সাথে করে।

রাসেলের একটা বাইক ছিলো। সারাক্ষণ সে বাড়ির সামনে লন থেকে পেছনের খালি জায়গায় বাইক নিয়ে ঘুরতো। যে কোন সময় পাশেই বড়বোন শেখ হাসিনার বাসা সেখানে চলে যেত বাইক চালিয়ে। সে নিয়ে উৎকন্ঠিত মায়ের কি দুশ্চিন্তা। রাসেল ও তার বাইক সম্পর্কে এবিএম মুসা লিখেছেন, “একদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে একেবারে পপাতধরণীতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি। তারপর সরাসরি প্রশ্ন, ‘ঢ়াচা, আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?’ বললাম, ‘যাইনি, তবে ফেরার পথে ভাবীর সাথে দেখা করে যাবো। অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছেলেটি। মুজিব দম্পতির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, বড় আদরের প্রশ্রয় পাওয়া দুরন্ত রাসেল। ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পুর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা। সেই বাড়িতে দোতালায় থাকতেন শেখ হাসিনা ও ওয়াজেদ মিয়া। এদিকে, ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্ট ছেলেটির সাইকেল পরিক্রমা যেন সীমাবদ্ধ থাকে।

এবিএম মুসা উল্লেখিত সাদা বাড়িটিতে যাবার কারণ প্রিয় হাসুবু ছাড়া ছিলো জয়-পুতুলের সাথে খেলার আনন্দ। জয় রাসেল থেকে প্রায় সাত বছরের ছোট। জয়ের নিকট থেকে খেলনা, বিশেষ করে গাড়ি নেবার জন্য রাসেল ওকে চকলেট দিতো। চকলেট শেষ হয়ে গেলেই জয় গাড়ি ফেরত চাইতো। রাসেলও চকলেট ফেরত চাইতো। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হতো, কান্নাকাটি শুরু হয়ে যেতো। পুতুলকে প্রামে বসিয়ে রাসেল ঠেলে নিয়ে বেড়াতো। পুতুল খুব মজা পেতো। ৩০শে জুলাই, ১৯৭৫ শেখ হাসিনা যখন জার্মানীতে স্বামীর সাথে বসবাসের জন্য জার্মানী চলে যান তখন রেহানা ও রাসেল দু‘জনই যাবার কথা ছিলো। কিন্তু রাসেলের জন্ডিস হবার কারনে বেগম মুজিব তাকে সে সময় বোনদের সাথে যেতে দেননি। রাসেল জয়-পুতুলের সাথে খেলতে পারবে না বলে খুব মন খারপ করেছিলো।

দুর্ভাগ্য বোধহয় একেই বলে। নতুবা কেনই বা ঐ সময় রাসেলের হঠাৎ করে জন্ডিস হয়ে যাবে। যদি সেদিন জন্ডিস না হতো তাহলে সেও বোনদের সাথে জার্মানি চলে যেতো। রেহাই পেতো ঘাতকদের হাত থেকে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যেমন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ১৯৮১ সালে, তেমনি রাসেল বেঁচে থাকলে তিনিই হয়তো শেখ হাসিনা অবসর নেবার পর বড়বোনের রেখে যাওয়া পিতার স্বপ্ন পুরনের বাকী কাজগুলো তিনিই কাঁধে তুলে নিতেন। বাঙালি জাতি পেতো বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনার মতো আরেকজন মুক্তির দুত। জন্মদিনে শেখ রাসেলসহ পনেরো আগষ্টে শহীদ সবার আত্মার শান্তি কামনা করছি। শুভ হোক তোমার জন্মদিন আমাদের সবার প্রিয় শেখ রাসেল।

লেখকঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক-কলামিস্ট suzatmansur@yahoo.com