একটি বৈদ্যুতিক বাল্বকে কতভাবে কাজে লাগানো যায়, তার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে সবাইকে চমকে দিয়েছিল এক কিশোর। চট্টগ্রাম সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র তারিক আমিন চৌধুরী বৈদ্যুতিক বাল্বে এমন কিছু সেন্সর লাগিয়েছিল, যার মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে মুঠোফোনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বাল্বটি যে ঘরে লাগানো হবে, তার ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কী ঘটছে তার তথ্য আহরণ করা সম্ভব। মুঠোফোনের স্ক্রিনে এসব চিত্র যেকোনো জায়গা থেকে দেখা যাবে। বাল্বে স্থাপিত সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ঘরে চোর-ডাকাত বা অচেনা কেউ ঢুকল কি না, তা যেমন দেখা যাবে, আবার ঘরে আগুন ধরলে বা গ্যাস ছড়ালে তা-ও দেখা যাবে। অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। এই সবকিছু সংযোজিত হবে বাল্বের সঙ্গেই। এই উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তারিক সহযোগিতা পেয়েছে অগ্রজপ্রতিম শান্তনু ভট্টাচার্যের। শান্তনু চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র।
তারিক আমিনের এই কৃতিত্বের কথা আজ নতুন করে কেন উল্লেখ করার দরকার পড়ল, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে উদ্ভাবনের বিষয়টা আর একটু খোলাসা করি। ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠান বিএমসির ‘স্মার্ট বাল্ব’ নামে একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব বাজারে পাওয়া যায়, যেটি বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়াই তিন ঘণ্টা আলো দিতে পারে। সেই বাল্বকেই আরও উন্নত ও বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার চিন্তা থেকেই মূলত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কাজটি শুরু করেছিলেন তারিক ও শান্তনু।
চট্টগ্রামের দুটি প্রযুক্তি মেলায় বৈদ্যুতিক বাল্বের এই বহুমুখী ব্যবহারের প্রকল্পটি প্রদর্শিত হলে বেশ সাড়া পড়ে। সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয় এই অভিনব ভাবনার কথা। তারিক তখন সাংবাদিকদের বলেছিল, নানা ধরনের সেন্সর ব্যবহারের মাধ্যমে তারা বাল্বটিকে নানা মাত্রায় ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে চেয়েছে। এমকিউ ২ (গ্যাস সেন্সর), এলডিআর (আলোর পরিমাণ নির্ণয়) ও পিআইআরসহ (তাপমাত্রা-আর্দ্রতা নির্ণায়ক) নানা সেন্সর স্থাপন করা হয়েছে বাল্বের মধ্যে। ব্লুটুথ ও ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এই বাল্বকে।
এর মধ্যে তারিকের প্রযুক্তিটি কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বিএমসি। তারা তারিকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক আনুকূল্যে বাল্বটিকে আরও উন্নতমানের ও ত্রুটিমুক্ত করতে কাজ করবে তারিকেরা। প্রাথমিকভাবে ১ লাখ বাল্ব বাজারে আনার চুক্তি হয়েছে। এটা ২০১৭ সালের শেষের দিকের ঘটনা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে এটিই তারিকের একমাত্র উদ্যোগ নয়; এর আগে ‘মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের’ একটি প্রযুক্তি প্রদর্শন করে তারিক পেয়েছিল চট্টগ্রাম বিসিএসআইআর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলা ২০১৫-এর প্রথম পুরস্কার। সে সময় জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহে তৃতীয় স্থান পেয়েছিল তার উদ্ভাবন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে যে ছেলেটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকে, নতুন আবিষ্কারের নেশা যাকে উদ্দীপ্ত করে রাখে, সেই ছেলেটি পরিণত বয়সে দেশ ও সমাজের বড় সম্পদ হবে, পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে-এটাই তো ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু হায়, গল্পটি সেভাবে এগোল না। একদিন সংবাদমাধ্যমে যে কিশোরটির ছবি ছাপা হয়েছিল অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য, সেই তারিক এসএসসি পরীক্ষার হল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে মাথা নিচু করে ফিরে গেছে ঘরে। তার অপরাধ কী? অপরাধ, প্রশ্নপত্রের পাশে টিক চিহ্ন দিয়েছিল সে।
আমরা যারা এসএসসি, এইচএসসি বা অন্যান্য পরীক্ষা অতিক্রম করে এসেছি, প্রায় সবাই তো বাড়িতে এসে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্নপত্রে যে উত্তরটি সঠিক বিবেচনা করেছি তাতে টিক চিহ্ন দিতাম। এখনো সেই নিয়মের সঙ্গেই তো অভ্যস্ত ছাত্রছাত্রীরা। প্রশ্নপত্রে কোনো দাগ দেওয়া যাবে না-এমন নিয়ম বা নির্দেশনা কি আদৌ দেওয়া আছে? প্রশ্নপত্রে টিক চিহ্ন দেওয়া মানে কি নকল করা?
সন্দেহ করা আর নিশ্চিত হওয়া একই ব্যাপার নয়। সন্দেহের বশে তারিক আমিনসহ তিন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের আগে ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের আরও অন্তত দুবার ভাবা উচিত ছিল। কেননা, বহিষ্কার সর্বশেষ ধাপ। ক্ষমতা তাঁর আছে, কিন্তু সেটা প্রয়োগ করার আগে ভাবতে হবে একজন শিক্ষার্থীর এই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা তার নিজের জীবনে, মা-বাবা-পরিবার, এমনকি সমাজে কী পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় বিস্মিত ও হতাশ দেশের মানুষ। কেউই রোধ করতে পারছে না এই সর্বনাশা প্রবণতা। তাৎক্ষণিক নানা রকম নিয়মনীতি বা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেটের গতি কমানো, পরীক্ষা কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে মুঠোফোন নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বা প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা ইত্যাদি সত্ত্বেও প্রশ্নপত্র ফাঁস অব্যাহত রয়েছে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার মতো ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর চেষ্টা চলছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল হোতাদের শনাক্ত করতে না পেরে প্রশাসন চড়াও হয়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। প্রশ্নপত্রে টিক চিহ্ন দেওয়ার মতো অপরাধের জন্য শিক্ষার্থী বহিষ্কারের ঘটনা তারই একটি বড় উদাহরণ। এই ঘটনার প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীদের কয়েকজন অভিভাবককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পরীক্ষা কেন্দ্রগামী একটি বাসে অভিযান চালিয়ে পুলিশ বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে আটক করে। তাদের মুঠোফোনে প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে-এই অভিযোগে ২৪ জনকে বহিষ্কার এবং ৯ জনকে আটক করা হয়। এ ছাড়া ওই দিন সারা দেশে মোট ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
যাদের মুঠোফোনে প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে, তারা তো প্রশ্ন ফাঁস করেনি। এই কিশোরেরা হয় কৌতূহল, নয়তো প্রলোভনের শিকার হয়েছে। দেশজুড়ে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে যে তোলপাড় ঘটছে, তাতে পরীক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত না হওয়ার তো কারণ দেখি না। শিক্ষাব্যবস্থাটাই যেখানে পরীক্ষাকেন্দ্রিক ও ফলাফলনির্ভর, সেখানে সুযোগ পেলে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা এটুকু সুযোগ নেবে না-এটা ভাবা কতটা বাস্তবসম্মত?
সংবাদপত্রের পাতায় আটক ছাত্রদের ছবি দেখেছি। ক্যামেরা থেকে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করছে তারা। অন্য রকম হতে পারত গল্পটা। এই কিশোর-তরুণদের ছবি তাদের কৃতিত্বের জন্য, প্রতিভা ও সৃজনশীলতার জন্য সংবাদপত্রের পাতায় স্থান করে নিতে পারত। কিন্তু আমরা তারিক আমিনের সাফল্যের ছবিটা যেমন মুছে দিয়েছি, তেমনি এদের সম্ভাবনার পথটাও রুদ্ধ করে দিলাম। আগামী প্রজন্ম কি আমাদের ক্ষমা করে।