অসাধারণ। অবিশ্বাস্য। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা। কাল খেলার একদম শেষ দিকে বাউন্ডারি লাইনে যখন একটি চার আটকাতে পারলেন না, ভাষ্যকার দু’ বার বললেন, সাকিবও মানুষ! এই বিশ্বকাপে তিনি যে পারফরম্যান্স দেখাচ্ছেন তাতে এ সংশয় আসলেই দেখা দিচ্ছে যে, তিনি কি আসলেই মানুষ। ব্যাট হাতে রয়েছেন জীবনের সেরা ফর্মে। বিশ্বমঞ্চে এসে কবে কে, এমন সেরা ফর্মে ওঠতে পেরেছেন। বল হাতে কালকের আগে এতোটা দুর্দান্ত ছিলেন না। বাংলাদেশের জন্য যখন প্রয়োজন তখনই করে দেখালেন ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং।
একজন মানুষের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়া যেতে পারে। অবিশ্বাস্য এই চিত্রনাট্য নিয়তিই বোধ হয় ঠিক করে রেখেছিল। সাকিব নিজেও কি এতোটা আশা করেছিলেন। বিশ্বখ্যাত ওয়েবসাইট ক্রিকইনফো তার এই পারফরম্যান্সের প্রশংসা করতে টেনেছে গ্রীক পুরাণের চরিত্র হারকিউলিসকে। আসলেইতো সাকিব আমাদের হারকিউলিস। পুরাণ থেকে ওঠে আসা চরিত্রইতো। রক্ত মাংসের মানুষ কি এমনটা করতে পারেন?
পাঠকরা এরই মধ্যে জেনে গেছেন, গতকাল তার ঘূর্ণীতেই সাউদাম্পটনের রোজ বোল স্টেডিয়ামে নাস্তানাবুদ হলো আফগানিস্তান। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে তার ৫১ ও মুশফিকুর রহীমের ৮৩ রানের উপর ভর করে ২৬২ রানের পুঁজি পায় বাংলাদেশ। পরে বল হাতে সাকিবের পাঁচ উইকেটে ৬২ রানের জয় পায় টাইগাররা। সাবিকের এনে দেয়া জয়ে বেঁচে থাকলো বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন। ৭ পয়েন্ট নিয়ে ফের মাশরাফিরা এখন পয়েন্ট তালিকার ৫ স্থানে।
স্কোরবোর্ডে পর্যাপ্ত রানের যোগান পেয়েই সাউদাম্পটনের রোজ বোল স্টেডিয়ামে টাইগার ভক্তরা দারুণ উৎফুল্ল। রশিদ খান উইকেট পাননি, এবার রানও পাবেন না বলে চিৎকার করছিলেন একজন। আরেকজন বললেন আজ সাকিব সব গুড়িয়ে দেবে! মাঠে দেশের প্রতি ভালবাসার টানে অন্ধের মত ছুটে আসা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভক্তদের হতাশ করেননি সাকিব। ব্যাট হাতে ৫১ রানের পর বল হাতে ২৯ রানে নেন ৫ উইকেট। যা বিশ্বকাপে বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনো বোলারের প্রথম পাঁচ উইকেট। সেখানেই শেষ নয়, তার আগেই জায়গা করে নিয়েছেন আরেক বিশ্ব রেকর্ডে। বিশ্বকাপে বল হাতে নিয়েছেন ৩৩ উইকেট সেই সঙ্গে করেছেন এক হাজার রান। পিছনে ফেলেছেন স্টিভ ওয়াহ, সানাৎ জয়সুরিয়াদের।
এদিন বাংলাদেশের ছুড়ে দেয়া ২৬২ রানের টার্গে তাড়া করতে নেমে ভালোই শুরু করেছিল আফগানিস্তান। বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি ভেঙেছিল ২৩ রানে। কিন্তু আফগানদের দুই ওপেনার গুলবদিন নায়েব ও রহমত শাহ তোলেন ৪৯ রান। তখনই বল হাতে আক্রমনে এসে বাংলাদেশকে প্রথম সফলতা এনে দেন সাকিব। সেই শুরু, তার আগুনেই একে একে পুড়তে থাকে আফগানদের একটি জয়ের স্বপ্ন। যদিও মাটি কামড়ে পড়েছিল আফগানরা। কিন্তু অধিনায়কের আরেক অস্ত্র মোসাদ্দেক হোসেন এসে দলকে ফের স্বস্তি এনে দেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে পারেননি ইনজুরির কারণে। কিন্তু আগানদের বিপক্ষে ফিরে ব্যাট হাতে ঝড় তোলার পর বল হাতেও সফল এই তরুণ। ২৭ রান করা হাসমত উল্লাহ শাহিদিকে আউট করে দেখান সাজঘরের পথ। ৭৯ রানে দুই উইকেট হারালেও প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অধিনায়ক গুলবদিন। স্কোর বোর্ডকে ১০০ ছাড়িয়ে নিয়ে যান তিনি। ফের চিন্তার ভাজ পড়তে থাকে টাইগার শিবিরে। আবারো রব উঠে উইকেটের। সেই সময় ফের সাকিব হারকিউলিসের মত হাজির হন তাদের ইচ্ছা পুরণ করতে। স্লি পয়েন্টে দুজন ফিল্ডার রেখে গুলবদিনের জন্য টোপ পাতলেন সাকিব, প্রথম বলেই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দিলেন আফগান অধিনায়ক। লিটন দাস দারুণ ক্যাচ বানিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০০ রান ও ৩০ উইকেটের ডাবল পূর্ণ করেন।
এরপর আফগানদের মেরুদ-টাই ভেঙে ফেলেন সাকিব। দুই বল পর আবারো আঘাত হানেন। উইকেটে ডুকে যাওয়া বলের গতি বুঝতে না পেরে মোহাম্মদ নবী আউট হলেন। ভারতের বিপক্ষে নবীই দলকে ৫২ রান করে দলকে জিতিয়ে দিচ্ছিলেন। তাকে হারিযে আফগানদের জয়ের আশাও তখন নিভুনিভু। শেষ দিকে হাল ধরেছিলেন সামিউল্লাহ শেনওয়ারি-নজিবুল্লাহ জাদরানের ৮ম উইকেট জুটি। মাত্র ৪৫ বলে ৫৬ রান তুলে ভয় দেখাচ্ছিলেন দুজনে। নজিবুল্লাহকে নিজের ৫ম শিকার বানিয়ে সে ভয়ও দূর করেছেন সাকিবই। এর আগে আসগর আফগানকেও ডিপ মিড উইকেটে বানিয়েছিলেন সাব্বির রহমানের ক্যাচ। বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপে কোন বোলারের প্রথম পাঁচ উইকেটের মালিক এখন তিনি। ২০১৫ বিশ্বকাপে তার সেরা শিকার ছিল ৪ উইকেট। পরেই আছেন ৪ উইকেট নেয়া মাশরাফি বিন মুর্তজা, শফিউল ইসলাম ও রুবেল হোসেন।
এর আগে টসে জিতে বাংলাদেশকে আগে ব্যাট করতে পাঠায় আফগানিস্তান। সাউদাম্পটনে স্পিন দিয়েই বাংলাদেশকে কাবু করতে চেয়েছিল আফগানিস্তান। স্পিনার মুজিব উর রহমান তাদের চাওয়া পূরণ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশও তাদের ঘূর্ণি ভালোভাবে সামাল দিয়েছে মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসানের হাফসেঞ্চুরিতে। এদিন তামিম ইকবালের সঙ্গে ওপেনিংয়ে নেমেছিলেন লিটন। শুরুটা দেখেশুনে খেলছিলেন দুজন। আচমকা মুজিবের ঘূর্ণিতে আর থিতু হতে পারেননি লিটন। হাসমতউল্লাহ শহিদী ক্যাচটি কঠিন করে নেওয়ায় তা মাটিতে লেগেছিল কিনা সংশয়ে ছিলেন আম্পায়াররা। পরে থার্ড আম্পায়ার আউট দেন লিটনকে। তিনি মাঠ ছাড়েন ১৬ রান করে। তামিমের সঙ্গে তার জুটি ছিল মাত্র ২৩ রানের। এরপর সাকিব আসেন ক্রিজে। তামিমকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই শুরু করেন। গড়ে তোলেন ৫৯ রানের জুটি। দেশের দুই সেরা ক্রিকেটারের এই জুটি বেশ স্বতিই দিচ্ছিল টাইগার শিবিরে। কিন্ত আগের ম্যাচেই ফিফটি হাঁকানো তামিম ফের খেললেন এলোমেলো শট। নবীকে ব্যাকফুটে কাট করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান ৩৬ রান করে। রশীদের করা পরের ওভারের প্রথম বলে এলবিডাব্লিউর আবেদনে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার। সাকিব রিভিউ চান। দেখা যায়, বেলের ইঞ্চি চারেক ওপর দিয়ে চলে যেত বল। বেঁচে যান তিনি। এরপর সাকিব ও মুশফিক দলকে দ্রুত গতিতে রান এনে দিয়েছেন। তবে ফিফটির সামনে এসে একটু থমকে গিয়েছিলেন সাকিব। মোহাম্মদ নবীর ওভারে সিঙ্গেল নিয়ে বিশ্বকাপে নিজের তৃতীয় ফিফটি পূর্ণ করেন। অবশ্য এরপর নিজের নামের পাশে এক রান যোগ করেই ফিরে গেছেন সাজঘরে। ১৪৩ রানে তৃতীয় উইকেট হারায় বাংলাদেশ। এরপরই আউট হয়েছেন এই বিশ্বকাপে প্রথমবার পাঁচে নামা সৌম্য সরকার। এর আগে ৬ ম্যাচেই তিনি ছিলেন তামিমের ওপেনিং সঙ্গী। রিভিউ নিয়ে সৌম্য এলবিডাব্লিউর হাত থেকে রক্ষা পাননি। তবে লড়াই করে গেছেন মুশফিক।
সাকিবের সঙ্গে ৬১ রানের জুটি ভাঙার পর দলের হাল ধরেন মাহমুদুল্লাহকে নিয়ে। রিয়াদকে নিয়ে ৫৬ রানের জুটি গড়ে দলকে বিপদ মুক্ত করেন তিনি। দলের স্কোর বোর্ডে ২০৭ রানের সময় ২৭ রান করা রিয়াদ আউট হয়ে যান। ব্যাথা পেয়ে খেলতে পারছিলেন না তিনি। এরপর মোসাদ্দেককে নিয়ে মুশফিক গড়েন ৪৪ রানের জুটি। তাতেই দল পায় ২৫০ রানের দেখা। ৪৮.৩ ওভারের সময় ৮৩ রান করা মুশফিক আউট হন। এরপর এক ম্যাচ পর একাদশে ফেরা সৈকত আউট হন ৩৫ করে। মুজিব নিয়েছেন তিন উইকেট।