সারাদিন ডেস্ক:: খাদ্যে ভেজাল নিয়ে দেশজুড়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বিশেষ করে রমজান মাসে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। বিভিন্ন সরকারি ও সেবা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে একের পর এক বের হতে থাকে ভেজাল খাবার উৎপাদন কারখানার হদিস, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাও করা হয় লাখ লাখ টাকা। এত কিছুর পরও থামানো যাচ্ছে না খাদ্যে ভেজাল। তবে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ভেজাল কারবারিদের বিরুদ্ধে নিরাপদ খাদ্য ও পেনাল কোডের নিয়মিত আইনে মামলা না হওয়া বড় বাধা বলে মনে করছেন পরিবেশ ও নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের কর্মীরা। তারা বলছেন, প্রচলিত আইনে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করা গেলে খাদ্যে ভেজাল দেয়া অনেকটা বন্ধ করা সম্ভব।
ভেজাল খাবার উৎপাদক, বিপণনকারী এমনকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোন খাবারের বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করলে নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা করতে পারবেন যে কোন নাগরিক। এছাড়া, খাবারের মান নিয়ন্ত্রক ও তদারকি সংস্থাগুলোও অপরাধ আমলে নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত শেষে মামলা করতে পারবে। তবে, দেশের অন্তত ২৫টি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওইসব জেলায় নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকরের পর থেকে উল্লেখ করার মত কোন মামলাই হয়নি। দেশের ৬৪টি জেলার কমপক্ষে ৪০টি জেলায় নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ আমলে নিয়ে কোন মামলা হয়নি। কেবল ঢাকা ও চট্টগ্রামের মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতের অধীনে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটদের খাদ্য আদালতে সবমিলিয়ে শ’খানেক মামলা হয়েছে। নানা জটিলতায় এই তিনটি আদালতেও চলমান মামলাগুলো সঠিক গতিতে এগোচ্ছে না।
এদিকে, নিরাপদ খাদ্য আইনে সব জেলা ও মহানগরে একটি বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত গঠনের কথা থাকলেও বেশিরভাগ জেলায় এর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সাধারণ মানুষও মামলা দায়ের প্রক্রিয়া ও আদালত বিষয়ে অবগত নয়। মূলত নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকরের পর থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক প্রচারণার অভাবে আইনের বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠেনি বলে জানান আদালত সংশ্লিষ্টরা। রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিক চাইলে নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা করতে পারবেন সেটাও তেমনভাবে প্রচার করা হয়নি। গত এক সপ্তাহে ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি জেলায় নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা দায়েরের তথ্য খোঁজা শুরু করেন এই প্রতিবেদক। রাজশাহী, যশোর, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, বরগুনা, মানিকগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, চাঁদপুর, ফেনী, কুমিল্লা ও বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নিরাপদ খাদ্য আইনে কোন মামলা হয়নি। আদালত সূত্রে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে খাদ্য পরিদর্শকরা খাবারের মান যাচাই করে অপরাধ আমলে নিয়ে মামলা হিসেবে আদালতে অভিযোগ করার এখতিয়ার রাখেন।
যেসব এলাকায় খাদ্য পরিদর্শক নেই সেসব জেলায় স্যানিটারি পরিদর্শকরাও চাইলে নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা করতে পারবেন। এছাড়া, নগর মহানগর এলাকায় সিটি করপোরশেন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও চাইলে ভেজাল খাদ্য উৎপাদক ও বিপণনকারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন। কিন্তু ২০১৫ সালের ১৬ই জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ কার্যকরের পর থেকে বেশিরভাগ জেলায় ও মহানগরে মামলা দায়েরে উদ্যোগী হননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আদালত সূত্র জানায়, তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানা করা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেয়াতেই আগ্রহ মামলা দায়েরকারী কর্মকর্তাদের।
তাছাড়া, সাধারণ মানুষকে নিরাপদ খাদ্য আইনের বিষয়ে সচেতন করতে না পারায় বিভিন্ন জেলায় কোন ধরনের মামলা হয়নি। খাদ্যে ভেজাল ঠেকাতে আইনের পাশাপাশি বিচারের জন্য ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলার প্রথম আমলি আদালত ও মহানগরে নির্দিষ্ট একটি আদালতকে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ হিসেবে ঠিক করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আইন-আদালত করার তিন বছরেও রাজশাহীতে এই আদালতে একটি মামলাও দায়ের হয়নি। গত ২৭শে এপ্রিল রাজশাহীতে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ এর প্রয়োগ ও করণীয়’ শীর্ষক এক কর্মশালায় রাজশাহীর জেলা ও দায়রা জজ মীর শফিকুল আলম বলেন, নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকরের পর রাজশাহীতে এ আইনে একটি মামলাও দায়ের হয়নি। তার মানে আমরা নিরাপদ খাদ্য পাচ্ছি অথবা ভেজাল খাবারই খাচ্ছি-বিষয়টি এমন নয়। তিনি বলেন, এই আইনের আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্রে ভোক্তাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে।
মূলত ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর প্রণয়ণ করা হয় ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’। ২০১৫ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি আইনটি কার্যকর করা হয়। এরপর ওই বছরের ৩০শে জুন এক প্রজ্ঞাপনে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগ রাজশাহীর জন্য ১ নম্বর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও মহানগর এলাকার জন্য ২ নম্বর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ হিসেবে নির্ধারণ করে। কিন্তু আইন কার্যকরের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এসব আদালতে একটি মামলাও দায়ের করা হয়নি। ওই কর্মশালায় জেলার সিভিল সার্জন ডা. কাজী মিজানুর রহমান বলেন, জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষায় আইনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিভিল সার্জন হিসেবে নতুন যোগ দেয়ায় নিজেই আইনটি সম্পর্কে জানতেন না।
এমনকি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা এ আইনের মামলার বাদী হবেন, এ বিষয়টিও তিনি জানতেন না। এমন পরিস্থিতির সূত্র ধরে অন্তত পাঁচটি জেলার স্যানেটারি ইন্সপেক্টরদের সাথে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। নিরাপদ খাদ্য আইন ও মামলা করার প্রক্রিয়া সর্ম্পকে এসব কর্মকর্তাও কিছু জানেন না বলে স্বীকার করেন। তবে কেউ কেউ জানান, প্রয়োজনীয় লোকবল ও প্রচারণার অভাবে জেলা শহরগুলো আইনের ব্যবহার করতে পারছেন না স্যানেটারি ইন্সপেক্টররা।
ঢাকার মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতের অধীনে তিনজন স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকার তিনটি ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ পরিচালনা করছেন। গত বৃহস্পতিবার এসব আদালতে গিয়ে জানা যায়, নিরাপদ খাদ্য আইনে সবমিলিয়ে ৭২টি মামলা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মামলার সংখ্যা ১১টি, বাকি ৬১টি মামলা চলছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের খাদ্য আদালতে। এখানকার ৩০টি মামলা আবার উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। সবশেষ ২৪শে এপ্রিল রাজধানীর বাগিচা রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তবে, এখানকার একজন পাবলিক অ্যানালিস্টের পদ গত দুই বছর ধরে শূন্য থাকায় তেমন কোন মামলা হচ্ছে না বলেও আদালত সূত্রে জানা গেছে।
সিটি করপোরেশনের কর্মী মো. সেলিম বলেন, পাবলিক অ্যানালিস্ট পরীক্ষা করে ভেজাল বা বিশুদ্ধতার বিষয়ে রিপোর্ট দেন। ল্যাবের পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে পরে মামলা করা হয়। সবশেষ গোলাম সারওয়ার নামে একজন পাবলিক অ্যানালিস্ট এই পদে চাকরি থেকে অবসর নেন। তারপর ওই পদে আর কেউ যোগ দেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন কর্মকর্তা জানান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এই পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের অধীনে পাবলিক অ্যানালিস্ট না থাকায় গত দেড়-দুই বছরে তেমন কোন মামলা হয়নি। বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত-১ এর স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী পাভেল সুইট গত বৃহস্পতিবার মানবজমিনকে জানান, সচেতনতার অভাবে অনেক মানুষ নিরাপদ খাদ্য আইনের ব্যবহার করতে পারছেন না।
এজন্য আদালতগুলোতে মামলার হারও অনেক কম। সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা গেলে মামলার সংখ্যাও বাড়বে। তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্য আইন ছাড়াও দণ্ডবিধির ২৭২, ২৭৩, ২৭৪ ও ২৭৫ ধারাও যে কোন থানায় বা আদালতে মামলা করা যাবে। অথচ পেনাল কোডের এই ধারার বিষয়ে অনেকেই অবগত নন। আদালত সূত্রে আরো জানা গেছে, আশুলিয়ার একটি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্য জব্দ করে সিটি করপোরেশনের বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের শরণাপন্ন হন থানা পুলিশের একজন সদস্য। তবে আশুলিয়া এলাকা ঢাকা মহানগরের অধীনে না হওয়ায় মামলা করতে বলা হয় ঢাকার মূখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে। মূলত, খাদ্য আদালতের কার্যক্রম সম্বন্ধে তেমন কোন ধারণা না থাকায় তদারকি সংস্থা ও সাধারণ মানুষ এভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এজন্য ব্যাপক প্রচারণার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানকার আদালতেও নিরাপদ খাদ্য আইনে কোন মামলা হয়নি।
তবে, নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও জনসচেতনতার বিষয়টি আমলে নিয়ে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের কার্যক্রম এরইমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন বলে জানান আদালত সংশ্লিষ্ট একজন। এদিকে, নিয়মিত মামলা না হওয়ায় খাবারে ভেজাল কারবারীরা সামান্য জরিমানা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতেই পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে মত পরিবেশবিদদের। দীর্ঘমেয়াদী বিচার ব্যবস্থায় অসাধু ব্যবসায়ীদের মামলার মুখোমুখি করা গেলে খাদ্যে ভেজাল কমে আসবে বলে জানান পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত চলুক সে বিষয়ে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম কমাতে নিরাপদ খাদ্য আইনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত আইনে মামলা করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে বছরে একবার জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যান এসব অসাধু ব্যবসায়ী।
বিএসটিআই, ভোক্তা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর সবাইকে আরো সেচ্চার হতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, সংস্থাগুলো মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করে কিছুটা সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছে। নিরাপদ খাদ্যের অধিকার বাস্তবায়নে এগুলোর প্রয়োজন রয়েছে। সমস্যার নিরসনে একেবারে গোড়া থেকে কাজ করতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ও বিপনন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায় অবধি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভেজাল খাদ্য বন্ধে শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল-জরিমানা করার প্রক্রিয়াটি তেমন কাজে দেবে না বলে মনে করেন তিনি।
যেসব আদালতে মামলা করা যাবে
রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিক তার জেলার মূখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের এক নম্বর আমলী আদালতে নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা করতে পারবেন। এছাড়া মহানগর এলাকার জন্য মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতগুলো নির্দিষ্ট ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ গঠন করা হয়েছে। মহানগর এলাকার বাসিন্দারা এসব আদালতে মামলা করতে পারবেন। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপণে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার জন্য ৪ নম্বর মহানগর হাকিম আদালত, রাজশাহীতে দুই নম্বর মহানগর হাকিম আদালত, সিলেটে তিন নম্বর মহানগর হাকিম আদালত ও বরিশালের এক নম্বর মহানগর হাকিম আদালতে নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা করা যাবে। এছাড়া, ঢাকার দুই সিটি করপোরশেন এলাকার বাসিন্দারা তিনটি বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা করতে পারবেন।