ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : ঠাকুরগাঁওয়ে মাধ্যমিক, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি নিয়োগসহ শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এতে করে একদিকে যেমন সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষূন্ন হচ্ছে, অপরদিকে দূর্নীতিকে উসকিয়ে দিচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা ১৩৭টি উচ্চ ও নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে ২টি সরকারি বিদ্যালয়। ১৩৫টি বিদ্যালয় এমপিও ভূক্ত। পরিসংখ্যান বলছে গত দুই বছরে ১৩৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫০টির অধিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি নিয়োগসহ শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। আর গড়ে প্রতিটি পদের জন্য নেওয়া হয় ১০-১২ লাখ টাকা। যে টাকা বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ডনেশন ফান্ডে জমা করার কথা। কিন্ত বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সেই টাকা যায় উপরমহল থেকে শুরু করে ডিজির প্রতিনিধি, এসএমসি সভাপতি, প্রধান শিক্ষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে।
জেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নে অবস্থিত পাহাড়ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয়ে সম্প্রতি কম্পিউটার ল্যাব অপারেট, অফিস সহকারি, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নৈশ প্রহরী এবং অফিস সহায়কসহ ৬টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এতে বিভিন্ন পদে আবেদন করেন ৫১ প্রার্থী। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে ৫টি পদে প্রার্থীকে গুনতে হয় ১০-১২ লাখ টাকা। অপরদিকে কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর পদে গুনতে হয় ১৯-২০ লাখ টাকা।
শুধু এই স্কুলেই নয়, এই চিত্র ঠাকুরগাঁওয়ের অন্য বিদ্যালয় গুলোতেও। আবার কোথাও কোথাও নিয়োগকে কেন্দ্র আদালতে মামলারও ঘটনা ঘটেছে। আর ঘটনা গুলো ঘটছে সরকার দলীয় প্রভাবশালী এক নেতার হস্তক্ষেপেই। যদিও এ ব্যাপারে কেউ সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি। আর এই ঘুষের টাকা যোগাড় করতে গিয়ে গরু-ছাগল, ফসলি জমি, গয়নাসহ (সোনা) বিক্রি করে নি:শ^ হয়ে পড়েছেন অনেকে।
কম্পিউটার ল্যাব অপারেট পদে প্রার্থী ছিলেন সুমি কাউছার, তিনি বলেন আমাকে স্কুলে চাকুরী দিবে এই মর্মে প্রধান শিক্ষক এবং এসএমসির সভাপতি আমাদের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নেয়। পরে পরীক্ষার দিন আরো ৪ লাখ টাকায় চায়। আমরা তরিঘরি করে সেই টাকাও দেই। এ নিয়ে ১২ লাখ টাকা নেয়। নিয়োগ পরীক্ষার আগের দিন তারা আমাকে প্রশ্নপত্র দেয়। সেই প্রশ্ন পত্রেই পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা আমার ভালো হয়েছে। কিন্তু পরে রেজাল্টে সময় জানতে পারি আমার হয়নি। আমি অনেক কষ্ট করে, ফসলের জমি, বাবার বাড়ি থেকে টাকা এবং গয়নাগাটি বিক্রি করে এই টাকা দেই। যদি হবেই না, তাহলে কেন আমাদের কাছে টাকা নিল এবং এতো বড় ক্ষতি করাইল। এক সময় কেঁদে ফেলেন, আর কথা গুলো বলতে পারেননি।
সুমি কাউছারের স্বামী সোহাগ হোসেন বলেন যে প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছিল সেই প্রশ্নপত্রেই পরীক্ষা হয়। চাকুরি না হওয়ার পরে সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষককে যখন বলি কেন হলো না ? তখন তারা বলেন উপর মহলের চাপ ছিল, ওই প্রার্থীর কাছ থেকে ১৯ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে।
নৈশ প্রহরী পদে আবেদনকারি খাদেমুল ইসলাম বলেন চাকুরি দেওয়ার নাম করে আমার কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা নেয় সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষক। সেই টাকা জমি বন্ধক, গরু-ছাগল বিক্রী করে টাকা দেই। কিন্তু পরে চাকুরিও দিলো, মাঝখানে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করালো। নৈশ প্রহরী পদে আরেক আবেদনকারি প্রার্থীর ভাই হাকিম বলেন সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষকের সাথে রফাদফা হয় ১০ টাকায়। প্রথমে ৪ লাখ টাকা নেয়। পরে আরও ৬ লাখ টাকা নেয়। কিন্তু পরে চাকুরিও হলো না, মাঝখানে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করালো। নৈশ পদে আরেক প্রার্থী বলেন ৬টি পদে লোক নিবে। টাকা নিছে ১৯ জনের কাছে। যার কাছে যেমন পারে। এই পদে চার জন আবেদন করে ৪ জনের কাছেই টাকা নেয়।
পাহাড়ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কফিল উদ্দীন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন এটা সম্পূন্ন ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট। চাকুরি না হওয়ায় তারা এধরনের কথা গুলো বলছেন। তিনি এক পর্যায় বলেন আপনারা তো জায়গা মতো কথা বলতে পারেন না।
পাহাড়ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক বলেন পরীক্ষা অনেকে দিয়েছে, সবাই তো পাশ করতে পারেনি, যারা পাশ করেছে তাদের নেওয়া হয়েছে। যাদের হয়নি, তারা বিভিন্ন কথা বলে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও কথা হয় সদর উপজেলা বেশ কয়েকজন প্রধান শিক্ষক এবং সভাপতির সাথে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে তারা জানালেন অসহায়েত্বর কথা।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল রহমান বলেন নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন কথা আমরা শুনি। এটা স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ হয়। কেউ আমাদের এখানে এসে চাকুরির জন্য ধন্যা দিয়েছে আমার জানা নেই। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু তাহের মো. সামসুজ্জান সংশ্লিষ্ট দফতরের বিষয় জাানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি দূর্নীতি এবং ফৌজদারি অপরাধ। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতর এবং অধিদপ্তরকে দায়িত্ব নিতে হবে।