ঢাকা ১০:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেননের আর্তনাদ ও মান্নার কান্না থামে না

পীর হাবিবুর রহমান::বামপন্থি রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন রয়েছে। রাজনীতিতে তিনি এক দিনে তৈরি হননি। এটি যেমন সত্য, তেমনি রাজনীতিবিদদের জন্য প্রতিনিয়ত জনগণের কাছে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করে অগ্রসর হতে হয়। রাজনীতিবিদদের নিয়ে সমালোচনা যেমন থাকে, তেমনি সাফল্যের গৌরবও থাকে। জগদ্বিখ্যাত মহান রাজনৈতিক নেতা বা শাসকরা যুগে যুগে যেমন নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, মহানায়ক হিসেবে ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছেন, তেমনি সমালোচনার তীরেও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থি বা সমাজতন্ত্রীদের বিশ্বরাজনীতির হাওয়ায় যখন সুবর্ণ সময় বা সুবাতাস বইছিল তখনো তারা সমাজতন্ত্রের বিপ্লব ঘটাতে বা গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় আসতে যেমন ব্যর্থ হয়েছেন তেমনি নিজেরা বার বার ভাঙনের মুখে পতিত হয়েছেন। একই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব তিন দশক বামফ্রন্ট শাসন করেছে, সেখানে বাংলাদেশে বামপন্থিরা দাঁড়াতেই পারেনি। এ দেশের অধিকাংশ চীনা বাম সামরিক শাসকদের হাত ধরে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ভোগ করেছেন বা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। অন্যদিকে মস্কোপন্থি ন্যাপ কমিউনিস্ট আজীবন নৌকায় চড়ে সংসদে এসেছেন। অন্যের করুণাশ্রিত ছাড়া তারা যত বড় নেতাই হোন না কেন, ভোটের ময়দানে বার বার প্রমাণ করেছেন- না আছে সাংগঠনিক শক্তি, না আছে নিজেদের জনসমর্থন। মাঝেমধ্যে এক-দুজন বামপন্থি নিজেদের প্রতীক নিয়ে এককভাবে বিজয়ী হয়ে সংসদে এসে চমক সৃষ্টি করেছেন। যোগ্যতায়, মেধায় তারা অনন্য হলেও জনসমর্থনে ব্যর্থ ছিলেন।

নিভে যাওয়া বামপন্থিদের আদর্শিক একটি অংশ এখনো করুণাশ্রিত, পরনর্ভির ক্ষমতার পথ পরিহার করে তোপখানা রোড থেকে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত তাদের আদর্শের নিবুনিবু বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন।

রাশেদ খান মেনন সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সাজানো নির্বাচনে বা ’৭৯ সালের প্রহসনের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে এসেছিলেন তার বরিশালের বাবুগঞ্জের নির্বাচনী এলাকা থেকে। ’৯১ সালের নির্বাচনে সর্বহারাদের সমর্থনে বিজয়ী হয়ে এসে অদৃশ্য ঘাতকের বুলেটে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন। তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদে গোটা দেশ শোকাগ্রস্ত ও বিষাদগ্রস্ত হয়েছিল। গুপ্ত ঘাতকের এই হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব বিরোধী দল যখন পঞ্চম সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ওয়াক-আউট, বর্জন, পদত্যাগ ও গণআন্দোলনে রাজপথে নামল, রাশেদ খান মেনন তখন নিরাপদ দূরত্ব রেখে চললেন।

বিএনপি-জামায়াত শাসনামল যখন দুর্নীতি, বিরোধী দল দমন, পাপাচার, জঙ্গি, সন্ত্রাস, গ্রেনেড, বোমা ও রাজনৈতিক হত্যাকাে অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল, তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বা নির্দেশে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলসহ দলের শীর্ষ নেতারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছোট-বড় প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে ১৪ দল গঠন করেছিলেন, তখন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনু অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন। সেই ঐক্যের পথে পরবর্তীতে এরশাদের জাতীয় পার্টি বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা বি. চৌধুরী ও কর্নেল অলি আহমদের দল নিয়ে মহাজোট গঠিত হয়। বিএনপি-জামায়াত শাসকদের জন্য সেই মহাজোট নির্বাচন সামনে রেখে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বিভিন্ন জনমত জরিপের হাওয়া বইছিল বিএনপি-জামায়াতবিরোধী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শক্তির অনুকূলে। একটি পরিবর্তনের পূর্বাভাস রাজনৈতিক আবহাওয়াবিদরা দিতে না দিতেই বিএনপি-জামায়াত সরকার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পথে নির্বাচনে জয়লাভ করার কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। আর এদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের অনেক প্রস্তাব দিয়ে ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার বাতিল করে নতুন ভোটার তালিকা ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের দাবিতে অনড় হয়েছিল। বিতর্কের মুখে বিচারপতি কে এম হাসান সরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বিএনপির রাজনীতির সব নীলনকশার রিমোট কন্ট্রোল তাদের রাজনীতির অভিশপ্ত হাওয়া ভবনে স্থাপন করা হয়েছিল। সব সংলাপ-আলোচনা, সমঝোতা ব্যর্থ করে দিয়ে তাদের পুতুল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও একই সঙ্গে সংবিধানের দোহাই দিয়ে করেছিল। অন্যদিকে গোপাল ভাঁড় মার্কা বিচারপতি আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তিন স্তরবিশিষ্ট প্রশাসন দলীয়করণের প্রাচীর তৈরি করে ক্ষমতায় আসার নীলনকশা চূড়ান্ত করেছিল। সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যক্তিত্ববান, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন চারজন উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, লে. জে. হাসান মশহুদ চৌধূরী, সি এম শফি সামি ও অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল হাওয়া ভবনের রিমোট কন্ট্রোলে বঙ্গভবনের নির্লজ্জ নাটকের প্রতিবাদে পদত্যাগ করে জনগণের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শেখ হাসিনাও সেদিন নির্বাচন ও আন্দোলনের দরজা খোলা রেখেই কঠিন রণকৌশল নিয়েছিলেন। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করে মহাজোট পরে একযোগে প্রত্যাহার করে নেয়। গোটা দেশের জনজীবন অচল হয়েই পড়েনি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকা , প্রশাসনিক কর্মকা অচল হয়েই যায়নি, সংঘাত, সংঘর্ষে রাজপথ সহিংস ও রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার জন্য বেপরোয়া পথটিই গ্রহণ করেছিল।

বিদেশি কূটনীতিকরা তৎপর হয়ে উঠলেন। দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে ক্ষমতা গ্রহণ না করলেও ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখে ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করলে গোটা দেশের জনজীবনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে আসে। বিএনপি ছাড়া সব রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণ, সিভিল সোসাইটি আর গণমাধ্যম অভিন্ন সুরে ওয়ান-ইলেভেন সরকারকে স্বাগত জানায়। সেদিন সেনাবাহিনী ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার বাতিল করে এ টি এম শামসুল হুদার মতো দক্ষ, গ্রহণযোগ্য, ব্যক্তিত্ববান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা করলেও সেনাসমর্থিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি অপরিকল্পিতভাবে গণপাকড়াও অভিযান, দেশের ব্যবসায়ীদের গণহারে হয় দেশছাড়া নয় কারাবরণের হঠকারী নীতি গ্রহণ করে যে জনপ্রিয়তা নিয়ে যাত্রা করেছিল, সেখানে ধস নামিয়ে দেয়। রাজনৈতিকসহ নানা সংস্কার ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান দিয়ে মানুষের মধ্যে যে স্বপ্ন তৈরি করেছিল, তাতে মানুষ সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু তাদের ভ্রান্তনীতি ও সবাইকে স্পর্শ করায় জনসমর্থন দূরে সরে যায়। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের দিন টানাহেঁচড়া করে কারাগারে নেওয়ার দৃশ্য যেমন মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের বিদ্রোহ তাদের শক্তিকে শেষ করে দেয়। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে অপমানের নীতি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তারা অনেক ভালো কাজ করলেও বড় ভুলের জন্য জনসমর্থন হারিয়ে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেয়।

বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনকালে আমি তখন রাজনৈতিক বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে যুগান্তরে কাজ করি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নেতাদের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ। প্রায় নিয়মিত আমার লিড রিপোর্ট ছাপা হচ্ছিল, একদিন বিএনপি সরকারের দ্রব্যমূল্যসহ নানা অপশাসনের চিত্রপট তুলে ধরা রিপোর্ট পাঠ করে আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসভবন থেকে অকালপ্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের টেলিফোনে এইচ টি ইমাম আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাকে বলেছিলাম, আপনাদের কাজ আপনারা করুন। আমার কাজ আমাকে করতে দিন।

আমার ছাত্র রাজনীতি ও পেশাদারিত্বের জীবনে কোনো অপরাধ আমি কখনো করিনি। কোনো সরকারের কাছ থেকেও কখনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিনি। আমার জীবন সংগ্রামের উত্থান-পতনের এবং উজানে সাঁতার কাটার। অন্তহীন দহন সয়েছি। অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। কিন্তু সেনাশাসন জমানায় গণতন্ত্রের জন্য জেল খাটা একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সেনাশাসন-উত্তর গণতন্ত্রের দীর্ঘ যাত্রাপথে যখন আমাদের স্বপ্ন পূরণ হতে দেখিনি, ইবাদতের মতোন পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করে দিনে দিনে দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা রাজদুর্নীতির যুগে দেশকে প্রবেশ করতে দেখেছি তখন মন কেবল আর্তনাদ করেছে। অহরহ করে। দ্রোহ করে।

যাক রাশেদ খান মেনন দিয়ে শুরু করেছিলাম। মোজাফ্ফর হোসেন পল্টুর মতো নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতি অন্ধ, অনুগত যেখানে মনোনয়ন পান না, সেখানে ওয়ান-ইলেভেনের চ্যালেঞ্জ জয় করে বিশাল গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার নৌকায় চড়ে মতিঝিল থেকে রাশেদ খান মেনন সংসদে এসেছিলেন। ’৯৬ সালে তার বাবুগঞ্জের আসনে করুণ পরাজয় ঘটেছিল। ২০০৮ সালে বিএনপি বর্জন বা ওয়াকওভার দিলেও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপির প্রার্থী আবদুর রহিমকে সরিয়ে তাকে সংসদে আনতে হয়েছে। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেছেন, মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মন্ত্রিত্ব তিনি প্রত্যাখ্যান করেননি। মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজনীতির কিংবদন্তি তোফায়েল আহমেদ। আর মেনন মন্ত্রিত্ব নিতে পারেননি তোফায়েল প্রত্যাখ্যান করায়, অন্যদিকে তার পার্টির বাধার কারণে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সংসদে এসে তিনি মন্ত্রিত্ব নিয়েছেন। এবার মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার দশ মাস পর এসে যখন বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে কেউ ভোটে নির্বাচিত হতে পারেননি এবং জনগণ ভোট দিতে পারেনি ততক্ষণে তিনি শেখ হাসিনার অনুকম্পায় তার স্ত্রীকেও এমপি বানিয়েছেন। তার নির্বাচনী এলাকার ক্যাসিনো-বাণিজ্যের কালো টাকা বিতর্ক যখন তাকে স্পর্শ করেছে এর আগে যখন এমপি হয়ে স্কুলের ভর্তি-বাণিজ্যও তাকে বিতর্কিত করেছিল। সেসব কথা বাদ দিলেও এ ধরনের অভিযোগ তিনি তখনই করতে পারেন, যখন তিনি নৈতিক দায় থেকে স্ত্রীসহ পদত্যাগ করবেন। এখন তার বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিলে তার পদত্যাগ করা উচিত। আর না হয় এ আর্তনাদের স্বপক্ষে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া উচিত।

এদিকে সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয়নি। আমার পছন্দের মানুষ সৃজনশীল, আড্ডাবাজ, পড়াশোনা জানা মান্না যখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, তখন একবার বলেছিলাম, আহমদ ছফা নেই। রাজনীতি ছেড়ে নির্মোহ চিত্তে লেখালেখি করুন। তিনি বলেছিলেন, দেশে আছেই রাজনীতি, তাই রাজনীতি করি। বাড়ি বগুড়ায়, তাহলে বিএনপি করলেন না কেন? মান্না বলেছিলেন, শেখ হাসিনা আমাকে বোঝেন। আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা আছে। তাই এ দলটি করি। আজ মান্না যে কথা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, আওয়ামী ও মুজিববিদ্বেষী একদল বিকৃত, আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত রাজনীতিবিদ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় সেই তারা যে কথা বলতেন, তার প্রতিধ্বনি করছেন। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার আওয়ামী লীগই গঠন করেছে। এসব সত্য নির্লজ্জ মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বলতেও লজ্জা হয়। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছিলেন, আওয়ামী লীগে এসে মান্না লিখেন না। জুড়ে দেন কান্না। বিভ্রান্ত মান্নার কান্না থামছে না। ব্যক্তিগত আক্রোশ, ব্যর্থতার গ্লানি ও প্রতিহিংসা যে অনেককে শেষ করে দেয়, দেউলিয়া রাজনীতিবিদদের দিকে তাকালে সেটি দেখা যায়।

আমার কোমল হৃদয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বপ্ন আজন্মের মতোন লালন করে এই পেশায় আমি মানিক মিয়া হতে এসেছিলাম। আমি মানিক মিয়া হতে পারিনি। শাসনব্যবস্থা, গণমাধ্যম, সংস্কৃতি, সময় এবং বাস্তবতা আমাকে হতে দেয়নি। এই যন্ত্রণা আমার একার। এটা আমি একাই ভোগ করি, কাউকে বুঝতে দিইনি, অনেক কিছু থেকে এমনকি কত আড্ডা, সামাজিকতা থেকেও নিজেকে দূরে রাখি। আমৃত্যু এ বেদনা বইতে হবে আমাকে। সুবিধাবাদী আদর্শহীন সমাজে আমি বঙ্গবন্ধুকে কোথাও পাই না। নষ্টদের উল্লাস দেখি। স্বার্থপরদের বেপরোয়া নির্লজ্জ উন্মাদনা দেখি। খাই খাই লালসা দেখি। প্রেমিক দেখি না, প্রেম ভালোবাসা, নির্লোভ, মায়া-মমতা দেখি না। দেখি কেবল লোভ আর লাভের হিসাবের কণা। তবু মানুষ আছে, মানুষ নদী, প্রকৃতি, পাহাড়, বৃষ্টি, জোছনা ও ফুল পাখি বঙ্গবন্ধু আছে বলেই বেঁচে আছি। স্বপ্ন দেখি বুক ভরে শ্বাস নিই। যারা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাস করে তারা সমাজ ও মানবতার শত্রু। যারা রসরাজের মতো সহজ-সরল, মূর্খ হিন্দুর নামে অপপ্রচার চালিয়ে ধর্মের নামে দাঙ্গা বাধায়, যারা ভোলায় একজন হিন্দুর ফেসবুক হ্যাক করে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে মাঠে নামে তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষধর সাপমাত্র। যে বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে অভিশপ্ত শাসনামল দিয়েছে, যারা এখনো নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনায় ভোগে না এবং নিজেদের পাপাচারের জন্য, অপরাধের জন্য লজ্জিত হয় না। কারাবন্দী গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন না করে, বিতর্কিত নির্বাসিত দি ত তারেক রহমানের বন্দনা করে, তাদের হাজার হাজার দেশপ্রেমিক গণমুখী নেতা-কর্মী থাকলেও নেতৃত্বের ভ্রান্ত নীতি-আদর্শ ও ভুলের কারণে তারা কখনো বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।

মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ৩৯ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামে বার বার মৃত্যুকে জয় করে ফিরে এসে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করে খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। আন্তর্জাতিক আদালতের মামলায় জিতে আরেক বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। সীমান্ত সমস্যার সমাধান করেছেন। দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে জাতির সামনে একমাত্র আশার বাতিঘর হয়ে উঠেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে গণমানুষের শক্তিতে, সমর্থনে তার বিকল্প এখন তিনি নিজেই। এটাই আমার বিশ্বাস। এ নিয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ বিকৃতরা আমার চরিত্রহননের জন্য যত নোংরা খেলা খেলুক, যত নিন্দাই করুক, আমার কিছু যায় আসে না। ’৭৫-উত্তর দীর্ঘ কঠিন সংগ্রামের পথে আমরা যখন গভীর আবেগ নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিরলস কাজ করেছি তখন যারা মহান নেতাকে ও শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ করেছে, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগবিদ্বেষী আচরণ করেছে তাদের তাঁর পায়ের কাছে নত করিয়েছেন। এ আমার বড় তৃপ্তি।

বিশ্বাস থেকে অন্তর থেকে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমিও একজন চিন্তার সাথী। তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করা মাদকের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধে আমিও একজন কলমযোদ্ধা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি যে যুদ্ধ শুরু করেছেন এখানে আমি বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে তাঁর লড়াইয়ের এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে আসছি, এই রাজদুর্নীতি চলতে পারে না। আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা হচ্ছে গোটা দেশ আজ আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। তিনি যেখানে দুর্নীতি, অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাঁর নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আত্মীয়দের ছাড় দিচ্ছেন না, সেখানে কাউকে ছাড় দেবেন কেন?

দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রধান এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দেশের জনগণ তাঁর পক্ষে রয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী শুধু সার্বভৌমত্বের প্রতীকই নয়, গণতন্ত্র সুসংহত, রাষ্ট্র সংস্কার ও বিশ্বশান্তিতে উন্নয়নে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখছেন। সেনাপ্রধান থেকে সেনা কর্মকর্তারা অবসরে গেলে দেখা যায়, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অনেক কর্মকর্তা অবসরে গেলে বিদেশে বাড়িঘর নিয়ে রাজার হালে বাকি জীবন কাটান। এমনকি রাজনীতিতে এসে এমপি-মন্ত্রী হওয়ারও খায়েশ দেখান।

যুবলীগের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর গণভবনের বৈঠকে অনেকে প্রবেশ করতে পারেননি। কিন্তু ড. আহমেদ আল কবির কীভাবে ঢুকলেন? কবে এ দলে এলেন? কীভাবে প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেন? তিনি কি অনুপ্রবেশকারী নন? এই প্রশ্ন বড় রহস্যময়। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত যারা মন্ত্রী-এমপি ও দলের পদ-পদবি বা রাজনৈতিক নিয়োগ নিয়েছিলেন, দশ বছর আগে তাদের অর্থসম্পদ কী ছিল? আর এখন কোথায় দাঁড়িয়েছে? সেই চিত্র নিয়ে অভিযানকে দীর্ঘায়িত না করে, দ্রুত ব্যবস্থা করে আইনের আওতায় এনে বিচার সম্পন্ন করা জরুরি। যারা ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন, যারা শেয়ারবাজার লুট করে নিঃস্ব করেছেন, যারা লাখ লাখ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করেছেন, একই সঙ্গে তাদেরও আইনের আওতায় আনা না গেলে, শাস্তি দেওয়া না গেলে এ অভিযান পূর্ণতা পাবে না। দল ও মানুষকে হতাশ করবে। মানুষ ডাকাতদের আটক দেখতে চায়। বিচার চায়। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা সৎ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের মতো একনায়ক হয়েও যদি এই যুদ্ধে বিজয়ী হন, দেশ জয়ী হবে। জনগণ মেনে নেবে। ইতিহাস অমরত্ব দেবে। এই যুদ্ধে শেখ হাসিনা পরাজিত হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের পরাজয়বরণ করবে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন আরেক দফা হোঁচট খাবে।

প্রধানমন্ত্রীর তাঁর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে রূপরেখা তুলে ধরে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেওয়া প্রয়োজন। আজ বড় বড় ব্যবসায়ী, সম্পাদক, লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিক সবাইকে শেখ হাসিনার পাশে টানা দরকার। আজ মুজিবকন্যার এই কঠিন যুদ্ধে প্রবীণ নেতা আমু-তোফায়েলকে সেদিন তাঁর পাশে দেখে আনন্দিত হয়েছি। দলে ও দেশের রাজনীতিতে সবাই তাঁর প্রতি অনুগত। অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দিয়ে দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে দিয়ে দলের নিবেদিত আদর্শিক সবাইকে এখন ঐক্যবদ্ধ করার সময়। দলে যারা নিষ্ক্রিয়, যারা বাইরে তাদেরও আনা দরকার। সক্রিয় করা দরকার। ব্যাংক লুটেরা খেলাপি হয় না, বরেণ্য পার্লামেন্টারিয়ান মিজানুর রহমান চৌধুরী ঋণখেলাপি হয়ে মারা যান। একাত্তর ও পঁচাত্তরের বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ঋণখেলাপি। আর যাকেতাকে মনোনয়ন, দলীয় পদ ও মহিলা এমপি করার কুফল আজ ভোগ করছে দল, রাজনীতি, দেশ। একজন বুবলী মহিলা এমপি হয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কলঙ্ক বয়ে এনেছেন। এদের অনুদান অর্থ দেওয়া যায়, এমপি পদ নয়। এখনো কেন পদত্যাগ হয়নি বুঝিনি। এসব দেশের রাজনীতির জন্য বেদনার।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

মেননের আর্তনাদ ও মান্নার কান্না থামে না

আপডেট টাইম ১২:৫৬:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৯

পীর হাবিবুর রহমান::বামপন্থি রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন রয়েছে। রাজনীতিতে তিনি এক দিনে তৈরি হননি। এটি যেমন সত্য, তেমনি রাজনীতিবিদদের জন্য প্রতিনিয়ত জনগণের কাছে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করে অগ্রসর হতে হয়। রাজনীতিবিদদের নিয়ে সমালোচনা যেমন থাকে, তেমনি সাফল্যের গৌরবও থাকে। জগদ্বিখ্যাত মহান রাজনৈতিক নেতা বা শাসকরা যুগে যুগে যেমন নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, মহানায়ক হিসেবে ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছেন, তেমনি সমালোচনার তীরেও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থি বা সমাজতন্ত্রীদের বিশ্বরাজনীতির হাওয়ায় যখন সুবর্ণ সময় বা সুবাতাস বইছিল তখনো তারা সমাজতন্ত্রের বিপ্লব ঘটাতে বা গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় আসতে যেমন ব্যর্থ হয়েছেন তেমনি নিজেরা বার বার ভাঙনের মুখে পতিত হয়েছেন। একই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব তিন দশক বামফ্রন্ট শাসন করেছে, সেখানে বাংলাদেশে বামপন্থিরা দাঁড়াতেই পারেনি। এ দেশের অধিকাংশ চীনা বাম সামরিক শাসকদের হাত ধরে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ভোগ করেছেন বা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। অন্যদিকে মস্কোপন্থি ন্যাপ কমিউনিস্ট আজীবন নৌকায় চড়ে সংসদে এসেছেন। অন্যের করুণাশ্রিত ছাড়া তারা যত বড় নেতাই হোন না কেন, ভোটের ময়দানে বার বার প্রমাণ করেছেন- না আছে সাংগঠনিক শক্তি, না আছে নিজেদের জনসমর্থন। মাঝেমধ্যে এক-দুজন বামপন্থি নিজেদের প্রতীক নিয়ে এককভাবে বিজয়ী হয়ে সংসদে এসে চমক সৃষ্টি করেছেন। যোগ্যতায়, মেধায় তারা অনন্য হলেও জনসমর্থনে ব্যর্থ ছিলেন।

নিভে যাওয়া বামপন্থিদের আদর্শিক একটি অংশ এখনো করুণাশ্রিত, পরনর্ভির ক্ষমতার পথ পরিহার করে তোপখানা রোড থেকে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত তাদের আদর্শের নিবুনিবু বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন।

রাশেদ খান মেনন সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সাজানো নির্বাচনে বা ’৭৯ সালের প্রহসনের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে এসেছিলেন তার বরিশালের বাবুগঞ্জের নির্বাচনী এলাকা থেকে। ’৯১ সালের নির্বাচনে সর্বহারাদের সমর্থনে বিজয়ী হয়ে এসে অদৃশ্য ঘাতকের বুলেটে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন। তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদে গোটা দেশ শোকাগ্রস্ত ও বিষাদগ্রস্ত হয়েছিল। গুপ্ত ঘাতকের এই হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব বিরোধী দল যখন পঞ্চম সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ওয়াক-আউট, বর্জন, পদত্যাগ ও গণআন্দোলনে রাজপথে নামল, রাশেদ খান মেনন তখন নিরাপদ দূরত্ব রেখে চললেন।

বিএনপি-জামায়াত শাসনামল যখন দুর্নীতি, বিরোধী দল দমন, পাপাচার, জঙ্গি, সন্ত্রাস, গ্রেনেড, বোমা ও রাজনৈতিক হত্যাকাে অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল, তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বা নির্দেশে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলসহ দলের শীর্ষ নেতারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছোট-বড় প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে ১৪ দল গঠন করেছিলেন, তখন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনু অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন। সেই ঐক্যের পথে পরবর্তীতে এরশাদের জাতীয় পার্টি বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা বি. চৌধুরী ও কর্নেল অলি আহমদের দল নিয়ে মহাজোট গঠিত হয়। বিএনপি-জামায়াত শাসকদের জন্য সেই মহাজোট নির্বাচন সামনে রেখে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বিভিন্ন জনমত জরিপের হাওয়া বইছিল বিএনপি-জামায়াতবিরোধী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শক্তির অনুকূলে। একটি পরিবর্তনের পূর্বাভাস রাজনৈতিক আবহাওয়াবিদরা দিতে না দিতেই বিএনপি-জামায়াত সরকার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পথে নির্বাচনে জয়লাভ করার কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। আর এদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের অনেক প্রস্তাব দিয়ে ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার বাতিল করে নতুন ভোটার তালিকা ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের দাবিতে অনড় হয়েছিল। বিতর্কের মুখে বিচারপতি কে এম হাসান সরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বিএনপির রাজনীতির সব নীলনকশার রিমোট কন্ট্রোল তাদের রাজনীতির অভিশপ্ত হাওয়া ভবনে স্থাপন করা হয়েছিল। সব সংলাপ-আলোচনা, সমঝোতা ব্যর্থ করে দিয়ে তাদের পুতুল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও একই সঙ্গে সংবিধানের দোহাই দিয়ে করেছিল। অন্যদিকে গোপাল ভাঁড় মার্কা বিচারপতি আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তিন স্তরবিশিষ্ট প্রশাসন দলীয়করণের প্রাচীর তৈরি করে ক্ষমতায় আসার নীলনকশা চূড়ান্ত করেছিল। সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যক্তিত্ববান, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন চারজন উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, লে. জে. হাসান মশহুদ চৌধূরী, সি এম শফি সামি ও অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল হাওয়া ভবনের রিমোট কন্ট্রোলে বঙ্গভবনের নির্লজ্জ নাটকের প্রতিবাদে পদত্যাগ করে জনগণের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শেখ হাসিনাও সেদিন নির্বাচন ও আন্দোলনের দরজা খোলা রেখেই কঠিন রণকৌশল নিয়েছিলেন। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করে মহাজোট পরে একযোগে প্রত্যাহার করে নেয়। গোটা দেশের জনজীবন অচল হয়েই পড়েনি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকা , প্রশাসনিক কর্মকা অচল হয়েই যায়নি, সংঘাত, সংঘর্ষে রাজপথ সহিংস ও রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার জন্য বেপরোয়া পথটিই গ্রহণ করেছিল।

বিদেশি কূটনীতিকরা তৎপর হয়ে উঠলেন। দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে ক্ষমতা গ্রহণ না করলেও ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখে ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করলে গোটা দেশের জনজীবনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে আসে। বিএনপি ছাড়া সব রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণ, সিভিল সোসাইটি আর গণমাধ্যম অভিন্ন সুরে ওয়ান-ইলেভেন সরকারকে স্বাগত জানায়। সেদিন সেনাবাহিনী ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার বাতিল করে এ টি এম শামসুল হুদার মতো দক্ষ, গ্রহণযোগ্য, ব্যক্তিত্ববান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা করলেও সেনাসমর্থিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি অপরিকল্পিতভাবে গণপাকড়াও অভিযান, দেশের ব্যবসায়ীদের গণহারে হয় দেশছাড়া নয় কারাবরণের হঠকারী নীতি গ্রহণ করে যে জনপ্রিয়তা নিয়ে যাত্রা করেছিল, সেখানে ধস নামিয়ে দেয়। রাজনৈতিকসহ নানা সংস্কার ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান দিয়ে মানুষের মধ্যে যে স্বপ্ন তৈরি করেছিল, তাতে মানুষ সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু তাদের ভ্রান্তনীতি ও সবাইকে স্পর্শ করায় জনসমর্থন দূরে সরে যায়। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের দিন টানাহেঁচড়া করে কারাগারে নেওয়ার দৃশ্য যেমন মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের বিদ্রোহ তাদের শক্তিকে শেষ করে দেয়। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে অপমানের নীতি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তারা অনেক ভালো কাজ করলেও বড় ভুলের জন্য জনসমর্থন হারিয়ে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেয়।

বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনকালে আমি তখন রাজনৈতিক বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে যুগান্তরে কাজ করি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নেতাদের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ। প্রায় নিয়মিত আমার লিড রিপোর্ট ছাপা হচ্ছিল, একদিন বিএনপি সরকারের দ্রব্যমূল্যসহ নানা অপশাসনের চিত্রপট তুলে ধরা রিপোর্ট পাঠ করে আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসভবন থেকে অকালপ্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের টেলিফোনে এইচ টি ইমাম আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাকে বলেছিলাম, আপনাদের কাজ আপনারা করুন। আমার কাজ আমাকে করতে দিন।

আমার ছাত্র রাজনীতি ও পেশাদারিত্বের জীবনে কোনো অপরাধ আমি কখনো করিনি। কোনো সরকারের কাছ থেকেও কখনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিনি। আমার জীবন সংগ্রামের উত্থান-পতনের এবং উজানে সাঁতার কাটার। অন্তহীন দহন সয়েছি। অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। কিন্তু সেনাশাসন জমানায় গণতন্ত্রের জন্য জেল খাটা একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সেনাশাসন-উত্তর গণতন্ত্রের দীর্ঘ যাত্রাপথে যখন আমাদের স্বপ্ন পূরণ হতে দেখিনি, ইবাদতের মতোন পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করে দিনে দিনে দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা রাজদুর্নীতির যুগে দেশকে প্রবেশ করতে দেখেছি তখন মন কেবল আর্তনাদ করেছে। অহরহ করে। দ্রোহ করে।

যাক রাশেদ খান মেনন দিয়ে শুরু করেছিলাম। মোজাফ্ফর হোসেন পল্টুর মতো নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতি অন্ধ, অনুগত যেখানে মনোনয়ন পান না, সেখানে ওয়ান-ইলেভেনের চ্যালেঞ্জ জয় করে বিশাল গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার নৌকায় চড়ে মতিঝিল থেকে রাশেদ খান মেনন সংসদে এসেছিলেন। ’৯৬ সালে তার বাবুগঞ্জের আসনে করুণ পরাজয় ঘটেছিল। ২০০৮ সালে বিএনপি বর্জন বা ওয়াকওভার দিলেও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপির প্রার্থী আবদুর রহিমকে সরিয়ে তাকে সংসদে আনতে হয়েছে। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেছেন, মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মন্ত্রিত্ব তিনি প্রত্যাখ্যান করেননি। মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজনীতির কিংবদন্তি তোফায়েল আহমেদ। আর মেনন মন্ত্রিত্ব নিতে পারেননি তোফায়েল প্রত্যাখ্যান করায়, অন্যদিকে তার পার্টির বাধার কারণে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সংসদে এসে তিনি মন্ত্রিত্ব নিয়েছেন। এবার মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার দশ মাস পর এসে যখন বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে কেউ ভোটে নির্বাচিত হতে পারেননি এবং জনগণ ভোট দিতে পারেনি ততক্ষণে তিনি শেখ হাসিনার অনুকম্পায় তার স্ত্রীকেও এমপি বানিয়েছেন। তার নির্বাচনী এলাকার ক্যাসিনো-বাণিজ্যের কালো টাকা বিতর্ক যখন তাকে স্পর্শ করেছে এর আগে যখন এমপি হয়ে স্কুলের ভর্তি-বাণিজ্যও তাকে বিতর্কিত করেছিল। সেসব কথা বাদ দিলেও এ ধরনের অভিযোগ তিনি তখনই করতে পারেন, যখন তিনি নৈতিক দায় থেকে স্ত্রীসহ পদত্যাগ করবেন। এখন তার বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিলে তার পদত্যাগ করা উচিত। আর না হয় এ আর্তনাদের স্বপক্ষে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া উচিত।

এদিকে সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয়নি। আমার পছন্দের মানুষ সৃজনশীল, আড্ডাবাজ, পড়াশোনা জানা মান্না যখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, তখন একবার বলেছিলাম, আহমদ ছফা নেই। রাজনীতি ছেড়ে নির্মোহ চিত্তে লেখালেখি করুন। তিনি বলেছিলেন, দেশে আছেই রাজনীতি, তাই রাজনীতি করি। বাড়ি বগুড়ায়, তাহলে বিএনপি করলেন না কেন? মান্না বলেছিলেন, শেখ হাসিনা আমাকে বোঝেন। আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা আছে। তাই এ দলটি করি। আজ মান্না যে কথা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, আওয়ামী ও মুজিববিদ্বেষী একদল বিকৃত, আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত রাজনীতিবিদ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় সেই তারা যে কথা বলতেন, তার প্রতিধ্বনি করছেন। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার আওয়ামী লীগই গঠন করেছে। এসব সত্য নির্লজ্জ মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বলতেও লজ্জা হয়। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছিলেন, আওয়ামী লীগে এসে মান্না লিখেন না। জুড়ে দেন কান্না। বিভ্রান্ত মান্নার কান্না থামছে না। ব্যক্তিগত আক্রোশ, ব্যর্থতার গ্লানি ও প্রতিহিংসা যে অনেককে শেষ করে দেয়, দেউলিয়া রাজনীতিবিদদের দিকে তাকালে সেটি দেখা যায়।

আমার কোমল হৃদয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বপ্ন আজন্মের মতোন লালন করে এই পেশায় আমি মানিক মিয়া হতে এসেছিলাম। আমি মানিক মিয়া হতে পারিনি। শাসনব্যবস্থা, গণমাধ্যম, সংস্কৃতি, সময় এবং বাস্তবতা আমাকে হতে দেয়নি। এই যন্ত্রণা আমার একার। এটা আমি একাই ভোগ করি, কাউকে বুঝতে দিইনি, অনেক কিছু থেকে এমনকি কত আড্ডা, সামাজিকতা থেকেও নিজেকে দূরে রাখি। আমৃত্যু এ বেদনা বইতে হবে আমাকে। সুবিধাবাদী আদর্শহীন সমাজে আমি বঙ্গবন্ধুকে কোথাও পাই না। নষ্টদের উল্লাস দেখি। স্বার্থপরদের বেপরোয়া নির্লজ্জ উন্মাদনা দেখি। খাই খাই লালসা দেখি। প্রেমিক দেখি না, প্রেম ভালোবাসা, নির্লোভ, মায়া-মমতা দেখি না। দেখি কেবল লোভ আর লাভের হিসাবের কণা। তবু মানুষ আছে, মানুষ নদী, প্রকৃতি, পাহাড়, বৃষ্টি, জোছনা ও ফুল পাখি বঙ্গবন্ধু আছে বলেই বেঁচে আছি। স্বপ্ন দেখি বুক ভরে শ্বাস নিই। যারা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাস করে তারা সমাজ ও মানবতার শত্রু। যারা রসরাজের মতো সহজ-সরল, মূর্খ হিন্দুর নামে অপপ্রচার চালিয়ে ধর্মের নামে দাঙ্গা বাধায়, যারা ভোলায় একজন হিন্দুর ফেসবুক হ্যাক করে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে মাঠে নামে তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষধর সাপমাত্র। যে বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে অভিশপ্ত শাসনামল দিয়েছে, যারা এখনো নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনায় ভোগে না এবং নিজেদের পাপাচারের জন্য, অপরাধের জন্য লজ্জিত হয় না। কারাবন্দী গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন না করে, বিতর্কিত নির্বাসিত দি ত তারেক রহমানের বন্দনা করে, তাদের হাজার হাজার দেশপ্রেমিক গণমুখী নেতা-কর্মী থাকলেও নেতৃত্বের ভ্রান্ত নীতি-আদর্শ ও ভুলের কারণে তারা কখনো বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।

মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ৩৯ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামে বার বার মৃত্যুকে জয় করে ফিরে এসে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করে খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। আন্তর্জাতিক আদালতের মামলায় জিতে আরেক বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। সীমান্ত সমস্যার সমাধান করেছেন। দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে জাতির সামনে একমাত্র আশার বাতিঘর হয়ে উঠেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে গণমানুষের শক্তিতে, সমর্থনে তার বিকল্প এখন তিনি নিজেই। এটাই আমার বিশ্বাস। এ নিয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ বিকৃতরা আমার চরিত্রহননের জন্য যত নোংরা খেলা খেলুক, যত নিন্দাই করুক, আমার কিছু যায় আসে না। ’৭৫-উত্তর দীর্ঘ কঠিন সংগ্রামের পথে আমরা যখন গভীর আবেগ নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিরলস কাজ করেছি তখন যারা মহান নেতাকে ও শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ করেছে, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগবিদ্বেষী আচরণ করেছে তাদের তাঁর পায়ের কাছে নত করিয়েছেন। এ আমার বড় তৃপ্তি।

বিশ্বাস থেকে অন্তর থেকে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমিও একজন চিন্তার সাথী। তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করা মাদকের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধে আমিও একজন কলমযোদ্ধা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি যে যুদ্ধ শুরু করেছেন এখানে আমি বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে তাঁর লড়াইয়ের এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে আসছি, এই রাজদুর্নীতি চলতে পারে না। আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা হচ্ছে গোটা দেশ আজ আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। তিনি যেখানে দুর্নীতি, অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাঁর নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আত্মীয়দের ছাড় দিচ্ছেন না, সেখানে কাউকে ছাড় দেবেন কেন?

দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রধান এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দেশের জনগণ তাঁর পক্ষে রয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী শুধু সার্বভৌমত্বের প্রতীকই নয়, গণতন্ত্র সুসংহত, রাষ্ট্র সংস্কার ও বিশ্বশান্তিতে উন্নয়নে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখছেন। সেনাপ্রধান থেকে সেনা কর্মকর্তারা অবসরে গেলে দেখা যায়, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অনেক কর্মকর্তা অবসরে গেলে বিদেশে বাড়িঘর নিয়ে রাজার হালে বাকি জীবন কাটান। এমনকি রাজনীতিতে এসে এমপি-মন্ত্রী হওয়ারও খায়েশ দেখান।

যুবলীগের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর গণভবনের বৈঠকে অনেকে প্রবেশ করতে পারেননি। কিন্তু ড. আহমেদ আল কবির কীভাবে ঢুকলেন? কবে এ দলে এলেন? কীভাবে প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেন? তিনি কি অনুপ্রবেশকারী নন? এই প্রশ্ন বড় রহস্যময়। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত যারা মন্ত্রী-এমপি ও দলের পদ-পদবি বা রাজনৈতিক নিয়োগ নিয়েছিলেন, দশ বছর আগে তাদের অর্থসম্পদ কী ছিল? আর এখন কোথায় দাঁড়িয়েছে? সেই চিত্র নিয়ে অভিযানকে দীর্ঘায়িত না করে, দ্রুত ব্যবস্থা করে আইনের আওতায় এনে বিচার সম্পন্ন করা জরুরি। যারা ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন, যারা শেয়ারবাজার লুট করে নিঃস্ব করেছেন, যারা লাখ লাখ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করেছেন, একই সঙ্গে তাদেরও আইনের আওতায় আনা না গেলে, শাস্তি দেওয়া না গেলে এ অভিযান পূর্ণতা পাবে না। দল ও মানুষকে হতাশ করবে। মানুষ ডাকাতদের আটক দেখতে চায়। বিচার চায়। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা সৎ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের মতো একনায়ক হয়েও যদি এই যুদ্ধে বিজয়ী হন, দেশ জয়ী হবে। জনগণ মেনে নেবে। ইতিহাস অমরত্ব দেবে। এই যুদ্ধে শেখ হাসিনা পরাজিত হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের পরাজয়বরণ করবে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন আরেক দফা হোঁচট খাবে।

প্রধানমন্ত্রীর তাঁর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে রূপরেখা তুলে ধরে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেওয়া প্রয়োজন। আজ বড় বড় ব্যবসায়ী, সম্পাদক, লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিক সবাইকে শেখ হাসিনার পাশে টানা দরকার। আজ মুজিবকন্যার এই কঠিন যুদ্ধে প্রবীণ নেতা আমু-তোফায়েলকে সেদিন তাঁর পাশে দেখে আনন্দিত হয়েছি। দলে ও দেশের রাজনীতিতে সবাই তাঁর প্রতি অনুগত। অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দিয়ে দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে দিয়ে দলের নিবেদিত আদর্শিক সবাইকে এখন ঐক্যবদ্ধ করার সময়। দলে যারা নিষ্ক্রিয়, যারা বাইরে তাদেরও আনা দরকার। সক্রিয় করা দরকার। ব্যাংক লুটেরা খেলাপি হয় না, বরেণ্য পার্লামেন্টারিয়ান মিজানুর রহমান চৌধুরী ঋণখেলাপি হয়ে মারা যান। একাত্তর ও পঁচাত্তরের বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ঋণখেলাপি। আর যাকেতাকে মনোনয়ন, দলীয় পদ ও মহিলা এমপি করার কুফল আজ ভোগ করছে দল, রাজনীতি, দেশ। একজন বুবলী মহিলা এমপি হয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কলঙ্ক বয়ে এনেছেন। এদের অনুদান অর্থ দেওয়া যায়, এমপি পদ নয়। এখনো কেন পদত্যাগ হয়নি বুঝিনি। এসব দেশের রাজনীতির জন্য বেদনার।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।