ঢাকা ০৫:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম

দেশে দেশে ভোটের রাজনীতি ও দুর্নীতি

সুধীর সাহা: যত দিন যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী রাজনীতির বিজ্ঞান যেন ততই কঠিন হচ্ছে। বিস্তর হোমওয়ার্ক প্রয়োজন। মিডিয়া আগের চেয়ে অনেকটাই সক্রিয়। রাজনীতির সবটাই দেখছে এখন মিডিয়া। শাসক-বিরোধীর লড়াইটা কিংবা কোন রাজনীতিক হাতে কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরছেন-সবটাই দেখছে মিডিয়া এবং তা প্রচার করছে। তাই রাজনীতির হিসাবটা আরও কঠিন হয়েছে। অতীত-বর্তমান ঘেঁটে বের করে আনতে হয় বিরোধীপক্ষের দুর্বল জায়গা। তারপর প্রস্তুতি নিয়ে আঘাত করতে হয় সেখানে। অক্লান্ত প্রক্রিয়া-থেমে থাকার পথ নেই। একজন যে রাজনৈতিক ক্রিয়া করবে, অন্যজন ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে। কারণ ক্রিয়ার পরেই প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হবে। যেন নিউটনের তৃতীয় সূত্র। প্রতিপক্ষ দলের কৌশলকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। আবার প্রয়োজন হলে আশ্রয় নিতে হবে ‘ওপেন এআই’-এর সিইও স্যামুয়েল অল্টম্যানের পরিকল্পিত চ্যাট জিপিটির কাছে। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা চ্যাট জিবিটি একের পর এক তার ভার্সন তৈরি করছে। ইতোমধ্যেই বাজারে এসেছে জিপিটি-৪। হিসাব বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ সফটওয়্যারটি অন্তত ২০টি চাকরির বাজার শেষ করে দিতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষক, আইনজীবী, রিপোর্টার, ট্রাভেল এজেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারের মতো পোস্ট। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা শুধু ফেসবুকের তথ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একটা গোটা নির্বাচনের নিয়তি বদলে দিয়েছিল। আর জিপিটি-৪ তো দাবি করেছে, এটি এক মাসের মধ্যে ইউটিউবে টাকা কামানো, সোশ্যাল মিডিয়ার এনক্রিপটেড অ্যাকাউন্টে ঢুকে পড়া, এমনকি টুইটারের অ্যালগরিদম ভেঙে দিতে পারে।

সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে বিভিন্ন রাজনীতিক, তাদের ঘনিষ্ঠজন এবং কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাল্লা দিয়ে অভিযোগ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। অভিযুক্ত হওয়া মানেই এ কথা বলা যাবে না যে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে নিশ্চয়ই। প্রমাণ কিংবা অপ্রমাণ হওয়ার বিষয়টি অবশ্য বেশ দীর্ঘমেয়াদি একটি আইনি প্রক্রিয়া। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়াল এবং জনতার আদালতে এর সমাধান হয়ে যায় চটজলদি অনেক ক্ষেত্রেই। দেশে এ নিয়ে কখনো কোনো সফল সমীক্ষা হয়নি। কিন্তু ভারতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে একটি সমীক্ষা করে লোকনীতি-সিএসডিএস। এখনকার মতো সে সময়েও ভারতের আকাশে-বাতাসে অনেক দুর্নীতির অনুরণন ছিল। সমীক্ষায় দেখা গেছে, টেনেটুনে ৫০ শতাংশ মানুষ তখন কয়লা দুর্নীতির কথা শুনেছে, টুজি কেলেঙ্কারির নাম শুনেছে ৪০ শতাংশ, আর অন্যান্য দুর্নীতির কথা শুনেছে এক-তৃতীয়াংশেরও কম মানুষ। ভারতে এমন অবস্থা হলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশে এমন একটি সমীক্ষার হিসাব হবে আরও অনেক কমের দিকে। রাজনৈতিক নেতাদের এসব নিয়ে একেবারেই গবেষণা কিংবা প্রস্তুতি নেই। তাই ভোটাররা দুর্নীতি সম্পর্কে যেভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতারা যেভাবে তাদের প্রচারে এ বিষয়টিকে তুলে ধরেন-এ দুয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থেকে যায়।

রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতির প্রশ্নটিকে একটা চমক হিসাবে উপস্থাপনায় বেশি আগ্রহী। ওদিকে ভোটাররা বড়োসড়ো দুর্নীতির চেয়েও তাদের প্রাত্যহিক দিনযাপন সম্পর্কে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। স্থানীয় পর্যায়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যে দুর্নীতির মুখোমুখি হয় মানুষ, তার প্রতিকার চায় তারা; তারা নেতার কাছে চায় তার সমাধান। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও কাজ করাতে তাদের কাউকে চিনতে হয় বা ঘুস দিতে হয়। তারা চায় এমন ছোট ছোট দুর্নীতির সমাধান। যেহেতু রাজনীতিকদের গবেষণা নেই, স্টাডি নেই, স্থানীয় পর্যায়ের তথ্য নেই-তাই তারা তাদের প্রচারে এসব বিষয়ে সঠিক উত্তর নিয়ে ভোটারের সামনে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হয়। সরকারি দলের রাজনীতিকরা মনে করেন, কোনো বিরোধী রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দিতে পারলেই ভোটাররা তার প্রতি বিমুখ হবে। এমন সহজ সূত্রের বরং উলটোটাই হয় অনেক ক্ষেত্রে।

২০২০ সালে আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টার চারটি দেশে ভোটে দুর্নীতির প্রভাবের ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাতে নিজের দেশের বেশির ভাগ রাজনীতিকই দুর্নীতিগ্রস্ত-এমন বক্তব্যে সহমত হয় ৬৭ শতাংশ আমেরিকান, ৪৬ শতাংশ ফরাসি, ৪৫ শতাংশ ব্রিটিশ এবং ২৯ শতাংশ জার্মান ভোটার। এমন অবস্থার পরিবর্তন দেখেছিলাম আমরা ভারতে; আশির দশকের শেষে বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে তৈরি হওয়া ঝড়ে যখন উড়ে গিয়েছিল রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস। এমন সত্যের পরও এক কথায় বলা যাবে না, শুধু দুর্নীতির প্রশ্নই রাজনীতির পাশা উলটে দিতে পারে। কোনো এক অনুকূল পরিস্থিতিতে উপযুক্ত দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা দুর্নীতি না করার প্রতিশ্রুতি সলতেতে আগুনের স্ফুলিঙ্গটুকুর জোগান হয়তো দিতে পারে; কিন্তু সব ক্ষেত্রে এটিই যে হবে একমাত্র উত্তর অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা মানেই তাদের জনসমর্থনে ফাটল ধরা-বিষয়টির সমীকরণ এত সরল নয়। সোশ্যাল মিডিয়াবিধ্বস্ত আজকের প্রচার এবং পালটা প্রচারের যুগে অভিযোগ ও পালটা অভিযোগ-সবকিছু মিলেমিশে অনেকটা ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে। আবার কখনো অতি ব্যবহারেও জীর্ণ হয়ে যেতে পারে ধারালো অস্ত্রখানা।

রাজনীতিতে আজকের সমস্যা দুর্নীতি থেকে ঘুরে গেছে অন্যদিকে। সাংবিধানিক পথেই আজ দেশে দেশে গণঅধিকারের সব রক্ষাকবচ একে একে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হচ্ছে। আইন-আদালত, সংবিধান এড়িয়ে অঘোষিত এজেন্ডা অনুযায়ী রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধীদের কবজি ভেঙে দেওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়। সংসদকে নিষ্ক্রিয় করা হয়। মিডিয়াকে কাজে লাগানো হয় কিংবা কথা না শুনলে ভয়ের মধ্যে রাখা হয়। আমেরিকার অসংখ্য মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে সেদেশের জাতীয় রাজনীতির একটি বিষয়। দল নির্বিশেষে যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির সেই ভয়ংকর দিনটির স্মৃতি ভুলতে পারছে না, যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো-বাইডেনের কাছে ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর স্বয়ং ট্রাম্পের উত্তেজক বক্তৃতায় ক্ষিপ্ত-উত্তপ্ত-বিশৃঙ্খল ভক্তের দল ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় সাতাশ লাখ ডলার মূল্যের সরকারি সম্পত্তি বিনষ্ট করে। ওই ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয় এবং ১৩৮ জন পুলিশ অফিসারসহ বহু মানুষ আহত হন। ঘটনার অভিঘাতে পরে চারজন পুলিশকর্মী আÍহত্যা করে। তদানীন্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স যখন বেআইনি দাবি মেনে ভোট গণনার ফলাফল উলটে দিতে অস্বীকার করেন, তখন ট্রাম্পভক্ত দাঙ্গাবাজরা একটি ফাঁসিকাঠ স্থাপন করে আওয়াজ তোলে-‘মাইক পেন্সকে ফাঁসিতে ঝোলাও’। আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারলে ট্রাম্প যে প্রথাগতভাবে আইনসভার, বিশেষ করে সিনেটের পরামর্শ ও অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়ালখুশি মতো চলবেন, এমন শঙ্কায় ভুগছে অনেকেই।

শুধু আমেরিকায় নয়, সম্প্রতি ইসরাইলের চরমপন্থি শাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে সেখানকার সাধারণ মানুষ। ইসরাইল ফুঁসছে, লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামছে। ছাত্র, শ্রমিক, কর্মচারী থেকে শুরু করে সমাজের নানা অংশের মানুষ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু চাচ্ছেন সেদেশের বিচারব্যবস্থা করায়ত্ত করতে। কিছুদিন আগে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, এ বিচারব্যবস্থার পরিবর্তনে হয়তো সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমস্যা তৈরি হতে পারে। মন্ত্রিপরিষদের সেই সদস্যকে নেতানিয়াহু বহিষ্কার করার পর মানুষ সেখানে আরও বেশিমাত্রায় রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। তাদের হাতে ব্যানার-‘কোনো মানুষই আইনের ঊর্ধ্বে নয়’। ইসরাইলের মতো অন্যান্য দেশেও চরমপন্থি শাসনের বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামছে। মজার তথ্য হলো, দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়েই নেতানিয়াহু ইসরাইলিদের ভোটে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; কিন্তু তখন মানুষ তাকে ভোট দিলেও স্বৈরতন্ত্রের অভিযোগ এখন তাকে ছেড়ে কথা বলছে না। কোথাও ট্রাম্প, কোথাও বলসোনারো, কোথাও নেতানিয়াহু-চরমপন্থি শাসকরা মানুষের রোষের শিকার হচ্ছেন।

এ ধরনের চরমপন্থি শাসকরা মানতেই চান না যে, সরকারকে সমালোচনা করার অধিকার আছে নাগরিকের। তাই অনেক দেশে সরকারবিরোধী প্রচার করার অভিযোগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফ্যামকে বিদায় নিতে হয়; বিবিসি অফিস রেড করা হয়; টুইটার-ফেসবুককে কবজা করতে আইন সংশোধন করা হয়। এসব দেশের অনেকেরই ধারণা, সেখানে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর হয়তো কালের নিয়মে সামাজিক পরিবর্তনের সূত্র অনুযায়ী মানুষ একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। আর তা হওয়ার প্রধান একটি সময় হলো ভোটের সময়। চরমতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে পারলে আখেরে তাদেরই লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের শি জিনপিং এবং রাশিয়ার পুতিনের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ থাকলেও রাস্তায় নামার সুযোগ সেখানে সাধারণ মানুষের নেই। সাধারণ মানুষের ভোটের সুযোগও সেখানে পরিপূর্ণভাবে নেই। তাই ওসব দেশে মানুষ নীরবে মেনে নিচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ। কিন্তু গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় মানুষ ফুঁসে উঠছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে-তারই সাম্প্রতিক প্রমাণ ইসরাইল।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

ঠাকুরগাঁয়ে যুবলীগ নেতার পলিথিন কারখানা বন্ধ, মালামাল জব্দ

দেশে দেশে ভোটের রাজনীতি ও দুর্নীতি

আপডেট টাইম ১০:০০:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ মে ২০২৩

সুধীর সাহা: যত দিন যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী রাজনীতির বিজ্ঞান যেন ততই কঠিন হচ্ছে। বিস্তর হোমওয়ার্ক প্রয়োজন। মিডিয়া আগের চেয়ে অনেকটাই সক্রিয়। রাজনীতির সবটাই দেখছে এখন মিডিয়া। শাসক-বিরোধীর লড়াইটা কিংবা কোন রাজনীতিক হাতে কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরছেন-সবটাই দেখছে মিডিয়া এবং তা প্রচার করছে। তাই রাজনীতির হিসাবটা আরও কঠিন হয়েছে। অতীত-বর্তমান ঘেঁটে বের করে আনতে হয় বিরোধীপক্ষের দুর্বল জায়গা। তারপর প্রস্তুতি নিয়ে আঘাত করতে হয় সেখানে। অক্লান্ত প্রক্রিয়া-থেমে থাকার পথ নেই। একজন যে রাজনৈতিক ক্রিয়া করবে, অন্যজন ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে। কারণ ক্রিয়ার পরেই প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হবে। যেন নিউটনের তৃতীয় সূত্র। প্রতিপক্ষ দলের কৌশলকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। আবার প্রয়োজন হলে আশ্রয় নিতে হবে ‘ওপেন এআই’-এর সিইও স্যামুয়েল অল্টম্যানের পরিকল্পিত চ্যাট জিপিটির কাছে। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা চ্যাট জিবিটি একের পর এক তার ভার্সন তৈরি করছে। ইতোমধ্যেই বাজারে এসেছে জিপিটি-৪। হিসাব বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ সফটওয়্যারটি অন্তত ২০টি চাকরির বাজার শেষ করে দিতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষক, আইনজীবী, রিপোর্টার, ট্রাভেল এজেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারের মতো পোস্ট। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা শুধু ফেসবুকের তথ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একটা গোটা নির্বাচনের নিয়তি বদলে দিয়েছিল। আর জিপিটি-৪ তো দাবি করেছে, এটি এক মাসের মধ্যে ইউটিউবে টাকা কামানো, সোশ্যাল মিডিয়ার এনক্রিপটেড অ্যাকাউন্টে ঢুকে পড়া, এমনকি টুইটারের অ্যালগরিদম ভেঙে দিতে পারে।

সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে বিভিন্ন রাজনীতিক, তাদের ঘনিষ্ঠজন এবং কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাল্লা দিয়ে অভিযোগ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। অভিযুক্ত হওয়া মানেই এ কথা বলা যাবে না যে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে নিশ্চয়ই। প্রমাণ কিংবা অপ্রমাণ হওয়ার বিষয়টি অবশ্য বেশ দীর্ঘমেয়াদি একটি আইনি প্রক্রিয়া। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়াল এবং জনতার আদালতে এর সমাধান হয়ে যায় চটজলদি অনেক ক্ষেত্রেই। দেশে এ নিয়ে কখনো কোনো সফল সমীক্ষা হয়নি। কিন্তু ভারতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে একটি সমীক্ষা করে লোকনীতি-সিএসডিএস। এখনকার মতো সে সময়েও ভারতের আকাশে-বাতাসে অনেক দুর্নীতির অনুরণন ছিল। সমীক্ষায় দেখা গেছে, টেনেটুনে ৫০ শতাংশ মানুষ তখন কয়লা দুর্নীতির কথা শুনেছে, টুজি কেলেঙ্কারির নাম শুনেছে ৪০ শতাংশ, আর অন্যান্য দুর্নীতির কথা শুনেছে এক-তৃতীয়াংশেরও কম মানুষ। ভারতে এমন অবস্থা হলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশে এমন একটি সমীক্ষার হিসাব হবে আরও অনেক কমের দিকে। রাজনৈতিক নেতাদের এসব নিয়ে একেবারেই গবেষণা কিংবা প্রস্তুতি নেই। তাই ভোটাররা দুর্নীতি সম্পর্কে যেভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতারা যেভাবে তাদের প্রচারে এ বিষয়টিকে তুলে ধরেন-এ দুয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থেকে যায়।

রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতির প্রশ্নটিকে একটা চমক হিসাবে উপস্থাপনায় বেশি আগ্রহী। ওদিকে ভোটাররা বড়োসড়ো দুর্নীতির চেয়েও তাদের প্রাত্যহিক দিনযাপন সম্পর্কে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। স্থানীয় পর্যায়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যে দুর্নীতির মুখোমুখি হয় মানুষ, তার প্রতিকার চায় তারা; তারা নেতার কাছে চায় তার সমাধান। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও কাজ করাতে তাদের কাউকে চিনতে হয় বা ঘুস দিতে হয়। তারা চায় এমন ছোট ছোট দুর্নীতির সমাধান। যেহেতু রাজনীতিকদের গবেষণা নেই, স্টাডি নেই, স্থানীয় পর্যায়ের তথ্য নেই-তাই তারা তাদের প্রচারে এসব বিষয়ে সঠিক উত্তর নিয়ে ভোটারের সামনে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হয়। সরকারি দলের রাজনীতিকরা মনে করেন, কোনো বিরোধী রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দিতে পারলেই ভোটাররা তার প্রতি বিমুখ হবে। এমন সহজ সূত্রের বরং উলটোটাই হয় অনেক ক্ষেত্রে।

২০২০ সালে আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টার চারটি দেশে ভোটে দুর্নীতির প্রভাবের ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাতে নিজের দেশের বেশির ভাগ রাজনীতিকই দুর্নীতিগ্রস্ত-এমন বক্তব্যে সহমত হয় ৬৭ শতাংশ আমেরিকান, ৪৬ শতাংশ ফরাসি, ৪৫ শতাংশ ব্রিটিশ এবং ২৯ শতাংশ জার্মান ভোটার। এমন অবস্থার পরিবর্তন দেখেছিলাম আমরা ভারতে; আশির দশকের শেষে বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে তৈরি হওয়া ঝড়ে যখন উড়ে গিয়েছিল রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস। এমন সত্যের পরও এক কথায় বলা যাবে না, শুধু দুর্নীতির প্রশ্নই রাজনীতির পাশা উলটে দিতে পারে। কোনো এক অনুকূল পরিস্থিতিতে উপযুক্ত দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা দুর্নীতি না করার প্রতিশ্রুতি সলতেতে আগুনের স্ফুলিঙ্গটুকুর জোগান হয়তো দিতে পারে; কিন্তু সব ক্ষেত্রে এটিই যে হবে একমাত্র উত্তর অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা মানেই তাদের জনসমর্থনে ফাটল ধরা-বিষয়টির সমীকরণ এত সরল নয়। সোশ্যাল মিডিয়াবিধ্বস্ত আজকের প্রচার এবং পালটা প্রচারের যুগে অভিযোগ ও পালটা অভিযোগ-সবকিছু মিলেমিশে অনেকটা ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে। আবার কখনো অতি ব্যবহারেও জীর্ণ হয়ে যেতে পারে ধারালো অস্ত্রখানা।

রাজনীতিতে আজকের সমস্যা দুর্নীতি থেকে ঘুরে গেছে অন্যদিকে। সাংবিধানিক পথেই আজ দেশে দেশে গণঅধিকারের সব রক্ষাকবচ একে একে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হচ্ছে। আইন-আদালত, সংবিধান এড়িয়ে অঘোষিত এজেন্ডা অনুযায়ী রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধীদের কবজি ভেঙে দেওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়। সংসদকে নিষ্ক্রিয় করা হয়। মিডিয়াকে কাজে লাগানো হয় কিংবা কথা না শুনলে ভয়ের মধ্যে রাখা হয়। আমেরিকার অসংখ্য মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে সেদেশের জাতীয় রাজনীতির একটি বিষয়। দল নির্বিশেষে যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির সেই ভয়ংকর দিনটির স্মৃতি ভুলতে পারছে না, যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো-বাইডেনের কাছে ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর স্বয়ং ট্রাম্পের উত্তেজক বক্তৃতায় ক্ষিপ্ত-উত্তপ্ত-বিশৃঙ্খল ভক্তের দল ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় সাতাশ লাখ ডলার মূল্যের সরকারি সম্পত্তি বিনষ্ট করে। ওই ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয় এবং ১৩৮ জন পুলিশ অফিসারসহ বহু মানুষ আহত হন। ঘটনার অভিঘাতে পরে চারজন পুলিশকর্মী আÍহত্যা করে। তদানীন্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স যখন বেআইনি দাবি মেনে ভোট গণনার ফলাফল উলটে দিতে অস্বীকার করেন, তখন ট্রাম্পভক্ত দাঙ্গাবাজরা একটি ফাঁসিকাঠ স্থাপন করে আওয়াজ তোলে-‘মাইক পেন্সকে ফাঁসিতে ঝোলাও’। আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারলে ট্রাম্প যে প্রথাগতভাবে আইনসভার, বিশেষ করে সিনেটের পরামর্শ ও অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়ালখুশি মতো চলবেন, এমন শঙ্কায় ভুগছে অনেকেই।

শুধু আমেরিকায় নয়, সম্প্রতি ইসরাইলের চরমপন্থি শাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে সেখানকার সাধারণ মানুষ। ইসরাইল ফুঁসছে, লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামছে। ছাত্র, শ্রমিক, কর্মচারী থেকে শুরু করে সমাজের নানা অংশের মানুষ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু চাচ্ছেন সেদেশের বিচারব্যবস্থা করায়ত্ত করতে। কিছুদিন আগে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, এ বিচারব্যবস্থার পরিবর্তনে হয়তো সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমস্যা তৈরি হতে পারে। মন্ত্রিপরিষদের সেই সদস্যকে নেতানিয়াহু বহিষ্কার করার পর মানুষ সেখানে আরও বেশিমাত্রায় রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। তাদের হাতে ব্যানার-‘কোনো মানুষই আইনের ঊর্ধ্বে নয়’। ইসরাইলের মতো অন্যান্য দেশেও চরমপন্থি শাসনের বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামছে। মজার তথ্য হলো, দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়েই নেতানিয়াহু ইসরাইলিদের ভোটে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; কিন্তু তখন মানুষ তাকে ভোট দিলেও স্বৈরতন্ত্রের অভিযোগ এখন তাকে ছেড়ে কথা বলছে না। কোথাও ট্রাম্প, কোথাও বলসোনারো, কোথাও নেতানিয়াহু-চরমপন্থি শাসকরা মানুষের রোষের শিকার হচ্ছেন।

এ ধরনের চরমপন্থি শাসকরা মানতেই চান না যে, সরকারকে সমালোচনা করার অধিকার আছে নাগরিকের। তাই অনেক দেশে সরকারবিরোধী প্রচার করার অভিযোগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফ্যামকে বিদায় নিতে হয়; বিবিসি অফিস রেড করা হয়; টুইটার-ফেসবুককে কবজা করতে আইন সংশোধন করা হয়। এসব দেশের অনেকেরই ধারণা, সেখানে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর হয়তো কালের নিয়মে সামাজিক পরিবর্তনের সূত্র অনুযায়ী মানুষ একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। আর তা হওয়ার প্রধান একটি সময় হলো ভোটের সময়। চরমতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে পারলে আখেরে তাদেরই লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের শি জিনপিং এবং রাশিয়ার পুতিনের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ থাকলেও রাস্তায় নামার সুযোগ সেখানে সাধারণ মানুষের নেই। সাধারণ মানুষের ভোটের সুযোগও সেখানে পরিপূর্ণভাবে নেই। তাই ওসব দেশে মানুষ নীরবে মেনে নিচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ। কিন্তু গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় মানুষ ফুঁসে উঠছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে-তারই সাম্প্রতিক প্রমাণ ইসরাইল।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক