আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে লকডাউন আরোপ করা হয়েছে – তার তুলনায় পানামার লকডাউনের নিয়মকানুন বেশ অন্য রকম। এ দেশে লকডাউন হচ্ছে জেন্ডারের ভিত্তিতে।
সপ্তাহের সোম বুধ আর শুক্রবার শুধু মহিলারা ঘর থেকে বের হতে পারবেন, অন্য দিনগুলোয় বেরুবেন শুধু পুরুষরা। রোববার সবাইকে বাড়িতে থাকতে হবে। কিন্তু এ আইনে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে যারা এ দু’টির কোনটিই নন – অর্থাৎ ট্রান্সজেন্ডারদের ।
মনিকা চমৎকার রান্না করেন। তাই লকডাউনের সময়টায় তিনি মজার মজার রান্না করেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করেন। লকডাউনের কারণে তার কাজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
পানামা সিটির বিমানবন্দরের কাছে তার বড় পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি।
লকডাউনের মধ্যে পাড়ার দোকানে চিকেন কেনা
গত পয়লা এপ্রিল তিনি বেরুলেন পাড়ার দোকানের উদ্দেশ্যে – কিছু মুরগির মাংস কিনতে । সেদিন শুধু মহিলাদেরই বাড়ি থেকে বের হবার দিন। কিন্তু দোকানে ঢুকতেই একটা ধাক্কা খেলেন মনিকা ।
পরিচিত চীনা দোকানদার বললো, আজ আমরা তোমার কাছে কিছু বিক্রি করতে পারবো না। আজ শুধু মহিলাদের দিন।
মনিকা একজন ট্রান্সজেন্ডার এবং তিনি একজন যৌনকর্মী।
ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মী মনিকার জীবন
মনিকা ১২ বছর বয়স থেকেই মেয়েদের পোশাক পরে স্কুলে যেতেন। তিনি নিজেকে কখনো ছেলে বলে মনে করেছেন – এমন কথা মনেও করতে পারেন না। তবে তার বয়স ১২ হবার পর তার যৌন পরিচয় প্রকাশ করতেই হলো।
তার বাবা – মনিকা, তার দুবোন এবং মাকে নিয়মিত মারধর করতেন। মনিকা ট্রান্সজেন্ডার একথা প্রকাশ পাবার পর তাতে কোন পরিবর্তন হলো না।
মনিকা ধীরে ধীরে লম্বা চুল রাখলেন, আঁটোসাঁটো পোশাক পরা শুরু করলেন। স্কুলে তার মেয়েলি ভাবের জন্য খ্যাপানো হতো। কিন্তু তিনি গা করতেন না। দুই বোন আর মায়ের ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব পেয়েই তিনি খুশি ছিলেন।
১৪ বছর বয়েসে তার বাবা মারা গেলে পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেল।
মনিকা সে সময়ই শুনতে পেলেন পানামা সিটিতে ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মীদের চাহিদা রয়েছে , তাতে ভালো টাকা পয়সাও পাওয়া যায়। মনিকা সিদ্ধান্ত নিলেন, এটাই হবে তার জন্য পরিবারের ভরণপোষণের সবচেয়ে ভালো পথ।
দোকানদার বললো, আমি দুঃখিত
চীনা দোকানদার বললো, মনিকা আমি দুঃখিত, কিন্তু ট্রান্সজেন্ডারদের ব্যাপারে এ নির্দেশ এসেছে সরাসরি পুলিশের কাছ থেকে।
পুলিশের লোকেরা মনিকার পরিচিত। তারাও তাকে চেনে। পানামায় দেহব্যবসা বৈধ তাই আইনের বাধা নেই। কিন্তু মানুষের মনের ধারণা তো তাতে বদলায়নি।
মনিকা বলেন, পুলিশ তাকে দেখলেই অপমান-বিদ্রূপ করে, নানা রকম ঘৃণাসূচক শব্দ ব্যবহার করে।
মনিকার বয়স এখন ৩৮। তিনি ২৪ বছর ধরে যৌনকর্মী। তার দুই বোন ও মা তার সাথেই থাকে। দু’বোনের কেউই বিয়ে করে নি, তবে তাদের চার ছেলেমেয়ে। কেউই কাজ করে না, তার মা-ও নয়।
মনিকার কথা, পানামা সিটিতে অনেক ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মী আছে। এ পেশা আমাদের পছন্দ নয়, কিন্তু এতে একটা নিয়মিত আয় আছে এবং আমরা আমাদের পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারছি।
বাড়ি ফিরে আসার পর মনিকার ফোনে হোয়াটসএ্যাপে মেসেজ পাঠালো সেই চীনা দোকানদার।
সে লিখেছে, মনিকাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে বলে তার খারাপ লাগছে, ফলে আর কাউকে পাঠাতে হবে না, সে নিজেই মনিকার বাড়িতে চিকেন পৌঁছে দেবে।
মনিকার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার আশপাশের মানুষের মনে দয়ামায়া আছে – যা এই লকডাউনের সময় তাকে সাহায্য করবে।
মনিকা বের হলেন পুরুষদের দিনে
মনিকা কিন্তু কারও অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করতে চান না, নিজে কাজ করতে চান। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বৃহস্পতিবার পুরুষদের বের হবার দিনেই তিনি বাইরে যাবেন।
কারণ, প্রকৃত শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মনিকা একজন পুরুষ। সুতরাং তিনি আইন ভা্ঙছেন এটা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু এবার তার অভিজ্ঞতা হলো আরও খারাপ।
তিনি একটা সুপারমার্কেটে গেলেন – কয়েক সপ্তাহের কেনাকাটা একবারে সেরে নিতে।
‘একজন আমার বুকে চাপ দিয়ে বললো, তুমি তো মেয়ে নও’
পানামার লকডাউনে নিয়ম হচ্ছে, এক একটি এলাকার লোকদের মাত্র দু’ঘণ্টার জন্য বের হতে দেয়া হবে। মার্কেটের সামনে তাই লম্বা লাইন পড়েছে।
লাইনে দাঁড়ানো লোকেরা মনিকার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে লাগলো। দু’ঘণ্টা সময় যখন প্রায় শেষ – ঠিক তখন হঠাৎ ছয় জন পুলিশের আবির্ভাব ঘটলো সেখানে।
তারা লাইনের মধ্যে থেকে মনিকাকে বের করে আনলো। ‘তারা বললো, আমার দু’ঘন্টা সময় শেষ হয়ে গেছে। তারা আমার দেহতল্লাশি শুরু করলো।’
একজন আমার বুকে চাপ দিলো, তার পর হাসতে হাসতে বললো ‘তুমি তো মেয়ে নও’ তারপর ট্রান্সজেন্ডারদের উদ্দেশ্য করে ব্যবহার করা হয় এমন একটি খারাপ শব্দ বললো।
আশপাশের অন্য লোকেরা ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করলো – কেউ মনিকাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না।
মনিকা বলছেন, তার জীবনে কোনও দিন নিজেকে এত একা মনে হয়নি।
পানামায় ট্রান্সজেন্ডারদের সমস্যা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ক্রিস্টিয়ান গনজালেস কাব্রেরা বলছেন, পানামার লকডাউনের নিয়মের ফলে সমস্যা হয়েছে যে ট্রান্স কমিউনিটির লোকেরা বের হলেও বিপদ, না বের হলেও বিপদ।
তিনি বলছেন, মনিকার মতো ঘটনা আরও ঘটছে। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
পানামার ট্রান্সজেন্ডারদের সমিতি বলছে, লকডাউন শুরুর পর থেকে অন্তত ৪০ জন লোক সুপারমার্কেটি বা ওষুধের দোকানে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছে।
কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় সম্প্রতি জেন্ডার ভিত্তিক লকডাউন বাতিল করা হয়েছে এই কারণে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ ব্যাপারে পানামার কর্তৃপক্ষের কাছে এক চিঠি দেয়, এবং তাতে ট্রান্সজেন্ডারদের লকডাউনের সময় পুলিশের হয়রানির শিকার হবার কথা জানানো হয়।
এ চিঠির পর জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, এলজিবিটি কমিউনিটির লোকদের বিরুদ্ধে কোনও বৈষম্য না করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তবে মনিকা পানামার সরকারি নির্দেশের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
তিনি বলছেন, এ নির্দেশ জারির পরও তিনি মেয়েদের নির্ধারিত দিনে বের হয়েছিলেন, তখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে তাকে বলে, ‘তোমার ভালো চাই বলেই বলছি, তোমার জায়গায় আমি হলে আমি বাড়ি চলে যেতাম। আজ তোমার বাইরে আসার কথা নয়।’
মনিকা বলছেন, আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। তাহলে আমি কবে বের হবো? আমি তো কাউকে বোকা বানাতে চাই না। আমি শুধু আমার পরিবারের লালন-পালন করতে চাই। খবর: বিবিসি বাংলা।