ঢাকা ০৫:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত ড. মো. হারুনুর রশীদ পরিচালিত সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া বুধা’ মুক্তি পেয়েছে ভাল মানুষ থেকেইে ভাল মানুষ তৈরী হয়—ঠাকুরগাঁওয়ে আল-হাসানাহ স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরুস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে সাবেক এমপি জাহিদুর রহমান ঠাকুরগাঁয়ে যুবলীগ নেতার পলিথিন কারখানা বন্ধ, মালামাল জব্দ সাগর-রুনি হত্যা মামলা র‌্যাব থেকে তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইয়ের কাছে সংস্কারের পরেই নির্বাচন: ড. ইউনূস বশিরউদ্দীন ও ফারুকীকে কার বুদ্ধিতে নিলেন, প্রশ্ন মান্নার ভূমি সেবায় দুর্নীতি-অনিয়মে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা ভোট কারচুপির তদন্ত সাবেক ডিসি-এসপি-ইউএনওদের ঘুম হারাম আসিফ নজরুলকে হেনস্তা,দূতাবাসের কাউন্সেলরকে দেশে ফেরত, চাকরি হারাচ্ছেন স্টাফ

প্রতিক্রিয়া: সংসদে রুমিন ফারহানা কী করবেন?

সংসদে রুমিন ফারহানা কী করবেন?’ শিরোনামের কলামটি পড়ার পর নানা কারণে অবাক হয়েছি। পড়ে বুঝলাম এই লেখার মূল বক্তব্য বিএনপির সংসদে যাওয়া এবং তাতে বিএনপির কতটা ভুল করেছে বা তাদের রাজনীতির কতটা খারাপ, সেটা প্রমাণ করা। কিন্তু খুব অবাক ব্যাপার, এই কলামের শিরোনামে একজন বিশেষ এমপি রুমিন ফারহানার নাম ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা শিরোনামটিকে মূল লেখার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক। কিংবা হতেই পারে এই শিরোনাম তাঁর ‘বুদ্ধিমত্তার’ পরিচায়ক, যেহেতু নামটি এখন বহু মানুষকে আলোড়িত করে। তাই অপ্রাসঙ্গিক হলেও শিরোনামটা লেখক সেভাবেই করেছেন।

জনাব মল্লিকের লেখাটার সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার দৃষ্টিতে যেটা সেটা হচ্ছে, এটা একজন নিরপেক্ষ বিশ্লেষকের লেখা মনে হয়নি। তাঁর লেখার ভেতরের বার্তা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয়, তাঁর উদ্দেশ্য আদৌ এটা নয় যে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে বিএনপিকে পথনির্দেশ করা, বরং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে বিএনপিকে আরও হতোদ্যম করে দেওয়া। বিএনপি একেবারে শেষ হয়ে গেলে ক্ষমতাসীনদের খুব সুবিধা হতে পারে, কিন্তু সেটা আমাদের এই রাষ্ট্রের জন্য জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, সেটা নিয়ে একটা বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।

ডক্টর মল্লিক জার্মানিতে থাকেন। কোনো দেশে দীর্ঘ সময় থাকলেও বর্তমানে যোগাযোগের যুগে কোনো দেশের খোঁজখবর পাওয়া, কোন দেশ কীভাবে চলছে, সেটা বুঝতে পারা আদৌ কঠিন কোনো ব্যাপার না। এটা তাঁর একাডেমিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ার কথা। তিনি করছেন কি সেটা?

জনাব মল্লিক বলেছেন, ‘সংসদ কখনো কারও মুক্তির ক্ষেত্র হতে পারে না। খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে দেশের আইন মেনে। সংসদ চাইলেও কাউকে মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারে না। প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করতে পারে সংসদ। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বর্তমান সংসদ কি কোনো আইন প্রণয়ন বা পরিবর্তন করবে বলে বিএনপির সংসদেরা বিশ্বাস করেন। যদি তা-ই হয়, তবে ওনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’

আমি কথাগুলো পড়ে অবাক হয়ে ভেবেছিলাম কথাগুলো কোনো আওয়ামী লীগ নেতার নয় তো! ঠিক এই কথাগুলোই আমরা নিয়মিত শুনি আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের মুখ থেকে। এই দেশের বিচারব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, কতটুকু কাজ করে, সেটা জনাব মল্লিক জানেন না? বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়ের করা দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলাগুলোর একপক্ষের মামলাগুলো কী হয়েছে আর অপরপক্ষে কী হয়েছে, সেটা তিনি দেখেননি? শুধু সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পর্যায়ে বা কেন একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত দেশের বিচারব্যবস্থাকে ‘হাতিয়ার’ করে যেভাবে বিরোধী দলকে নির্যাতন করা হয়েছে, এই নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে তো ছিল না। জনাব মল্লিকের দৃষ্টিতে কি সেটা পড়েনি?

মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলির বিধিমালা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে সরকারের কী হয়েছিল, সেটা তিনি দেখেননি? সে সময় আমরা শুনেছিলাম একজন পদাসীন প্রধান বিচারপতির উক্তি, ‘সরকার নিম্ন আদালত কবজা করার পর উচ্চ আদালতের দিকে হাত বাড়িয়েছে।’ ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছিলেন, দেশের বিচার বিভাগ পুরো ডুবে গিয়ে কোনো রকমে নাকটা পানির বাইরে রেখে টিকে আছে। এরপর একজন পদাসীন প্রধান বিচারপতিকে যেভাবে পদ ছেড়ে দেশ থেকে চলে যেতে হয়েছিল, সেটা কি প্রমাণ করে না এ দেশে আইনের শাসনের কথা বলা মতলববাজির চাইতে বেশি কিছু না? এমন মতলববাজি সরকারি দলের কারও কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায়, কিন্তু একজন একাডেমিশিয়ান বিশ্লেষকের সেটা কতটুকু মানায়?

কলামে ড. মল্লিক আরও বলেন, ‘গোপনে টেলিফোনে বিএনপির নেতারা কী সব নির্দেশ দেন। সেই টেলিফোন আলাপ আবার ফাঁসও হয়।’ অবিশ্বাস্যভাবে জনাব মল্লিককে দেখি না তিনি এই প্রশ্ন করছেন, এই ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার মতো নোংরা কাজ কারা করছে? বিএনপি? তিনি কেন প্রশ্ন করেন না, কেন আওয়ামী লীগের কোনো ফোনালাপ ফাঁস হয় না? এ রকম ফোনালাপ ফাঁস হওয়া অবশ্যই নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারের ওপর নোংরা অসাংবিধানিক হস্তক্ষেপ। কিন্তু এর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের কাঠগড়ায় তিনি দাঁড় করান না।

রুমিন ফারহানা সম্পর্কে তিনি কয়েকটি কথা বলেছেন, উল্লেখযোগ্য কথাটি হচ্ছে ‘যে সংসদকে তিনি অবৈধ বলে মনে করছেন, সেই সংসদেই কীভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে, দেশের মানুষের পক্ষে কথা বলবেন?’ সাংসদ হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য রুমিন ফারহানা নিয়ম মেনে স্পিকারের কাছে গেছেন, শপথ নিয়েছেন। এটাকে কেউ সংসদকে বৈধতা দানের এক ধরনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখতেও পারেন। কিন্তু প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখেছি, শপথ নিয়েই তিনি বেরিয়ে সংসদকে অবৈধ বলেছেন; পুনর্নির্বাচন দাবি করেছেন।

মিজ ফারহানা সরকারি দল এবং পাতানো বিরোধী দলের দখলে থাকা সংসদে দাঁড়িয়ে কীভাবে সংসদকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলেছেন, সেটা কি ড. মল্লিক দেখেননি। সেই কথাটা পুরো সংসদের যেমন গাত্রদাহ তৈরি করেছে, সেটা দেখে বিএনপির অন্য সাংসদদের কথা জানি না, আমার কিন্তু মনে হয়েছে রুমিন ফারহানার সংসদে যাওয়া যৌক্তিক।

তাঁর সংসদে যাওয়া আমাদের কাছে আরেকটা বিষয় খুব স্পষ্ট করেছে। ২০১৪ সালের পর থেকে এই সরকার জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় থাকতে থাকতে নিজ সাংসদদের তো বটেই, গৃহপালিত বিরোধী দলের প্রশংসা শুনতে শুনতে ন্যূনতম সমালোচনা শোনার মানসিকতা যে তাদের হারিয়ে গেছে, সেটা স্পষ্ট হলো। বিএনপি সংসদে যাওয়ার আগে এমনকি প্রধানমন্ত্রীও তাদের সংসদে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তাঁদের ইচ্ছেমতো কথা বলতে দেওয়া হবে।’ অথচ অবিশ্বাস্যভাবে তাঁদের এক মিনিটের বেশি কথা শোনার ধৈর্য এবং সহনশীলতা আমরা দেখলাম না। সংসদে যাওয়া এবং সংসদে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলায় ক্ষমতাসীনদের মুখোশ এভাবে খুলে গেছে আমাদের সামনে। ড. মল্লিক বলেন, ‘সংসদ গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র, কিন্তু একমাত্র জায়গা না। গণতন্ত্রের জন্য আরও অনেক জায়গাতেই কথা বলা যায়।’ তাঁর এই উক্তিকে মিজ ফারহানা ভুল প্রমাণ করে দেখাবেন আর সব জায়গায় সঙ্গে সংসদকেও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করা যায়। মিজ ফারহানার বাকপটুতার (যা স্বীকার করেছেন জনাব মল্লিক) মুখে এই সংসদে এমন ‘ঝড়’ আরও তৈরি হবে, এই বিশ্বাস আমার আছে।

২০১৪ সালে সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিকভাবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া পুরো ৫ বছর ক্ষমতায় থেকে যাওয়া এবং এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ফেলে যে সরকারটি আবার ক্ষমতায় থেকে গেল, সেটি তার অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে একাকার করে প্রায় কর্তৃত্ববাদী চেহারা নিয়েছে। এ রকম একটা সরকারের কারণে বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যে বিপদ তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে আলোচনা দেখি খুব কম। সেই সরকার তার ক্ষমতার স্বার্থে বিরোধী দলের ওপর যে পরিমাণ নিপীড়ন চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে, সেটার সামনে পড়ে একটা দল তার স্বাভাবিক পরিকল্পনামতো চলতে না পারাটা যৌক্তিক। তাই তার ভুল হতেই পারে।

কোনো রাজনৈতিক দল অবশ্যই সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকে না। বিএনপি সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কিছু যৌক্তিক সমালোচনা করে ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ একটি কলাম আমি নিজেও লিখেছি, যদিও আমার দল নাগরিক ঐক্য বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক এবং আমি নিজে ঐক্যফ্রন্টের সর্বোচ্চ কমিটি, স্টিয়ারিং কমিটির একজন সদস্য।

দল হিসেবে নিশ্চয়ই বিএনপির ভুল আছে। কিন্তু এটাও বাস্তবতা বাংলাদেশের ইতিহাসে, এই মুহূর্তে বিএনপি যে রকম বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে কাজ করছে সে রকম বৈরী পরিবেশ স্বাধীনতার পর থেকে কোনো দিনও ছিল না। এ রকম একটা প্রায় টোটালিটারিয়ান সরকারের সময় একা বিএনপির পক্ষে লড়াই করা খুবই কঠিন। রাষ্ট্রের স্বার্থে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের এই লড়াইটিতে শরিক হওয়া দরকার। বিএনপিকে গঠনমূলক সমালোচনা করে সঠিক পথনির্দেশ না করে ‘রাজনৈতিক জোকারের দল’, ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব’, ‘সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে এরশাদের পথে হাঁটা’ এসব কথা বলে তাচ্ছিল্য করার মাধ্যমে ড. মল্লিকেরা প্রকারান্তরে সরকারকে তার কর্তৃত্ববাদী আচরণে আরও প্রশ্রয় দেন।

ডা. জাহেদ উর রহমান: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, নাগরিক ঐক্য
সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত

প্রতিক্রিয়া: সংসদে রুমিন ফারহানা কী করবেন?

আপডেট টাইম ১১:১৬:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জুন ২০১৯

সংসদে রুমিন ফারহানা কী করবেন?’ শিরোনামের কলামটি পড়ার পর নানা কারণে অবাক হয়েছি। পড়ে বুঝলাম এই লেখার মূল বক্তব্য বিএনপির সংসদে যাওয়া এবং তাতে বিএনপির কতটা ভুল করেছে বা তাদের রাজনীতির কতটা খারাপ, সেটা প্রমাণ করা। কিন্তু খুব অবাক ব্যাপার, এই কলামের শিরোনামে একজন বিশেষ এমপি রুমিন ফারহানার নাম ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা শিরোনামটিকে মূল লেখার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক। কিংবা হতেই পারে এই শিরোনাম তাঁর ‘বুদ্ধিমত্তার’ পরিচায়ক, যেহেতু নামটি এখন বহু মানুষকে আলোড়িত করে। তাই অপ্রাসঙ্গিক হলেও শিরোনামটা লেখক সেভাবেই করেছেন।

জনাব মল্লিকের লেখাটার সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার দৃষ্টিতে যেটা সেটা হচ্ছে, এটা একজন নিরপেক্ষ বিশ্লেষকের লেখা মনে হয়নি। তাঁর লেখার ভেতরের বার্তা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয়, তাঁর উদ্দেশ্য আদৌ এটা নয় যে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে বিএনপিকে পথনির্দেশ করা, বরং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে বিএনপিকে আরও হতোদ্যম করে দেওয়া। বিএনপি একেবারে শেষ হয়ে গেলে ক্ষমতাসীনদের খুব সুবিধা হতে পারে, কিন্তু সেটা আমাদের এই রাষ্ট্রের জন্য জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, সেটা নিয়ে একটা বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।

ডক্টর মল্লিক জার্মানিতে থাকেন। কোনো দেশে দীর্ঘ সময় থাকলেও বর্তমানে যোগাযোগের যুগে কোনো দেশের খোঁজখবর পাওয়া, কোন দেশ কীভাবে চলছে, সেটা বুঝতে পারা আদৌ কঠিন কোনো ব্যাপার না। এটা তাঁর একাডেমিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ার কথা। তিনি করছেন কি সেটা?

জনাব মল্লিক বলেছেন, ‘সংসদ কখনো কারও মুক্তির ক্ষেত্র হতে পারে না। খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে দেশের আইন মেনে। সংসদ চাইলেও কাউকে মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারে না। প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করতে পারে সংসদ। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বর্তমান সংসদ কি কোনো আইন প্রণয়ন বা পরিবর্তন করবে বলে বিএনপির সংসদেরা বিশ্বাস করেন। যদি তা-ই হয়, তবে ওনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’

আমি কথাগুলো পড়ে অবাক হয়ে ভেবেছিলাম কথাগুলো কোনো আওয়ামী লীগ নেতার নয় তো! ঠিক এই কথাগুলোই আমরা নিয়মিত শুনি আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের মুখ থেকে। এই দেশের বিচারব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, কতটুকু কাজ করে, সেটা জনাব মল্লিক জানেন না? বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়ের করা দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলাগুলোর একপক্ষের মামলাগুলো কী হয়েছে আর অপরপক্ষে কী হয়েছে, সেটা তিনি দেখেননি? শুধু সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পর্যায়ে বা কেন একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত দেশের বিচারব্যবস্থাকে ‘হাতিয়ার’ করে যেভাবে বিরোধী দলকে নির্যাতন করা হয়েছে, এই নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে তো ছিল না। জনাব মল্লিকের দৃষ্টিতে কি সেটা পড়েনি?

মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলির বিধিমালা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে সরকারের কী হয়েছিল, সেটা তিনি দেখেননি? সে সময় আমরা শুনেছিলাম একজন পদাসীন প্রধান বিচারপতির উক্তি, ‘সরকার নিম্ন আদালত কবজা করার পর উচ্চ আদালতের দিকে হাত বাড়িয়েছে।’ ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছিলেন, দেশের বিচার বিভাগ পুরো ডুবে গিয়ে কোনো রকমে নাকটা পানির বাইরে রেখে টিকে আছে। এরপর একজন পদাসীন প্রধান বিচারপতিকে যেভাবে পদ ছেড়ে দেশ থেকে চলে যেতে হয়েছিল, সেটা কি প্রমাণ করে না এ দেশে আইনের শাসনের কথা বলা মতলববাজির চাইতে বেশি কিছু না? এমন মতলববাজি সরকারি দলের কারও কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায়, কিন্তু একজন একাডেমিশিয়ান বিশ্লেষকের সেটা কতটুকু মানায়?

কলামে ড. মল্লিক আরও বলেন, ‘গোপনে টেলিফোনে বিএনপির নেতারা কী সব নির্দেশ দেন। সেই টেলিফোন আলাপ আবার ফাঁসও হয়।’ অবিশ্বাস্যভাবে জনাব মল্লিককে দেখি না তিনি এই প্রশ্ন করছেন, এই ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার মতো নোংরা কাজ কারা করছে? বিএনপি? তিনি কেন প্রশ্ন করেন না, কেন আওয়ামী লীগের কোনো ফোনালাপ ফাঁস হয় না? এ রকম ফোনালাপ ফাঁস হওয়া অবশ্যই নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারের ওপর নোংরা অসাংবিধানিক হস্তক্ষেপ। কিন্তু এর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের কাঠগড়ায় তিনি দাঁড় করান না।

রুমিন ফারহানা সম্পর্কে তিনি কয়েকটি কথা বলেছেন, উল্লেখযোগ্য কথাটি হচ্ছে ‘যে সংসদকে তিনি অবৈধ বলে মনে করছেন, সেই সংসদেই কীভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে, দেশের মানুষের পক্ষে কথা বলবেন?’ সাংসদ হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য রুমিন ফারহানা নিয়ম মেনে স্পিকারের কাছে গেছেন, শপথ নিয়েছেন। এটাকে কেউ সংসদকে বৈধতা দানের এক ধরনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখতেও পারেন। কিন্তু প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখেছি, শপথ নিয়েই তিনি বেরিয়ে সংসদকে অবৈধ বলেছেন; পুনর্নির্বাচন দাবি করেছেন।

মিজ ফারহানা সরকারি দল এবং পাতানো বিরোধী দলের দখলে থাকা সংসদে দাঁড়িয়ে কীভাবে সংসদকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলেছেন, সেটা কি ড. মল্লিক দেখেননি। সেই কথাটা পুরো সংসদের যেমন গাত্রদাহ তৈরি করেছে, সেটা দেখে বিএনপির অন্য সাংসদদের কথা জানি না, আমার কিন্তু মনে হয়েছে রুমিন ফারহানার সংসদে যাওয়া যৌক্তিক।

তাঁর সংসদে যাওয়া আমাদের কাছে আরেকটা বিষয় খুব স্পষ্ট করেছে। ২০১৪ সালের পর থেকে এই সরকার জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় থাকতে থাকতে নিজ সাংসদদের তো বটেই, গৃহপালিত বিরোধী দলের প্রশংসা শুনতে শুনতে ন্যূনতম সমালোচনা শোনার মানসিকতা যে তাদের হারিয়ে গেছে, সেটা স্পষ্ট হলো। বিএনপি সংসদে যাওয়ার আগে এমনকি প্রধানমন্ত্রীও তাদের সংসদে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তাঁদের ইচ্ছেমতো কথা বলতে দেওয়া হবে।’ অথচ অবিশ্বাস্যভাবে তাঁদের এক মিনিটের বেশি কথা শোনার ধৈর্য এবং সহনশীলতা আমরা দেখলাম না। সংসদে যাওয়া এবং সংসদে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলায় ক্ষমতাসীনদের মুখোশ এভাবে খুলে গেছে আমাদের সামনে। ড. মল্লিক বলেন, ‘সংসদ গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র, কিন্তু একমাত্র জায়গা না। গণতন্ত্রের জন্য আরও অনেক জায়গাতেই কথা বলা যায়।’ তাঁর এই উক্তিকে মিজ ফারহানা ভুল প্রমাণ করে দেখাবেন আর সব জায়গায় সঙ্গে সংসদকেও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করা যায়। মিজ ফারহানার বাকপটুতার (যা স্বীকার করেছেন জনাব মল্লিক) মুখে এই সংসদে এমন ‘ঝড়’ আরও তৈরি হবে, এই বিশ্বাস আমার আছে।

২০১৪ সালে সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিকভাবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া পুরো ৫ বছর ক্ষমতায় থেকে যাওয়া এবং এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ফেলে যে সরকারটি আবার ক্ষমতায় থেকে গেল, সেটি তার অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে একাকার করে প্রায় কর্তৃত্ববাদী চেহারা নিয়েছে। এ রকম একটা সরকারের কারণে বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যে বিপদ তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে আলোচনা দেখি খুব কম। সেই সরকার তার ক্ষমতার স্বার্থে বিরোধী দলের ওপর যে পরিমাণ নিপীড়ন চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে, সেটার সামনে পড়ে একটা দল তার স্বাভাবিক পরিকল্পনামতো চলতে না পারাটা যৌক্তিক। তাই তার ভুল হতেই পারে।

কোনো রাজনৈতিক দল অবশ্যই সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকে না। বিএনপি সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কিছু যৌক্তিক সমালোচনা করে ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ একটি কলাম আমি নিজেও লিখেছি, যদিও আমার দল নাগরিক ঐক্য বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক এবং আমি নিজে ঐক্যফ্রন্টের সর্বোচ্চ কমিটি, স্টিয়ারিং কমিটির একজন সদস্য।

দল হিসেবে নিশ্চয়ই বিএনপির ভুল আছে। কিন্তু এটাও বাস্তবতা বাংলাদেশের ইতিহাসে, এই মুহূর্তে বিএনপি যে রকম বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে কাজ করছে সে রকম বৈরী পরিবেশ স্বাধীনতার পর থেকে কোনো দিনও ছিল না। এ রকম একটা প্রায় টোটালিটারিয়ান সরকারের সময় একা বিএনপির পক্ষে লড়াই করা খুবই কঠিন। রাষ্ট্রের স্বার্থে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের এই লড়াইটিতে শরিক হওয়া দরকার। বিএনপিকে গঠনমূলক সমালোচনা করে সঠিক পথনির্দেশ না করে ‘রাজনৈতিক জোকারের দল’, ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব’, ‘সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে এরশাদের পথে হাঁটা’ এসব কথা বলে তাচ্ছিল্য করার মাধ্যমে ড. মল্লিকেরা প্রকারান্তরে সরকারকে তার কর্তৃত্ববাদী আচরণে আরও প্রশ্রয় দেন।

ডা. জাহেদ উর রহমান: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, নাগরিক ঐক্য
সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট।