Songbad Saradin Desk::
সাধুর মতে বিষয়ী লোক কারা?
আজ থেকে প্রায় বিরানব্বই বছর আগে তিব্বতের লাসায় গেছিলেন সাধু ফালহারিবাবা।লাসার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন-“সাধারণ মানুষের লাসায় যাওয়া ও থাকাটা সত্যিই অসুবিধাজনক। বলতে পার একরকম অসম্ভবই। তবে লাসার লামাসমাজ ভারতীয় সাধুসন্ন্যাসী যোগীদের সম্মানের চোখেই দেখে। গুরুজির পূর্ব পরিচিত লামার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম বলে কোনও অসুবিধে হয়নি। তিনি এদেশ থেকে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন। ঐ লামা সামান্য হিন্দি শিখেছিলেন বলে কথা বলতে তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি পথে।”–সাধুর জন্মস্থান নাগপুর। গৃহত্যাগের পর তিনি আর গ্রামের বাড়ি যাননি।পূর্বে সাধুদের প্রতি যে দেবভক্তি ছিল এখন তারা হারিয়েছে সেই অবস্থান হারিয়েছে।এখন আর তাদেরকে মানুষ বিশ্বাস করেনা এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন-“– সম্মান শ্রদ্ধা বিশ্বাস এগুলো মানুষের কাছ থেকে জোর করে আদায় করে নেওয়ার মতো কোনও বস্তু নয়। এগুলো ব্যক্তিমনের শুদ্ধ প্রতিফলন। সেখানে কোনওভাবে কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে সে নিশ্চয়ই আহত হয়ে ওগুলো হারিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সেই সব সাধুরাই দায়ী, যারা আহত করেছে মানুষের মন আর বিশ্বাসকে। তার জন্যে গোটা সাধুসমাজটা দোষী নয়। সততা, নিঃস্বার্থ দান, অলসতা মুক্ত, সমস্ত বিষয়ে আসক্তিহীন, অটুট ধৈর্য আর নির্বিচারে ক্ষমা, এই ছ’টা গুণ আয়ত্ত করতে না পারলে কোনও মানুষের পক্ষেই ভগবানের সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এর কোনও একটি যদি কেউ ঠিকঠিক মত আয়ত্ত করতে পারে তাহলে তার মধ্যে বাদবাকি গুণের আবির্ভাব এমনি হয়। এই গুণগুলো সাধুদের মধ্যে থাকা একান্ত প্রয়োজন। যার মধ্যে নেই, ভগবান তার থেকে অনেক দূরে থাকে। এইসব গুণ সাধুদের সম্মান শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বাড়ায় মানুষের কাছে। এই গুণের কপট অধিকারী সাধুরা সাময়িক সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন হলেও জীবনের কোনও না কোনও সময় তা হারিয়ে ফেলে, প্রকটিত হয় কপটতা। তবে একশ্রেণির মানুষ আছে, যারা কখনও সাধু সন্ন্যাসীদের সত্যমিথ্যা কিংবদন্তির উপর শ্রদ্ধা বিশ্বাসভক্তি করে আবার তা হারায়, এমন মানুষের সংখ্যা বেশি। সুতরাং এদের কথা, ওসব ঠুনকো শ্রদ্ধা বিশ্বাসের কথা ছেড়ে দে। যে গুণে মানুষ তাঁকে লাভ করতে পারে সেই গুণের প্রকাশ যদি কোনও সাধুসন্ন্যাসীর মধ্যে ঘটে, সে কি কখনও অবহেলিত হতে পারে? তবে এখানে একটা কথা আছে। অনেক সময় অত্যন্ত বিষয়ী বা সংসারীরা সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে আসে বিভিন্ন সমস্যা আর কামনাবাসনা নিয়ে। তারা বাক্য আদায় করে নেয় নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। অনেকক্ষেত্রে সাধুসন্ন্যাসীরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বাক্য দেয়। পরে হয়ত সে বাক্য ফলপ্রসূ হল না, তখন মানুষের পরোক্ষে একটা অশ্রদ্ধা বা অবিশ্বাস বাসা বেঁধে ফেলে অন্তরে। সব সাধু তো আর বাকসিদ্ধ নয়। অনেকসময় সাধুসন্ন্যাসীরা মানসিক বলবুদ্ধি বা সান্ত্বনা দিয়ে থাকেন গৃহীদের বাক্যের মাধ্যমে। সেই আশাব্যঞ্জক কথা বাস্তবে রূপায়িত না হলে তখন একটা অবিশ্বাসের ভাব সৃষ্টি হয় বক্তা সাধুসন্ন্যাসীর উপরে। এর জন্য সাধুরাই দায়ী, যেহেতু তারা আশা দিচ্ছেন। অবশ্য দুঃখী মানুষরা এসে কাতর হয়ে পড়লে সাধুদের তাৎক্ষণিক এটুকু না করে কোনও উপায়ও থাকে না।মানুষের আশা যে কী ভীষণ, এর আকৃতি যে কত বড়, কত ভয়ংকর তা কল্পনা করতে পারবে না। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পর্বত হিমালয়, তার চেয়ে অনেক বড় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে অনেক অ-নে-ক বিশাল হল উন্মুক্ত আকাশ। আকাশের চেয়ে বিশালত্বে অনেক বেশি পরমব্রহ্ম। ব্রহ্মের চেয়ে জগতে বড় কিছু আর নেই। কিন্তু এই ব্রহ্মও যেন হার মেনেছে আশার কাছে। মনুষ্যজাতির আশা আকাঙ্ক্ষা, কামনা বাসনা পরমব্রহ্মের চেয়েও অসীম অনন্ত, নাগালের বাইরে।”এতদূর বলে থামলেন তিনি।
সংসারে থেকে সাধারনমানুষের সংযম কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে সাধুজি বলেন
–” সংসারে বিষয়ী মানুষের সংখ্যাটাই বেশি। বিষয়ী বলতে, যারা শুধু আমার আমার করছে, কিছুই হল না, কিছুই পেলাম না, কী হবে কী হবে।অভাব নেই অথচ আরও পাওয়ার বাসনা, আরও হোক এমন ভাবনা যার মনকে প্রায়ই পীড়িত করে রেখেছে, সবকিছু থাকা সত্ত্বেও অসন্তুষ্ট চিত্ত যাদের, তাদের বিষয়ী বলে। সংখ্যাটা এত বেশি যে, এদের এড়িয়ে চলাটা খুব কঠিন। বিষয়ী নারীপুরুষ সংক্রামক ব্যাধির মতো। সঙ্গ করলেই বিষয় বাসনায় আক্রান্ত হতে হবে। এদের সঙ্গ ত্যাগ করলে সংযমতার পথ অনেক সুগম হয়। বেটা, মধুহীন ফুলকে যেমন মৌমাছি, ফলহীন গাছকে যেমন পাখিরা পরিত্যাগ করে, তেমনই ঈশ্বরে ভজনহীন বিষয়ীদের সংস্পর্শ ত্যাগ করা উচিত, যারা সত্যিই সংযমী হতে চায় তাদের। সংসারী হয়ে এ রকম সংসারীদের সঙ্গ সব সময় পরিত্যাগ করা উচিত। সাধুদেরও কলুষিত করে এইসব বিষয়ীদের সঙ্গ, যদি না খুব ভজনশীল সাধু সে হয়।বিষয়ী নারীপুরুষ আর বকের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। সরোবর বা জলাশয়ে দেখবি সুন্দর প্রস্ফুটিত পদ্মের সৌন্দর্য ফেলে রেখে বক যেমন ঘাড় ঘুরিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে মাছ বা খাদ্যের খোঁজ করে, তেমনই বিষয়ী মানুষ কামনার বশবর্তী হয়ে পরমানন্দময় অনন্ত জীবনের অন্বেষণ না করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে কদর্য ভোগ, অর্থ – তারই চিন্তা করে। সেইজন্য এদের সঙ্গ পরিত্যাগ করা ভাল”।বিষয়ী মানুষরা চট করে সাধুসঙ্গও চায়না এ ব্যাপারে তিনি বলেন-“যারা বিষয়াসক্ত তারা চট করে সাধুসঙ্গ তো করে না, মনের দিক থেকে সাধুসন্ন্যাসীদের পাত্তাও দেয় না, বরং অবজ্ঞাই করে। তবুও যারা সাময়িকভাবে সাধুদের কাছে আসে, তারা সাধুসঙ্গ করতে আসে না। আসে কোনও সমস্যায় পড়ে তার সমাধানের উদ্দেশ্যে। এক কথায় তাদের সাধুসঙ্গটা বলতে পারিস স্বার্থসিদ্ধির। মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির ভাবনাটা তাদের থাকে না। সুতরাং এমনিতে তারা নিজেরাই পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে, সাধুরা আর নতুন করে পরিত্যাগ করবে কেমন করে! তবে বিষয়ীদের মধ্যে কিছু নারীপুরুষ আছে, যাদের কয়েকদিনের সাধুসঙ্গ লোক দেখানো। এটা এক ধরনের বিলাসিতা বলতে পারিস। অনেক সময় সাধুদের কাছে আসে তারা সময় কাটাতে হাতে সময় থাকলে। হাজার কাজের মধ্যেও যারা সময় করে নিয়ম মতো সাধুসঙ্গ করে, সেটাকেই তো প্রকৃত সাধুসঙ্গ বলে।” একটু ভেবে আবার বললেন-“চাষের অনুপযুক্ত জমিতে চেষ্টা করলেও ভাল ফসল হয় না, কারণ ওই জমির এমনই গুণ, যা হতে দেয় না। বিষয়ীদের ক্ষেত্রে ওই একই কথা। তাদের যতই জ্ঞানের কথা বল না কেন, নিজের বিষয়-স্বার্থসিদ্ধির কথাটুকু ছাড়া আর কিছুই সে গ্রহণ করে না, কারণ তার প্রবৃত্তিটা গ্রহণ করতে দেয় না।”এভাবেই সংসারে কারা বিষয়ী আর বিষয় চিন্তা কতটা খারাপ তা তিনি বললেন।শিবশংকর ভারতী র লেখা থেকে এই সাক্ষাত্কার অংশ দেওয়া হল ।