বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) সংবাদদাতা : কেউ স্বার্থপর হয়ে সুখী, কেউ স্বার্থ বিলিয়ে সুখী। তবে আমি কখনো স্বার্থপর হতে শিখিনি। সব সময় চেষ্টা করেছি অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে!
এসবের বিনিময় একদিন কিছু পাব এমন আশা আগেও করিনি, আজও করি না। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ এই দায়িত্ববোধ থেকেই কিছু একটা করার চেষ্টা করেছি মাত্র। জানিনা কতটুকু পেয়েছি। কথাগুলো একটু চিন্তিত সুরে বলছিলেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সোহেল আহম্মেদ। কণ্ঠস্বরে চিন্তিত সুর কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ সমাজের মানুষগুলো
বড়ই অদ্ভূত। কেউ কাউকে নিয়ে ভাবার সময় পায় না।
চারপাশের অসহায় মানুষের চিৎকার কারো কানে পৌঁছে না। আমার মতো এই সামান্য সোহেলের দ্বারা কি আর সম্ভব।
তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি ঐ অসহায় মানুষ গুলোর পাশে সব সময় থাকার।
“সবার সুখে হাসব আমি/কাঁদব সবার দুংখে, নিজের খাবার বিলিয়ে দিবো/অনাহারীর মুখে।” পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের এই কবিতাটি বুকে ধারণ করে নিজ স্বার্থ বিলিয়ে আজ পরম সুখী সোহেল আহম্মেদ। ইতোমধ্যে দিনাজপুরের বীরগঞ্জের এই তরুণকে নিয়ে সবার অনেক স্বপ্ন, অসহায় মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও সাহস যোগায় সোহেল আহম্মেদ। আজ পর্যন্ত কেউ খালি হাতে ফিরেনি তার নিকট থেকে।
প্রতিবন্ধী, বিধবা, রোগাক্রান্ত, অসহায় দুস্থ্য পরিবারের পাশে তিনি সব সময়ই থেকেছেন। শুধু তাই নয়, গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্যও বাড়িয়ে দিয়েছেন সহায়তার হাত। এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ পেয়েছেন তার সাহায্য। সোহেল আহম্মেদ তার এই মানব সেবার বিষয়ে আরো জানান, মানব সেবা এখন তার নেশায় পরিণত হয়েছে।
তিনি চাইলেও এটা ছাড়তে পারবেন না। কারণ- মানুষের সেবার দ্বারা তিনি যে নিষ্পাপ হাসি দেখতে পান, সেটা তার কাছে হিরা-মুক্তার চেয়েও দামী। মানুষকে ভালবেসে তিনিও পেয়েছেন অকৃত্রি ভালবাসা। শুধু মানব সেবা করেই ক্ষ্যান্ত হননি ৪০ বছর বয়সী এই সোহেল আহম্মেদ। পাশাপাশি আরো অনেক সামাজিক কাজও তিনি করেছেন। বিভিন্ন সচেতনামূলক ফেস্টুন তৈরি করে ঝুলিয়ে দিয়েছেন জনবহুল এলাকাতে। বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকেই নিজ অর্থায়নে চালিয়ে যাচ্ছেন এই মানবসেবা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পেয়ে অনেকে সাহায্যের জন্য ইতো মধ্যে ছুঁটে গেছেন সোহেল আহম্মেদের কাছে। পেয়েছেন তরুণ সোহেলের বুকভরা ভালবাসা, সাথে সাধ্যমতো সাহায্যও। এদিকে আবার সোহেল আহম্মেদ-এর ফেসবুক পেইজ ঘেটে পাওয়া গেছে অবাক হওয়ার মতো অনেক দৃশ্য। রাস্তার পাগল/পাগলীদের নিয়ে একসাথে এক টেবিলে
হোটেলে খেতেও দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, সমাজের চোখে নিম্ন শ্রেণীর মানুষের তিনি যে কত সহজে আপন করে বুুকে টেনে নিয়েছেন সেটারও আবেকঘন দৃশ্যটি চোখে পড়ে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বীরগঞ্জ তথা দিনাজপুর জেলার অনেক প্রতিবন্ধী, বিধবা, সাঁওতাল, আদিবাসী, সুইপার এমন কি রাস্তার পাগলদের কাছে প্রিয় একটি নাম ‘সোহেল ভাই’। তিনি যেন এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার স্বপ্ন, আশার প্রদীপ। অনুসন্ধানের অনেক ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে রাস্তার ক্ষুধার্ত কুকুর, বেড়ালকেও খাওয়াচ্ছেন তিনি।
বীরগঞ্জ পৌর শহরের বাসিন্দা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে সোহেল আহমেদ। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। ছোট ভাই সুমন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষা জীবন শেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। পরিবারে মা, স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সোহেল আহমেদ বীরগঞ্জে বসবাস করেন।পৌর শহরে তার একটি বড় জুতা বিক্রয়ের দোকান রয়েছে।
এব্যাপারে বীরগঞ্জের ঢেপা নদী এলাকার সুইপার কলোনীর জগলু বলেন, ভগবান আমাদের পাশে দাড়ানোর জন্য একজন মানুষকে পাঠিয়েছেন। আমরা ছোট জাত দেখে উনার মনে কোন ঘৃণা নেই। অসুস্থ হলে সোহেল ভাই নিজের টাকা দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন ঔষধ কিনে দেন। প্রায় সময় এসে খোঁজ খবর নেন। বাজার না থাকলে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন।
পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের সাওতাঁল পাড়ার বিধবা মারং মাই জানান, আমার স্বামী যেদিন মারা গেলেন সেদিন তার সৎকার করার জন্য কোন টাকা ছিল না আমার কাছে। হঠাৎ তিনি এসে সৎকারের জন্য টাকা দিয়ে বললেন চিন্তা করবেন না, যে কোন প্রয়োজনে আমাকে জানাবেন।
গরীর মেধাবী বীরগঞ্জ সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ১ম বর্ষের ছাত্রী মাসুমা জানান, আমার বাবার অসুস্থতার কারণে আমার পরিবার পড়াশুনা বন্ধ করে দেয়, তখন আমি বলরামপুর মাদ্রাসার দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলাম। এলাকাবাসীর পরামর্শে আমাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বিয়ে করতে অসম্মতি জানাই। বিষয়টি জানতে পেয়ে সোহেল ভাই আমার পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পাশাপাশি পড়াশুনার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করছেন বিগত দুই বছর ধরে।এছাড়াও শতাধিক পরিবারকে তিনি প্রতিনিয়ত অর্থিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।