হাসান মামুন:: এ নিবন্ধ লেখার সময় অনলাইনে নিকারাগুয়ার ১০০ সরকারি কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের খবর দেখতে পাচ্ছি। ২০২১ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে টানা চারবার জয়ী হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার ঘটনায় দেশে-বিদেশে তীব্র সমালোচনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দানিয়েল ওর্তেগা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি শুরু করেছে আগেই। কয়েকজন ক্ষমতাবানের অর্থসম্পদও জব্দ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। মানবাধিকার সংকুচিত ও গণতন্ত্রকে দুর্বল করার অভিযোগে নতুন করে আরও কিছু কর্মকর্তার বিষয়ে এবার ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের এখনো কমপক্ষে চার মাস বাকি। এর মধ্যে ঘটনা কোনদিকে গড়াবে, বলা কঠিন। বিরোধী দল ও তার সহযোগীরা সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। অতীতে এমন পরিস্থিতিতে যে ধরনের তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা এ দেশে লক্ষ করা গিয়েছিল-এবার তেমনটি হচ্ছে না। তেমন আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে চাপে ফেলার সামর্থ্যও বিরোধী দলের নেই বলে মনে করা হচ্ছে। তারা বড় জনসমর্থন বা সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট মানুষ কম না হলেও তাদের আন্দোলনে শামিল করতে বিরোধী দল ব্যর্থ বলেও অনেকের অভিমত। এ অবস্থায় বিশ্বের এক নম্বর প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বিশেষ ভিসানীতি ঘোষণাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। এ-ও মনে করা হচ্ছে, দেশটির ইউরোপীয় মিত্ররা এক্ষেত্রে তার নীতি ও পদক্ষেপ অনুসরণ করবে। এর আলামতও ইতোমধ্যে কম পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এমনও মনে করা হচ্ছে, বিএনপি ও তার সহযাত্রীরা অপেক্ষা করে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে নির্বাচন ঘিরে আরও কিছু পদক্ষেপের জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে, এমনকি প্রধানমন্ত্রী সময়ে সময়ে এত খোলামেলা বক্তব্য দিচ্ছেন যে, তাতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আগামী নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কের অবনতি। সরকারের পক্ষে শক্তিশালী কোনো দেশ নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না। দুই পরাশক্তি ও প্রভাবশালী দেশ রাশিয়া ও চীন ঘোষণা দিয়েই রয়েছে সরকারের পক্ষে। আগামী নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাকে তারা বাংলাদেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ বলেও বর্ণনা করেছে একাধিকবার। তাতে সরকারপক্ষ চাঙাবোধ করলেও তারা বেশি করে অপেক্ষায় আছে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্পষ্ট অবস্থানের জন্য। ভারত আবার সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ। বিশেষত এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অভিন্ন কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে বলেই মনে করা হয়। এখানে তাদের অভিন্ন প্রতিপক্ষ হলো চীন। এ অবস্থায় ভারত শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে দৃঢ়ভাবে থাকলে সেটা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নমনীয় করতে পারবে বলেও সরকার পক্ষের আশা। এমন ধারণাপ্রসূত আশাবাদ ঘিরে তৎপরতাও শুরু করা হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের একটি বাংলা সংবাদপত্র ও জার্মান সংবাদ সংস্থা পরিবেশিত ‘প্রতিবেদন’ পড়ে অনেকে মনে করছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পরিচালিত তৎপরতায় মিলছে এসব সুফল। ভারত নাকি যুক্তরাষ্ট্রকে নানান কথা বলে এ বার্তা দিয়েছে যে, হাসিনা সরকারকে দুর্বল করা হলে সেটা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে।
এ দুটি প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ রয়েছে। বিএনপি মহাসচিবও কিছুটা সংশয় রেখেই বলেছেন, বৃহৎ প্রতিবেশী ও গণতান্ত্রিক দেশ ভারত উল্লিখিত বার্তা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে থাকলে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে যে অবস্থান নিয়েছে, সেটাকে তিনি পরিষ্কারভাবেই মনে করেন জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। জনগণ সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। যুক্তরাষ্ট্রও সেটা চায়। আর বিএনপি মনে করে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তারা সহজেই জয়লাভ করবে। যে ধরনের ব্যবস্থায় অতীতে এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়েছে, তেমন ব্যবস্থা অর্জন করাটাই তাদের লক্ষ্য এখন। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য সে ব্যাপারে কিছু বলেনি। কোনো দলের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে তারা বলছে, এটি বাংলাদেশের জনগণ স্থির করবে। এদিকে ভারত এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে যা বলেছে, এর সারমর্ম হলো নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে বাংলাদেশের সংবিধানে নির্দেশনা রয়েছে। নির্বাচন যেন সে পরিকল্পনামতো শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় দুটি সংবাদমাধ্যম থেকে যা বলা হলো, সেটাকে এর ‘সম্ভাব্য সম্প্রসারণ’ বলা যেতে পারে। ঘটনা এদিকে এগোতে পারে না, তা কিন্তু বলা যায় না।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ফল কী হতে পারে, সে ব্যাপারে দেশে-বিদেশে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই মোটামুটি ধারণা রয়েছে। বিভিন্ন পক্ষ থেকে এর ওপর জরিপ পরিচালনার খবরও পাওয়া যায়। এ অবস্থায় ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশে শাসক দল পরিবর্তন ঘিরে কিছু উদ্বেগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত ২০০১ পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের কিছু ঘটনা ভারতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টার অংশ বলেই মনে করা হয়। ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে বাংলাদেশে তখন জঙ্গিবাদের উত্থানও দেখতে হয়েছিল। ওই সময়ে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবও ছিল কঠোর, যা জঙ্গিবাদ দমনে সহায়ক হয়েছিল। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন টানা তিন মেয়াদের সরকার এর সুফলও কম তোলেনি। তবে এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব হয়েছে পরিবর্তিত। বিশ্বব্যাপী তারা এখন জোর দিচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর। বিশেষত বাইডেন প্রশাসন এ নীতি-আদর্শের আওতায় কর্তৃত্ববাদী শাসন বিস্তারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যাতে চীন-রাশিয়ার মতো দেশ এদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে তার প্রভাববলয় বাড়াতে না পারে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থও গভীরভাবে নিহিত রয়েছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে নেওয়া তার অবস্থানে।
এখন কথা হলো, ভারত এটাকে কতখানি প্রভাবিত করে বদলাতে সক্ষম? যুক্তরাষ্ট্র যখন জোরালোভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে, তখন ভারত কি সেটাকে ‘হাসিনা সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা’ বলে অভিহিত করতে পারবে? উলটোদিক থেকে, যুক্তরাষ্ট্রও কি পারবে তার কৌশলগত মিত্র ভারতের মনোভাবকে পুরো অগ্রাহ্য করে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করতে? কিংবা নির্বাচন আগের ধারাতেই হলে নিকারাগুয়া ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে সরকারকে কাবু করতে? শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞা নয়; এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে কঠিন শর্তে ফেলার শঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। ভারতের ভূমিকা এটা রোধে কতখানি সহায়ক হবে, সে প্রশ্ন রয়েছে সংশ্লিষ্ট সব মহলে। হাসিনা সরকারের পক্ষে ভারতের মোদি সরকারের ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া যত সহজ, সে নির্বাচনে কোনো দলের পক্ষে অবস্থান নেওয়া তত সহজ নয়। তার ওপর ভারতের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এবং এ সম্পর্ক রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হলেও এদেশের জনগণের বদলে একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতেই অভ্যস্ত। এটা ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নেরও অনুকূল নয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে উল্লিখিত দুই প্রভাবশালী দেশের অবস্থান কতটা কী পরিবর্তিত হবে, তা এখনই বলে দেওয়া সম্ভব নয়। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অভিন্ন স্বার্থের কারণে তাদের ভূমিকা সংশোধিত হয়ে শেষে একটা বিন্দুতে মিলিত হলেও অবাক হওয়া যাবে না।
ইতোমধ্যে দেশের ভেতর বিরোধী দলের নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলন কতটা তীব্র রূপ নেয়, তার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়ে তা সরকারকে গভীর খাদে নিক্ষেপ করবে বলে অবশ্য মনে হয় না। তবে নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠলে একই সঙ্গে বাইরের চাপের মুখে থাকা সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেপরোয়া হয়ে পড়তে পারে। সেটা আবার অনিবার্য করে তুলতে পারে নতুন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক