ঢাকা ০১:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি মিডিয়া কী বলছে? দিল্লিতে মুখপাত্রের ব্রিফিং, মমতার মন্তব্যে কড়া প্রতিক্রিয়া, বাংলাদেশে দ্রুত শান্তির প্রত্যাশা কবে ট্রেন চলবে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি : রেলের ডিজি বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাক হওয়া ওয়েবসাইট উদ্ধার হয়েছে গুলিতে নিহিত আবু সাঈদের জন্য কাদছে পীরগঞ্জের মানুষ নিহত-আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের দাবি সিপিবি’র আন্দালিব রহমান পার্থকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়ার অভিযোগ এখনই খুলছে না স্কুল-কলেজ, মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়াল! জারি থাকছে কার্ফু, ধৃত ১৭৫৮ আগামীতে আইসিটি সেক্টরে ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে ………….ঠাকুরগাঁওয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পীরগঞ্জে বিদায় সংবর্ধনা ও দায়িত্বভার গ্রহণ শেখ সমশের আলী

শুরু এবং শেষ টুঙ্গিপাড়ায়

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন::   শিরোনামের প্রসঙ্গটি বহুমুখে বহুবার দেশে ও বিদেশে উচ্চারিত হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। ’৭৫-এর আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডটি যখন ঘটে, তখন আমি দেশের বাইরে, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। খবরটি প্রথম পাই বিবিসির সংবাদে। পরদিন সব সংবাদপত্রেই খবরটি ছিল। বঙ্গবন্ধু যে ৩২ নম্বরে প্রায় অরক্ষিত অবস্থায় বসবাস করছিলেন, তা আমার জানা ছিল না। কারণ, ’৭৩-এ দেশ থেকে চলে গিয়েছিলাম। তবে জেনেছি তার হত্যাকাণ্ডের খবরের সঙ্গে। খবরটি জানার পরই আমার মনে তিনি কেন অরক্ষিত ছিলেন, এ প্রশ্নটিই জেগেছিল। একই প্রশ্ন জেগেছিল এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে আমার প্রিয় শিক্ষক ভিক্টর কিয়েরনানের মনে। কারণ, ১৬ আগস্ট ইতিহাস বিভাগে ঢোকার মুখে তার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি আমাকে হতচকিত করে দিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন : ‘Why did your president Mujib live in his private residence literally unprotected?’ আমার কাছে সেদিন প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার মতো প্রাসঙ্গিক তথ্য ছিল না। উত্তর দিতে গিয়ে আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমারও একই প্রশ্ন।

অধ্যাপক কিয়েরনানের অফিসে গিয়ে সেদিন আমাদের আলাপচারিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল তৃতীয় বিশ্বে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। কারণ, তখন পর্যন্ত ধারণা করা হয়েছিল যে, হত্যাকাণ্ডটি একটি সামরিক অভ্যুত্থানের অংশ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, আসলে ১৫ আগস্টের ঘটনাটি অভ্যুত্থানের অংশ নয়; বরং কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হীন অভিলাষের পরিণতি। তবে আলাপচারিতার একপর্যায়ে আমি অধ্যাপক কিয়েরনানকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম আফ্রিকার ছোট রাষ্ট্র তোগোর ঘটনাটি। ’৬৩-এর জানুয়ারিতে সেদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট সিলভেনাস অলিম্পিওকেও সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য হত্যা করেছিল; কিন্তু সেদিনের সেই আলাপচারিতায় আমরা দুজন আমাদের অভিন্ন প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে পরবর্তীকালে জেনেছি যে, বঙ্গবন্ধুর জবানিতে প্রশ্নটির উত্তর বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া আছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যেই প্রশ্নটির উত্তর নিহিত আছে। দুটো দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বাঙালি জাতি। বাঙালির স্বার্থচিন্তাসম্পৃক্ত প্রণোদনা থেকেই তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল। জীবনের শুরুতে কিশোর বয়সে টুঙ্গিপাড়ার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে একবার হয়েছিল প্রচণ্ড খরা। জমিতে আবাদ ছিল না বললেই চলে। কাজেই গ্রামের কৃষকের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। কিশোর মুজিব একদিন কজন কৃষককে ডেকে এনে ধান দিয়েছিলেন। বাবার কাছে এ কাজের জন্য বকুনি খেয়ে উত্তর দিয়েছিলেন: ‘ওদের তো পেট আছে। ওদেরও খাবার প্রয়োজন।’ সেদিনের সেই কিশোর মুজিব বড় হলো। রাজনীতির বিস্তৃত অঙ্গনে তার সংগ্রামী পদচিহ্ন পড়ল। একদিন শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কিন্তু শুরু থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাঙালির অন্ন আর স্বার্থ নিয়ে তিনি রাজনীতি করেছিলেন। যাদের জন্য এবং যাদের নিয়ে রাজনীতি, তাদের ঘনিষ্ঠ নৈকট্যেই ছিল তার অবস্থান। কাজেই এমন একজন ব্যক্তিত্বের পক্ষে সম্ভব ছিল না সরকারপ্রধানের সরকারি বাসভবনের কৃত্রিম পরিবেশ ও নিরাপত্তায় বাস করা।

’৬৩-তে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন, তখন থেকে দলটির চরিত্র বদলে যেতে শুরু করে। দলের সাংগঠনিক কাঠামো দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকে তিনি রূপান্তরিত করলেন একটি গণভিত্তিক দলে। বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ’৬৬ থেকে ’৭০-এর মধ্যে দলটি হয়ে উঠল বাঙালি প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন এবং যা প্রমাণিত হলো ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে।

বঙ্গবন্ধুর বাঙালিমগ্নতা ৭ মার্চের ভাষণেও ছিল: ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ দেশের মানুষের অধিকার উপেক্ষা করে ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতি করলে তিনি অনায়াসেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন; কিন্তু জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে জনতার সঙ্গে বেইমানি করার কোনো নির্দেশ তার জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনে ছিল না।

এ রাজনৈতিক দর্শনই তাকে আমৃত্যু বাঙালিমগ্ন রেখেছিল। অপরদিকে এ রাজনীতির কারণেই তিনি নিরাপত্তার পরিভাষায় ছিলেন অরক্ষিত। আর এ রাজনীতিই তার জীবনের দৈর্ঘ্যকে করছিল সংকুচিত। একবার একজন প্রবাসী বাঙালি অধ্যাপক তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাকে তার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রশ্নটি উড়িয়ে দিয়ে যথেষ্ট প্রতীতি নিয়ে বলেছিলেন-‘আমাকে কোনো বাঙালি মারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর হিসাবে ভুল ছিল। বাঙালিই তাকে মেরেছিল; কিন্তু যে বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, তাদের কি বাঙালি বলা যায়?

একদিন বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলার দলীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। একজন দলীয় নেতা তার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন: ‘বঙ্গবন্ধু, আপনার ধানমন্ডির বাড়িটা তো অরক্ষিত। তবুও আপনি গণভবনে না থেকে সেখানে থাকেন কেন?’ বঙ্গবন্ধু প্রশ্নটি গুরুত্ব দিয়েই সেদিন বিবেচনা করেছিলেন। কারণ, তার উত্তর ছিল বেশ দীর্ঘ। উত্তরের একাংশে তিনি বলেছিলেন: ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী Reactionary আর দেশদ্রোহীরা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। They may hit me anytime. কিন্তু সে সুযোগ আমি তাদের দেব না। একবার যদি পহেলা সেপ্টেম্বর [’৭৫] পর্যন্ত যেতে পারি, যদি নিউ সিস্টেম চালু করে দিতে পারি, তারপর দেখা যাবে কে কত ষড়যন্ত্র করতে পারে। আর তার আগেই যদি মারা যাই, তোরা এক কাজ করিস, বাংলার কোনো গ্রামে ধানখেতের পাশে কিংবা বাঁশবাগানে আমার কবর দিস। কবরে শুয়ে যেন বাংলার মাটির স্বাদ পাই। কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নয়, আমার কবরে একটি চোঙা বানিয়ে রেখে দিস।’ এ কথাগুলো শুনে একজনের বিনীত প্রশ্ন: ‘চোঙা দিয়ে কী হবে, স্যার?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে দেখবে শেখ মুজিব নামে একটি লোক একদিন টিনের চোঙা হাতে নিয়ে বাংলার রাজনীতিতে নেমেছিল। সারা জীবন বাঙালি বাঙালি বলে চিৎকার করে করে একদিন সেই চোঙা হাতে নিয়েই সে পৃথিবী থেকে চলে গেছে।’ সেদিন বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো যারা শুনেছিল তাদের মধ্যে তার ভবিষ্যৎ ঘাতকদের কেউ ছিল না; কিন্তু ঘাতকরা তাকে টুঙ্গিপাড়ার গ্রামে সমাধিস্থ করে অন্তত একটি কথা রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু গ্রামের ধানখেতের পাশেই শুয়ে আছেন। বাংলার পাখির গান শুনছেন, সোনালি ধানের ঘ্রাণ অবশ্যই পাচ্ছেন।

টুঙ্গিপাড়া থেকেই বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল, টুঙ্গিপাড়ায়ই তার যাত্রা শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরে অরক্ষিত ছিলেন; কিন্তু টুঙ্গিপাড়ার কবরে নন। কারণ, তার অস্তিত্ব এখন যে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতার বাইরে। তিনি এখন সুরক্ষিত তার প্রিয় বাংলার মাটি দিয়ে।

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি মিডিয়া কী বলছে?

শুরু এবং শেষ টুঙ্গিপাড়ায়

আপডেট টাইম ১২:২০:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৩

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন::   শিরোনামের প্রসঙ্গটি বহুমুখে বহুবার দেশে ও বিদেশে উচ্চারিত হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। ’৭৫-এর আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডটি যখন ঘটে, তখন আমি দেশের বাইরে, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। খবরটি প্রথম পাই বিবিসির সংবাদে। পরদিন সব সংবাদপত্রেই খবরটি ছিল। বঙ্গবন্ধু যে ৩২ নম্বরে প্রায় অরক্ষিত অবস্থায় বসবাস করছিলেন, তা আমার জানা ছিল না। কারণ, ’৭৩-এ দেশ থেকে চলে গিয়েছিলাম। তবে জেনেছি তার হত্যাকাণ্ডের খবরের সঙ্গে। খবরটি জানার পরই আমার মনে তিনি কেন অরক্ষিত ছিলেন, এ প্রশ্নটিই জেগেছিল। একই প্রশ্ন জেগেছিল এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে আমার প্রিয় শিক্ষক ভিক্টর কিয়েরনানের মনে। কারণ, ১৬ আগস্ট ইতিহাস বিভাগে ঢোকার মুখে তার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি আমাকে হতচকিত করে দিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন : ‘Why did your president Mujib live in his private residence literally unprotected?’ আমার কাছে সেদিন প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার মতো প্রাসঙ্গিক তথ্য ছিল না। উত্তর দিতে গিয়ে আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমারও একই প্রশ্ন।

অধ্যাপক কিয়েরনানের অফিসে গিয়ে সেদিন আমাদের আলাপচারিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল তৃতীয় বিশ্বে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। কারণ, তখন পর্যন্ত ধারণা করা হয়েছিল যে, হত্যাকাণ্ডটি একটি সামরিক অভ্যুত্থানের অংশ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, আসলে ১৫ আগস্টের ঘটনাটি অভ্যুত্থানের অংশ নয়; বরং কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হীন অভিলাষের পরিণতি। তবে আলাপচারিতার একপর্যায়ে আমি অধ্যাপক কিয়েরনানকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম আফ্রিকার ছোট রাষ্ট্র তোগোর ঘটনাটি। ’৬৩-এর জানুয়ারিতে সেদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট সিলভেনাস অলিম্পিওকেও সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য হত্যা করেছিল; কিন্তু সেদিনের সেই আলাপচারিতায় আমরা দুজন আমাদের অভিন্ন প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে পরবর্তীকালে জেনেছি যে, বঙ্গবন্ধুর জবানিতে প্রশ্নটির উত্তর বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া আছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যেই প্রশ্নটির উত্তর নিহিত আছে। দুটো দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বাঙালি জাতি। বাঙালির স্বার্থচিন্তাসম্পৃক্ত প্রণোদনা থেকেই তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল। জীবনের শুরুতে কিশোর বয়সে টুঙ্গিপাড়ার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে একবার হয়েছিল প্রচণ্ড খরা। জমিতে আবাদ ছিল না বললেই চলে। কাজেই গ্রামের কৃষকের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। কিশোর মুজিব একদিন কজন কৃষককে ডেকে এনে ধান দিয়েছিলেন। বাবার কাছে এ কাজের জন্য বকুনি খেয়ে উত্তর দিয়েছিলেন: ‘ওদের তো পেট আছে। ওদেরও খাবার প্রয়োজন।’ সেদিনের সেই কিশোর মুজিব বড় হলো। রাজনীতির বিস্তৃত অঙ্গনে তার সংগ্রামী পদচিহ্ন পড়ল। একদিন শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কিন্তু শুরু থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাঙালির অন্ন আর স্বার্থ নিয়ে তিনি রাজনীতি করেছিলেন। যাদের জন্য এবং যাদের নিয়ে রাজনীতি, তাদের ঘনিষ্ঠ নৈকট্যেই ছিল তার অবস্থান। কাজেই এমন একজন ব্যক্তিত্বের পক্ষে সম্ভব ছিল না সরকারপ্রধানের সরকারি বাসভবনের কৃত্রিম পরিবেশ ও নিরাপত্তায় বাস করা।

’৬৩-তে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন, তখন থেকে দলটির চরিত্র বদলে যেতে শুরু করে। দলের সাংগঠনিক কাঠামো দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকে তিনি রূপান্তরিত করলেন একটি গণভিত্তিক দলে। বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ’৬৬ থেকে ’৭০-এর মধ্যে দলটি হয়ে উঠল বাঙালি প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন এবং যা প্রমাণিত হলো ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে।

বঙ্গবন্ধুর বাঙালিমগ্নতা ৭ মার্চের ভাষণেও ছিল: ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ দেশের মানুষের অধিকার উপেক্ষা করে ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতি করলে তিনি অনায়াসেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন; কিন্তু জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে জনতার সঙ্গে বেইমানি করার কোনো নির্দেশ তার জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনে ছিল না।

এ রাজনৈতিক দর্শনই তাকে আমৃত্যু বাঙালিমগ্ন রেখেছিল। অপরদিকে এ রাজনীতির কারণেই তিনি নিরাপত্তার পরিভাষায় ছিলেন অরক্ষিত। আর এ রাজনীতিই তার জীবনের দৈর্ঘ্যকে করছিল সংকুচিত। একবার একজন প্রবাসী বাঙালি অধ্যাপক তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাকে তার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রশ্নটি উড়িয়ে দিয়ে যথেষ্ট প্রতীতি নিয়ে বলেছিলেন-‘আমাকে কোনো বাঙালি মারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর হিসাবে ভুল ছিল। বাঙালিই তাকে মেরেছিল; কিন্তু যে বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, তাদের কি বাঙালি বলা যায়?

একদিন বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলার দলীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। একজন দলীয় নেতা তার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন: ‘বঙ্গবন্ধু, আপনার ধানমন্ডির বাড়িটা তো অরক্ষিত। তবুও আপনি গণভবনে না থেকে সেখানে থাকেন কেন?’ বঙ্গবন্ধু প্রশ্নটি গুরুত্ব দিয়েই সেদিন বিবেচনা করেছিলেন। কারণ, তার উত্তর ছিল বেশ দীর্ঘ। উত্তরের একাংশে তিনি বলেছিলেন: ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী Reactionary আর দেশদ্রোহীরা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। They may hit me anytime. কিন্তু সে সুযোগ আমি তাদের দেব না। একবার যদি পহেলা সেপ্টেম্বর [’৭৫] পর্যন্ত যেতে পারি, যদি নিউ সিস্টেম চালু করে দিতে পারি, তারপর দেখা যাবে কে কত ষড়যন্ত্র করতে পারে। আর তার আগেই যদি মারা যাই, তোরা এক কাজ করিস, বাংলার কোনো গ্রামে ধানখেতের পাশে কিংবা বাঁশবাগানে আমার কবর দিস। কবরে শুয়ে যেন বাংলার মাটির স্বাদ পাই। কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নয়, আমার কবরে একটি চোঙা বানিয়ে রেখে দিস।’ এ কথাগুলো শুনে একজনের বিনীত প্রশ্ন: ‘চোঙা দিয়ে কী হবে, স্যার?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে দেখবে শেখ মুজিব নামে একটি লোক একদিন টিনের চোঙা হাতে নিয়ে বাংলার রাজনীতিতে নেমেছিল। সারা জীবন বাঙালি বাঙালি বলে চিৎকার করে করে একদিন সেই চোঙা হাতে নিয়েই সে পৃথিবী থেকে চলে গেছে।’ সেদিন বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো যারা শুনেছিল তাদের মধ্যে তার ভবিষ্যৎ ঘাতকদের কেউ ছিল না; কিন্তু ঘাতকরা তাকে টুঙ্গিপাড়ার গ্রামে সমাধিস্থ করে অন্তত একটি কথা রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু গ্রামের ধানখেতের পাশেই শুয়ে আছেন। বাংলার পাখির গান শুনছেন, সোনালি ধানের ঘ্রাণ অবশ্যই পাচ্ছেন।

টুঙ্গিপাড়া থেকেই বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল, টুঙ্গিপাড়ায়ই তার যাত্রা শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরে অরক্ষিত ছিলেন; কিন্তু টুঙ্গিপাড়ার কবরে নন। কারণ, তার অস্তিত্ব এখন যে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতার বাইরে। তিনি এখন সুরক্ষিত তার প্রিয় বাংলার মাটি দিয়ে।

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)