আজম রেহমান,সারাদিন ডেস্ক:: সবকিছু ভালোই চলছিল। বিমানও নেমে যাচ্ছে। আমরা সিটবেল্ট বেঁধে অপেক্ষায় আছি। হঠাৎ বিমানটি নামতে গিয়ে কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেল। একবার নয়, দুবার। এরপর বিকট আওয়াজ। আমরা ছিলাম ঠিক মাঝামাঝি। দেখলাম পেছনের দিক থেকে আগুন আসছে। জানালা ভাঙার চেষ্টা করলাম। হলো না। মুহূর্তেই বিমানটি মাঝবরাবর ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেল। আমি নিচে লাফিয়ে পড়লাম। স্ত্রীকে নামালাম। এরপর ভাইয়ের স্ত্রীকে। ভাই আর তাঁর বাচ্চাকে আর নামাতে পারিনি। তার আগেই আগুন ধরে যায়।
কাঠমান্ডুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বিছানায় শুয়ে এভাবেই বেঁচে আসার বর্ণনা দিচ্ছিলেন গাজীপুরের মেহেদী হাসান। গত সোমবার কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজে (বিএস ২১১) ছিলেন মেহেদী ও পরিবারের অন্য চার সদস্য। বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা মেহেদীর স্ত্রী কামরুন্নাহর স্বর্ণা এখনো আইসিইউতে। তিনি কোনো কথা বলতে পারছেন না। ভাইয়ের স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানির পা ভেঙে গেছে। তিনি হাঁটতে পারছেন না। কিন্তু সন্তানের জন্য দিন-রাত কেঁদেই চলেছেন। এ রকম কান্না নিহত ব্যক্তিদের সব পরিবারে।
গত সোমবারের দুর্ঘটনার জন্য কাঠমান্ডুর রানওয়ের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে ইউএস-বাংলা দায়ী করলেও গতকাল নেপালে সফররত বিমানমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, কাঠমান্ডু কর্তৃপক্ষ যৌথ তদন্ত করতে রাজি হয়েছে। তারা বলেছে, সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। মন্ত্রী গতকাল বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এদিকে নেপাল সরকারের গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। নেপালের সংস্কৃতি, পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব কৃষ্ণপ্রসাদ দেবকোটা গতকাল ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়ে বলেছেন, তদন্ত শেষ হতে অন্তত পাঁচ মাস লেগে যেতে পারে।
ঢাকা থেকে গতকাল সকালে ইউএস-বাংলার একটি বিমানে করে বিধ্বস্ত বিমানে হতাহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আনা হয়েছে কাঠমান্ডুতে। স্বজনদের অবস্থা দেখে কেউ কথাই বলতে পারছিলেন না। বাংলাদেশ দূতাবাস তাঁদের দেখভাল করছে। কামরুন্নাহর স্বর্ণার মা সালমা বেগম গতকাল সকালে কাঠমান্ডুতে এসেছেন। মেয়ের অবস্থা দেখে তিনি দিশেহারা। একই অবস্থা আহত রেজওয়ানের পরিবারের সদস্যদেরও। তাঁরাও কোনো কথা বলতে চান না।
বিমান দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫১ জন। এর মধ্যে ইউএস-বাংলার ৪ ক্রুসহ ২৬ জন বাংলাদেশি। নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন বিমানের পাইলট আবিদ সুলতান। তিনি গতকাল সকালে নরভিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আর নেপালের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, আহত চীনা নাগরিক ঝ্যাং মিং গতকাল মারা গেছেন।
উড়োজাহাজে থাকা ৩২ বাংলাদেশি যাত্রীর মধ্যে বেঁচে আছেন ১০ জন, তাঁদের একজনের অবস্থা গুরুতর। বাকিদের অবস্থা খারাপ নয় বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। আহত ১০ জন হলেন শাহরিন আহমেদ, ইয়াকুব আলী, মো. শাহীন ব্যাপারী, মো. রেজোয়ানুল হক, মেহেদী হাসান, ইমরানা কবীর হাসি, মো. কবীর হোসেইন, সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, শেখ রাশেদ রুবায়েত ও আলমুন নাহার অ্যানি। আহত ব্যক্তিদের আটজনকে কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, একজনকে নরভিক ও একজনকে ওম হাসপাতালে রাখা হয়েছে। আহত বাকি ১০ জন অন্য দেশের নাগরিক।
যাত্রীদের মধ্যে মারা গেছেন ফয়সাল আহমেদ, আলিফুজ্জামান, বিলকিস আরা, বেগম হুরুন নাহার বিলকিস বানু, আখতারা বেগম, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, রকিবুল হাসান, হাসান ইমাম, মো. নজরুল ইসলাম, আঁখি মণি, মিনহাজ বিন নাসির, ফারুক হোসেন প্রিয়ক, তাঁর মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী তামারা (শিশু), মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহিরা তানভিন শশী রেজা, পিয়াস রায়, বেগম উম্মে সালমা, মো. নুরুজ্জামান, রফিক জামান, তাঁর স্ত্রী সানজিদা হক বিপাশা এবং তাঁদের ছেলে অনিরুদ্ধ জামান (শিশু)।
ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটির পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ, ক্রু খাজা হোসেন মো. শাফি এবং শারমিন আক্তার নাবিলাও মারা গেছেন।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৯টি মৃতদেহ রাখা হয়েছে কাঠমান্ডু টিচিং হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান প্রমোদ চেস্টা বলেন, তাঁদের কাছে থাকা ৪৯টি মৃতদেহের মধ্যে ৮ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদের এখনো শনাক্ত করা হয়নি। তিনি বলেন, এখনো এই ৪১ জনের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাঁদের ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, অনেকের শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে তাঁদের কোনোভাবেই চেনা সম্ভব হচ্ছে না। ময়নাতদন্ত শেষ হলে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে চেনার চেষ্টা করা হবে। সেটা না হলে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। গতকাল পর্যন্ত ১১ জনের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। সবার ময়নাতদন্ত শেষ হতে আরও তিন-চার দিন লাগবে বলে তিনি জানান। গতকাল মারা যাওয়া পাইলটের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য এখনো আনা হয়নি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস গতকাল নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এ পর্যন্ত ১০ জন বাংলাদেশিকে শনাক্ত করেছি। তাঁদের মধ্যে একজনের অবস্থা খারাপ। তাঁকে চিকিৎসার জন্য অন্য একটি দেশে নেওয়ার কথা রয়েছে। তিনি জানান, ঢাকা থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের জন্য একটি সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। নেপাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। মৃতদেহ দেশে পাঠাতে কত সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব মৃতদেহ দেশে পাঠানো হবে। এ জন্য ঢাকায় বিমানবাহিনীর জাহাজ প্রস্তুত আছে। বললেই তারা চলে আসবে।
উদ্ধারকাজে কোনো গাফিলতি ছিল কি না, জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘নেপালে ২৫ বছরে এত বড় ঘটনা ঘটেনি। তারপরও তারা অনেক করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু করেছে। আমার মনে হয়, এতে কোনো গাফিলতি ছিল না।’
এদিকে দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের লাশ শনাক্ত করার প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে নেপালকে ডিএনএ পরীক্ষার কাজে সহযোগিতা করতে চায় বাংলাদেশ। নেপালকে বাংলাদেশের ডিএনএ ল্যাব ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম গত রাতে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, এ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হলেও আলাদা করে প্রত্যেকের মৃতদেহ শনাক্ত করা যায়নি। নেপালেরও সমানসংখ্যক নাগরিক ওই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ফলে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থানীয় যাত্রীদের শ পাঁচেক স্বজন হাসপাতালে ভিড় জমান। এমনিতেই বিমানে আগুন লাগায় নিহত ব্যক্তিদের চিনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এর ওপর যোগ হয়েছে স্থানীয় লোকজনের ভিড় আর হট্টগোল। সব মিলিয়ে নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত হতে সময় লাগছে। এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নেপালকে সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
নেপালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্ত করে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরেছেন। তিনি আজ সকাল ১০টায় সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করবেন। সেখানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র গত রাতে জানিয়েছে, বৈঠকে শোকাবহ ঘটনার স্মরণে কয়েক দিনের জাতীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে