ঢাকা ০৯:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
সীমান্ত হত্যা কখনোই মেনে নেওয়ার নয়: মির্জা ফখরুল আ. লীগ সাড়ে ১৫ বছর দেশের পরিবর্তে নিজেদেরকে সাজিয়েছে: জামায়াত আমির ‘সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে’ ঠাকুরগাঁওয়ে আল-হাসানাহ স্কুলের ফলাফল প্রকাশ ও কৃতি শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরুষ্কার বিতরন গণ-হত্যাকারী, সন্ত্রাশী, দুর্নীতিবাজদের বিএনপিতে জায়গা হবে না : মির্জা ফখরুল দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত ড. মো. হারুনুর রশীদ পরিচালিত সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া বুধা’ মুক্তি পেয়েছে ভাল মানুষ থেকেইে ভাল মানুষ তৈরী হয়—ঠাকুরগাঁওয়ে আল-হাসানাহ স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরুস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে সাবেক এমপি জাহিদুর রহমান ঠাকুরগাঁয়ে যুবলীগ নেতার পলিথিন কারখানা বন্ধ, মালামাল জব্দ সাগর-রুনি হত্যা মামলা র‌্যাব থেকে তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইয়ের কাছে

মুক্তি বিলম্বিত আইনজীবীদের ভুলে

আজম রেহমান,সারাদিন ডেস্ক:: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজা পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি কবে মিলবে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন দেওয়ার পর তা স্থগিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগে শুনানির পর যদি হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহালও রাখা হয় তার পরও তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ তাঁকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

গত ১২ মার্চ কুমিল্লার একটি হত্যা মামলায় এরই মধ্যে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে। আগামী ২৮ মার্চ এর জন্য শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। তার আগে ওই তারিখে তাঁকে হাজির করার জন্য কারাগারে প্রডাকশন ওয়ারেন্ট (পিডাব্লিউ) বা হাজিরা পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। এখন ওই মামলায় জামিন হওয়ার আগে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা আরো অন্তত পাঁচটি মামলায় তিনি জামিন নেননি। এ অবস্থায় সরকার যদি পর্যায়ক্রমে প্রতিটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায় তাহলে খালেদা জিয়ার মুক্তির তারিখ অনিশ্চিত।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভিন্ন মামলার নথি থেকে দেখা যায়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলায় আট যাত্রীকে হত্যার ঘটনায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় কুমিল্লার জজ আদালত গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর এবং হত্যা মামলায় কুমিল্লার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গত ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এ ছাড়া নড়াইলে দায়ের করা একটি এবং ঢাকায় দায়ের করা দুটি মানহানি মামলায় গত বছরের শেষ দিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

এসব মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর কিংবা মামলা দায়েরের পর খালেদা জিয়া আদালতে আত্মসমর্পণ করলে অবশ্যই তিনি জামিন পেতেন। কারণ ঢাকায় একটি হত্যা, একটি রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ৯টি নাশকতার মামলায় তিনি আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে জামিন দেওয়া হয়েছিল। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া মামলাগুলোতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের আগেই খালেদা জিয়া আত্মসমর্পণ করলে জামিন পেতেন। তাহলে বর্তমানে কারাগারে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার দেখানোর মতো আইনি প্যাঁচে তিনি পড়তেন না। পরোয়ানা জারি হওয়া মামলাগুলোতে খালেদা জিয়াকে আত্মসমর্পণ না করানো ছিল ভুল। এই ভুলের খেসারত বর্তমানে তাঁকে দিতে হচ্ছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা সঠিক পরামর্শ দিলে এই ভুলগুলো এড়ানো যেত।

খালেদা জিয়ার মুক্তি পেতে দেরি হওয়ার বিষয়ে কয়েক দিন আগে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আইনজীবীদের ভুলের কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত হচ্ছে।’ তবে তিনি ভুলের কারণ ব্যাখ্যা করেননি। ওই সময় খালেদা জিয়ার রায়ের নকল দিতে আদালতের বিলম্বের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেছেন, আইনজীবীদের ভুল নয়, সরকারি কূটকৌশলে খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আটকে রাখা হচ্ছে।

নথিতে দেখা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা পরিচালনায়ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বেশ কিছু ভুল করেছেন। ওই মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা, যার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ফৌজদারি কার্যবিধিতে অভিযোগ গঠনের সময় আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার একটি বিধান রয়েছে। এ জন্য আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে আবেদন করতে হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এ বিষয়ে আবেদন করেননি।

এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মাজেদ আলী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সাক্ষ্য দেন। তিনি সাক্ষ্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এতিম তহবিলের নথি, যাতে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন তহবিলের অর্থ মেয়াদি জমা (এফডিআির) সংক্রান্ত তথ্য, সোনালী ব্যাংক রমনা শাখার হিসাবসংক্রান্ত কাগজপত্র ও তথ্য, বগুড়া ও বাগেরহাটের এতিমখানা সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে তা আদালতে দাখিল করেন। এসব কাগজপত্র স্বাক্ষরবিহীন ও ঘষামাজা বলে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যুক্তিতর্কের সময় দাবি করেন। তাঁরা বলেন, এসব কাগজপত্র জাল ও সৃজিত। কিন্তু এসব কাগজপত্র যখন আদালতে উপস্থাপন করা হয় তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বিনা আপত্তিতে তা আদালত গ্রহণ করেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের ৫৪৭ পৃষ্ঠায় আদালত উল্লেখ করেন, খালেদা জিয়া বা তাঁর কৌঁসুলিরা কোনো প্রকার আপত্তি করেননি। আইন অনুযায়ী আদালতে দাখিল করা কোনো কাগজপত্র যদি ভুল বা তৈরি বলে কোনো পক্ষ মনে করে তাহলে তাদের আপত্তি জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কোনো ধরনের আপত্তি জানাননি, যা তাঁদের ভুল। এই ভুলের কারণে যুক্তিতর্ক শুনানির সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্য রায়ে বিবেচনা করা হয়নি।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামে কোনো তহবিল ছিল না মর্মে খালেদা জিয়ার পক্ষে দাবি করা হয়। ওই দাবিতে বলা হয়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠনের জন্যই কুয়েতের আমির টাকাটা অনুদান দিয়েছিলেন। এ জন্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কুয়েত দূতাবাসের একটি সনদ আদালতে দাখিল করেন ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর। ওই সনদে উল্লেখ আছে, কুয়েত সরকারের পক্ষ থেকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে টাকা দান করা হয়েছে। কোনো পৃথক ব্যক্তি বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য তা দেওয়া হয়নি।

আদালতে দাখিল করা কুয়েত দূতাবাসের ওই সনদ একটি ফটোকপি। ওই সনদে প্রেরকের বা সনদ প্রদানকারীর স্বাক্ষর কিংবা পদবির উল্লেখ নেই। নেই স্মারক নম্বরও। কত টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে তারও উল্লেখ নেই। আর সনদটি দেওয়া হয়েছে মো. আলী নামের একজন আইনজীবীকে।

আদালত এ প্রসঙ্গে রায়ে বলেন, খালেদা জিয়ার পক্ষে কেন এই চিঠি বা সনদটি দাখিল করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। মূল কপি দাখিল না করে ফটোকপি দাখিল করা হয়েছে। ফটোকপি বিচারিক বিবেচনায় নেওয়ার বিধান নেই। আর ওই ফটোকপি প্রমাণের জন্য কুয়েত দূতাবাসের কাউকে সাফাই সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়নি। ফটোকপিটির সত্যতা প্রমাণে খালেদা জিয়ার পক্ষে কোনো চেষ্টাও করা হয়নি। যে পত্রটি আদালতে দাখিল করা হয়েছে তাতে স্মারক নম্বর নেই। কে সনদটি দিয়েছেন তাঁর নাম-পদবিও নেই। কত টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে তা-ও নেই। আবার সনদটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে দেওয়া হয়নি। পররাষ্ট্রসচিবকেও দেওয়া হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মোহাম্মদ আলীর ঠিকানা। এটা বস্তবসম্মত নয়। সনদটি জাল বলেও আদালত মন্তব্য করেন। যে সনদ আদালতে দাখিল করা হয়েছে তার সত্যতা প্রমাণ না করা আইনজীবীদের আরেকটি ভুল।

আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামি খালেদা জিয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় বিধান মোতাবেক আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য দেওয়ার সময় নিজ জবানিতে স্বীকার করেছেন যে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ফলে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা (সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ) ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় তাঁকে শাস্তি দিতে কোনো বাধা নেই।

রায়ে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য উপস্থাপনের সময় (বক্তব্যের ৮৮ পৃষ্ঠায়) তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি।’ খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যের প্রতি পাতায় খালেদা জিয়ার স্বাক্ষর আছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে দিয়েছেন। যদিও রায়ে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া জ্ঞাতসারে হোক আর অজ্ঞাতসারে হোক ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।

খালেদা জিয়ার বক্তব্য আদালতে উপস্থাপনের পর এবং বক্তব্যের প্রতি পাতায় স্বাক্ষর দেওয়ার সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের দায়িত্ব ছিল কোনো ভুলত্রুটি আছে কি না তা যাচাই করা। কিন্তু তা করা হয়নি। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আইনজীবীদের এমন উদাসীনতা মানতে পারছেন না বিএনপিপন্থী অনেক আইনজীবী।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক পিপি এ এফ এম বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে এমন মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন না নেওয়ার মতো বড় ভুল আর হতে পারে না। এই ভুলের কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত হবে। আইনজীবীরা পরামর্শ দিলে তাঁর আত্মসমর্পণ না করার কোনো কারণ ছিল না। এখন আইনজীবীদের ভুলের খেসারত তাঁকে দিতে হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আলহাজ মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘এত বড় ভুল কেমন করে হলো তা খতিয়ে দেখা দরকার। একজন দলের চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে আছে, অথচ সেসব মামলায় হাজির হয়ে জামিন নেওয়া হয়নি। যে কারণে এক মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর প্রক্রিয়া চলছে। আর খালেদা জিয়ার মুক্তির দিনক্ষণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এটা তো অবশ্যই বড় ভুল।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, যেসব মামলায় পরোয়ানা জারি হয়েছিল তাতে আত্মসমর্পণ করে জামিন না নেওয়া বড় ভুল। এই ভুলের খেসারত অনেক দিন ধরে দিতে হবে। আইনজীবীরা খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কি না, তা যাঁরা মামলা পরিচালনা করেন তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। তবে কাজটি ঠিক হয়নি। এই সুযোগটি সরকার হাতছাড়া করছে না।

তিনি আরো বলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় খালেদা জিয়া নিজ বক্তব্যে বলবেন যে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে কোথাও ভুল হয়েছে। ওই ভুল শোধরানোর দায়িত্ব ছিল তাঁর আইনজীবীদের। তাঁরা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

খালেদা জিয়ার মূল আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানা উল্লা মিঞা গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘এটি আমাদের ভুল নয়। আমরা কৌশলগত কারণে এসব মামলায় আগে জামিন নেইনি।’ তবে কৌশল সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

তিনি আরো বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে আমরা এক ধরনের কৌশল নিয়েছিলাম, কিন্তু সরকার তাঁকে আটকে রাখতে আলাদা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। এই কৌশলকে হাতিয়ার করতে আদালতকে ব্যবহার করছে সরকার। আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাব এবং সফল হব। খালেদা জিয়া দ্রুত মুক্তি পাবেন।’

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

সীমান্ত হত্যা কখনোই মেনে নেওয়ার নয়: মির্জা ফখরুল

মুক্তি বিলম্বিত আইনজীবীদের ভুলে

আপডেট টাইম ০৭:৫৪:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মার্চ ২০১৮

আজম রেহমান,সারাদিন ডেস্ক:: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজা পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি কবে মিলবে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন দেওয়ার পর তা স্থগিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগে শুনানির পর যদি হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহালও রাখা হয় তার পরও তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ তাঁকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

গত ১২ মার্চ কুমিল্লার একটি হত্যা মামলায় এরই মধ্যে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে। আগামী ২৮ মার্চ এর জন্য শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। তার আগে ওই তারিখে তাঁকে হাজির করার জন্য কারাগারে প্রডাকশন ওয়ারেন্ট (পিডাব্লিউ) বা হাজিরা পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। এখন ওই মামলায় জামিন হওয়ার আগে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা আরো অন্তত পাঁচটি মামলায় তিনি জামিন নেননি। এ অবস্থায় সরকার যদি পর্যায়ক্রমে প্রতিটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায় তাহলে খালেদা জিয়ার মুক্তির তারিখ অনিশ্চিত।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভিন্ন মামলার নথি থেকে দেখা যায়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলায় আট যাত্রীকে হত্যার ঘটনায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় কুমিল্লার জজ আদালত গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর এবং হত্যা মামলায় কুমিল্লার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গত ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এ ছাড়া নড়াইলে দায়ের করা একটি এবং ঢাকায় দায়ের করা দুটি মানহানি মামলায় গত বছরের শেষ দিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

এসব মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর কিংবা মামলা দায়েরের পর খালেদা জিয়া আদালতে আত্মসমর্পণ করলে অবশ্যই তিনি জামিন পেতেন। কারণ ঢাকায় একটি হত্যা, একটি রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ৯টি নাশকতার মামলায় তিনি আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে জামিন দেওয়া হয়েছিল। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া মামলাগুলোতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের আগেই খালেদা জিয়া আত্মসমর্পণ করলে জামিন পেতেন। তাহলে বর্তমানে কারাগারে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার দেখানোর মতো আইনি প্যাঁচে তিনি পড়তেন না। পরোয়ানা জারি হওয়া মামলাগুলোতে খালেদা জিয়াকে আত্মসমর্পণ না করানো ছিল ভুল। এই ভুলের খেসারত বর্তমানে তাঁকে দিতে হচ্ছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা সঠিক পরামর্শ দিলে এই ভুলগুলো এড়ানো যেত।

খালেদা জিয়ার মুক্তি পেতে দেরি হওয়ার বিষয়ে কয়েক দিন আগে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আইনজীবীদের ভুলের কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত হচ্ছে।’ তবে তিনি ভুলের কারণ ব্যাখ্যা করেননি। ওই সময় খালেদা জিয়ার রায়ের নকল দিতে আদালতের বিলম্বের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেছেন, আইনজীবীদের ভুল নয়, সরকারি কূটকৌশলে খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আটকে রাখা হচ্ছে।

নথিতে দেখা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা পরিচালনায়ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বেশ কিছু ভুল করেছেন। ওই মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা, যার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ফৌজদারি কার্যবিধিতে অভিযোগ গঠনের সময় আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার একটি বিধান রয়েছে। এ জন্য আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে আবেদন করতে হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এ বিষয়ে আবেদন করেননি।

এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মাজেদ আলী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সাক্ষ্য দেন। তিনি সাক্ষ্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এতিম তহবিলের নথি, যাতে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন তহবিলের অর্থ মেয়াদি জমা (এফডিআির) সংক্রান্ত তথ্য, সোনালী ব্যাংক রমনা শাখার হিসাবসংক্রান্ত কাগজপত্র ও তথ্য, বগুড়া ও বাগেরহাটের এতিমখানা সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে তা আদালতে দাখিল করেন। এসব কাগজপত্র স্বাক্ষরবিহীন ও ঘষামাজা বলে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যুক্তিতর্কের সময় দাবি করেন। তাঁরা বলেন, এসব কাগজপত্র জাল ও সৃজিত। কিন্তু এসব কাগজপত্র যখন আদালতে উপস্থাপন করা হয় তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বিনা আপত্তিতে তা আদালত গ্রহণ করেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের ৫৪৭ পৃষ্ঠায় আদালত উল্লেখ করেন, খালেদা জিয়া বা তাঁর কৌঁসুলিরা কোনো প্রকার আপত্তি করেননি। আইন অনুযায়ী আদালতে দাখিল করা কোনো কাগজপত্র যদি ভুল বা তৈরি বলে কোনো পক্ষ মনে করে তাহলে তাদের আপত্তি জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কোনো ধরনের আপত্তি জানাননি, যা তাঁদের ভুল। এই ভুলের কারণে যুক্তিতর্ক শুনানির সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্য রায়ে বিবেচনা করা হয়নি।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামে কোনো তহবিল ছিল না মর্মে খালেদা জিয়ার পক্ষে দাবি করা হয়। ওই দাবিতে বলা হয়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠনের জন্যই কুয়েতের আমির টাকাটা অনুদান দিয়েছিলেন। এ জন্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কুয়েত দূতাবাসের একটি সনদ আদালতে দাখিল করেন ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর। ওই সনদে উল্লেখ আছে, কুয়েত সরকারের পক্ষ থেকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে টাকা দান করা হয়েছে। কোনো পৃথক ব্যক্তি বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য তা দেওয়া হয়নি।

আদালতে দাখিল করা কুয়েত দূতাবাসের ওই সনদ একটি ফটোকপি। ওই সনদে প্রেরকের বা সনদ প্রদানকারীর স্বাক্ষর কিংবা পদবির উল্লেখ নেই। নেই স্মারক নম্বরও। কত টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে তারও উল্লেখ নেই। আর সনদটি দেওয়া হয়েছে মো. আলী নামের একজন আইনজীবীকে।

আদালত এ প্রসঙ্গে রায়ে বলেন, খালেদা জিয়ার পক্ষে কেন এই চিঠি বা সনদটি দাখিল করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। মূল কপি দাখিল না করে ফটোকপি দাখিল করা হয়েছে। ফটোকপি বিচারিক বিবেচনায় নেওয়ার বিধান নেই। আর ওই ফটোকপি প্রমাণের জন্য কুয়েত দূতাবাসের কাউকে সাফাই সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়নি। ফটোকপিটির সত্যতা প্রমাণে খালেদা জিয়ার পক্ষে কোনো চেষ্টাও করা হয়নি। যে পত্রটি আদালতে দাখিল করা হয়েছে তাতে স্মারক নম্বর নেই। কে সনদটি দিয়েছেন তাঁর নাম-পদবিও নেই। কত টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে তা-ও নেই। আবার সনদটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে দেওয়া হয়নি। পররাষ্ট্রসচিবকেও দেওয়া হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মোহাম্মদ আলীর ঠিকানা। এটা বস্তবসম্মত নয়। সনদটি জাল বলেও আদালত মন্তব্য করেন। যে সনদ আদালতে দাখিল করা হয়েছে তার সত্যতা প্রমাণ না করা আইনজীবীদের আরেকটি ভুল।

আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামি খালেদা জিয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় বিধান মোতাবেক আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য দেওয়ার সময় নিজ জবানিতে স্বীকার করেছেন যে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ফলে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা (সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ) ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় তাঁকে শাস্তি দিতে কোনো বাধা নেই।

রায়ে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য উপস্থাপনের সময় (বক্তব্যের ৮৮ পৃষ্ঠায়) তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি।’ খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যের প্রতি পাতায় খালেদা জিয়ার স্বাক্ষর আছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে দিয়েছেন। যদিও রায়ে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া জ্ঞাতসারে হোক আর অজ্ঞাতসারে হোক ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।

খালেদা জিয়ার বক্তব্য আদালতে উপস্থাপনের পর এবং বক্তব্যের প্রতি পাতায় স্বাক্ষর দেওয়ার সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের দায়িত্ব ছিল কোনো ভুলত্রুটি আছে কি না তা যাচাই করা। কিন্তু তা করা হয়নি। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আইনজীবীদের এমন উদাসীনতা মানতে পারছেন না বিএনপিপন্থী অনেক আইনজীবী।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক পিপি এ এফ এম বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে এমন মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন না নেওয়ার মতো বড় ভুল আর হতে পারে না। এই ভুলের কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত হবে। আইনজীবীরা পরামর্শ দিলে তাঁর আত্মসমর্পণ না করার কোনো কারণ ছিল না। এখন আইনজীবীদের ভুলের খেসারত তাঁকে দিতে হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আলহাজ মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘এত বড় ভুল কেমন করে হলো তা খতিয়ে দেখা দরকার। একজন দলের চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে আছে, অথচ সেসব মামলায় হাজির হয়ে জামিন নেওয়া হয়নি। যে কারণে এক মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর প্রক্রিয়া চলছে। আর খালেদা জিয়ার মুক্তির দিনক্ষণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এটা তো অবশ্যই বড় ভুল।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, যেসব মামলায় পরোয়ানা জারি হয়েছিল তাতে আত্মসমর্পণ করে জামিন না নেওয়া বড় ভুল। এই ভুলের খেসারত অনেক দিন ধরে দিতে হবে। আইনজীবীরা খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কি না, তা যাঁরা মামলা পরিচালনা করেন তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। তবে কাজটি ঠিক হয়নি। এই সুযোগটি সরকার হাতছাড়া করছে না।

তিনি আরো বলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় খালেদা জিয়া নিজ বক্তব্যে বলবেন যে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে কোথাও ভুল হয়েছে। ওই ভুল শোধরানোর দায়িত্ব ছিল তাঁর আইনজীবীদের। তাঁরা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

খালেদা জিয়ার মূল আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানা উল্লা মিঞা গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘এটি আমাদের ভুল নয়। আমরা কৌশলগত কারণে এসব মামলায় আগে জামিন নেইনি।’ তবে কৌশল সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

তিনি আরো বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে আমরা এক ধরনের কৌশল নিয়েছিলাম, কিন্তু সরকার তাঁকে আটকে রাখতে আলাদা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। এই কৌশলকে হাতিয়ার করতে আদালতকে ব্যবহার করছে সরকার। আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাব এবং সফল হব। খালেদা জিয়া দ্রুত মুক্তি পাবেন।’