আজম রেহমান,সারাদিন ডেস্ক::একে একে জার্মানি, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল ও স্পেনের বিদায়ে দ্যুতিহীন হয়ে পড়া বিশ্বকাপকে বাঁচিয়ে রেখে হাসতে হাসতে শেষ আটে চলে গেল হারাধনের শেষ ছেলে ব্রাজিল। জোগো বনিতোর মাতাল সুরভি ছড়িয়ে সামারায় ফুটল হলুদ ফুল। সবুজের সর্বনাশ হল নেইমার, ফিরমিনোর গোলে। গ্রুপপর্বে ঠিক সেভাবে ঝলসে উঠতে না পারলেও শেষ ষোলোর অগ্নিপরীক্ষায় মন মাতানো গতিময় ফুটবল খেলে ফেভারিটের মতোই জিতল ব্রাজিল। সোমবার দারুণ উপভোগ্য ম্যাচে মেক্সিকোকে ২-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।
একই দিনে ফের রূপকথার জাল বোনা হল না জাপানিদের। হাতছানি ছিল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার। ২-০ গোলে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত বেলজিয়ামের কাছে ৩-২ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল এশিয়ার সর্বশেষ প্রতিনিধিরা।
গ্রুপপর্বে প্রত্যাশার পুরোটা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার চাবুকে রক্তাক্ত হয়েছেন নেইমার। মাঠেই তার জবাব দিলেন ব্রাজিলের স্বপ্নসারথি। আগ্নেয়গিরির মতো লাভা উদ্গিরণ করে পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন মেক্সিকোকে। ৫১ মিনিটে মেক্সিকোর প্রতিরোধ ভেঙে ব্রাজিলকে এগিয়ে দেয়ার পর ৮৮ মিনিটে ফিরমিনোকে দিয়ে দ্বিতীয় গোলটি করান নেইমার। তাতেই নিশ্চিত বিশ্বকাপে ব্রাজিলের টানা সপ্তম কোয়ার্টার ফাইনাল। ব্রাজিলের বিপক্ষে কাল কার্যত একাই লড়েছেন মেক্সিকোর গোলকিপার গিলের্মো ওচোয়া। চীনের প্রাচীর হয়ে তিনি আটটি অবিশ্বাস্য সেভ না করলে মেক্সিকোকে বড় লজ্জাতেই পড়তে হতো। তবে ওচোয়ার বীরত্ব এবং নিজেদের পেশিশক্তির দৃষ্টিকটু প্রদর্শনীতেও শেষ রক্ষা হয়নি মেক্সিকোর। এ নিয়ে টানা সাতবার বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকে ফিরতে হল উত্তর আমেরিকার দেশটিকে।
সামারা অ্যারেনায় মেক্সিকোর গতিময় ফুটবল শুরুতে ব্রাজিলকে কাঁপিয়ে দিলেও স্বরূপে ফিরতে বেশি সময় লাগেনি সেলেকাওদের। গোলশূন্য প্রথমার্ধে সবমিলিয়ে দু’দলই উপহার দিয়েছে দারুণ উপভোগ্য ফুটবল। প্রথম ২৫ মিনিট মেক্সিকানরা ব্রাজিলের রক্ষণে ভীতি ছড়ালেও সত্যিকার অর্থে গোলের পরিষ্কার কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। এরপর ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে আক্রমণের ঝড় তোলে ব্রাজিল। শুধু গোলটাই আসেনি। সেজন্য পুরো কৃতিত্ব মেক্সিকোর ওচোয়ার। ২০১৪ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে মেক্সিকোর সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছিল ব্রাজিল। সেই ম্যাচে অবিশ্বাস্য কিছু সেভ করে নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন ওচোয়া। কাল সেই স্মৃতি ফিরিয়ে এনে আবারও ব্রাজিলের সামনে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেন মেক্সিকান গোলকিপার। দারুণ দক্ষতায় গোলবঞ্চিত করলেন নেইমার-জেসুসদের। গ্রুপপর্বে সেভাবে জ্বলে উঠতে না পারা ব্রাজিলের প্রাণভোমরা নেইমারই সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন মেক্সিকোকে। কিন্তু বিরতির আগে গোটা কয়েক দারুণ সুযোগ পেয়েও ভাঙতে পারেননি ওচোয়ার প্রতিরোধ। প্রথমার্ধে ব্রাজিলের তিনটি দুর্দান্ত আক্রমণের বিপরীতে গোলমুখে একটি শটও নিতে পারেনি মেক্সিকো। তবে বল পজেশনে দু’দলের অবস্থান খুব কাছাকাছি ছিল। ৫২ শতাংশ সময় বল ছিল ব্রাজিলের দখলে। এছাড়া সেলেকাওদের ২০৭টি পাসের বিপরীতে মেক্সিকোর পাস ১৯৩টি।
পাঁচ মিনিটে নেইমার ২০ গজ দূর থেকে জোরালো শটে ওচোয়ার পরীক্ষা নিয়েছিলেন। এরপর মিনিট বিশেক আক্রমণ আর দ্রুত প্রতিআক্রমণে ব্রাজিলের রক্ষণভাগকে ব্যতিব্যস্ত রাখে মেক্সিকো। তবে গোল লক্ষ্য করে শটগুলো সফলতার সঙ্গেই ঠেকান ফিলিপ লুইস-মিরান্দারা। বেগ পেতে হয়নি গোলকিপার আলিসনকে। ২৫ মিনিটে পায়ের কারিকুরিতে মেক্সিকান ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে খুব কাছ শট নিয়েছিলেন নেইমার। কিন্তু তৎপর ওচোয়া হাত লাগিয়ে সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। এরপর থেকে যেন খেলায় ফেরে ব্রাজিল। ৩২ মিনিটে আবারও ডিফেন্ডারদের ছিটকে ডি-বক্সে ঢুকে শট নিয়েছিলেন নেইমার। কিন্তু এবারও ওচোয়াকে ফাঁকি দেয়া যায়নি। বিরতির আগে একইভাবে হতাশ হতে হয় গ্যাব্রিয়েল জেসুসকেও। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও একই ছবি। আবারও মেক্সিকোর ত্রাতা ওচোয়া। ৪৮ মিনিটে ঠেকান ডি-বক্সের ভেতর থেকে ফিলিপে কুতিনহোর বুলেট গতির শট। অবশেষে ৫১ মিনিটে মেক্সিকোর প্রতিরোধ ভেঙে নেইমারের পা থেকেই আসে কাঙ্ক্ষিত গোল। ডি-বক্সের ঠিক বাইরে তার বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাক হিলে বল পেয়ে সামনে এগিয়ে বাঁ দিক থেকে নিচু ক্রস বাড়ান উইলিয়ান। বল ওচোয়ার বাড়ানো হাত আর জেসুসের পা ফাঁকি দিলেও নেইমার বুটের আলতো ছোঁয়ায় মেক্সিকোর জাল কাঁপিয়ে ঠিকই উৎসবের উপলক্ষ এনে দেন ব্রাজিলকে। এই গোলেই জার্মানির ২২৬ গোলের কীর্তি ছাড়িয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২২৭ গোলের রেকর্ডটি নিজেদের করে নিল ব্রাজিল। আট মিনিট পর ব্যবধান বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেন পাউলিনহো। ডি-বক্সের ভেতর থেকে বার্সেলোনা মিডফিল্ডারের জোরালো শট সোজা ওচোয়া বরাবর যায়। ৬১ মিনিটে কার্লোস ভেলার দূরপাল্লার শট আস্থার সঙ্গেই ফেরান ব্রাজিলের শেষপ্রহরী আলিসন। দুই মিনিট পর আবারও ওচোয়া মেক্সিকোকে ম্যাচে রাখেন উইলিয়ানের জোরালো শট কর্নারের বিনিময়ে ঠেকিয়ে। ৬৮ মিনিটে পাল্টা আক্রমণে আবারও মেক্সিকোর রক্ষণে আতঙ্ক ছড়ান উইলিয়ান। দুর্দান্ত গতিতে বাঁ দিক দিয়ে এগিয়ে ক্রস বাড়িয়েছিলেন নেইমারকে। ব্রাজিল তারকার শট এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে পোস্টের সামান্য বাইরে দিয়ে যায়। নেইমারকে ঠেকাতে শেষ কৌশল হিসেবে ফাউলের পথ বেছে নেন মেক্সিকান ডিফেন্ডাররা। কিন্তু বারবার ব্যথায় কাতর হয়েও একটি গোল করে ও একটি করিয়ে নেইমারই বাজিয়ে দেন মেক্সিকোর বিদায়ঘণ্টা। ৮৮ মিনিটে নেইমারের দারুণ একটি পাস থেকেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কুতিনহোর বদলি হিসেবে নামা রবার্তো ফিরমিনো।
রোস্তভ এরেনায় রূপকথার জন্ম দিতে পারত জাপান। বিশ্বকাপে ইউরোপের ডার্কহর্স বেলজিয়ামের দর্পচূর্ণ করে দিয়ে ম্যাচের লিড নিয়েছিল তারাই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ম্যাচের শুরু থেকে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে যায় দু’দলই। প্রথমার্ধ গোলশূন্যভাবেই শেষ হয়। ম্যাচের ৪৮ মিনিটে এগিয়ে যায় দ্বীপদেশটি। নিজেদের সীমানা থেকে মিডফিল্ডার গাকু শিবাসাকির থ্রু বল ঠেকাতে ব্যর্থ হন ইয়ান ভার্টোনেন। বল ধরে ডি-বক্সে ঢুকে ছুটে আসা ভার্টোনেনকে কোনো সুযোগ না দিয়ে দূরের পোস্ট দিয়ে লক্ষ্য ভেদ করেন জেনকি হারাগুচি (১-০)। মিনিট চারেক পর ব্যবধান দ্বিগুণ করেন তাকাশি ইনুই। মিডফিল্ডার শিনজি কাগাওয়া বেলজিয়ানদের কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে ব্যাক পাসে বল দেন ইনুইকে। ডি-বক্সের সামনে থেকে ডান পায়ের দুর্দান্ত এক শটে বল জালে জড়িয়ে দেন ইনুই। ঝাঁপ দিয়েও বলের নাগাল পাননি বেলজিয়ান গোলকিপার থিবাউট কুর্তোস (২-০)। দুই গোলে এগিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে মাকোতো হাসাবের দল।
তবে এশিয়ানদের উল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল করে ম্যাচে ফেরেন লুকাকুরা। ৬৯ মিনিটে কর্নার থেকে উড়ে আসা বল গ্রিপে নিতে ব্যর্থ হন জাপানি গোলকিপার কাওয়াশিমা। উড়ন্ত বলে ভার্টোনেনের দুর্দান্ত হেড জালে জড়িয়ে যায় (১-২)। দলকে খেলায় রাখেন এই টটেনহ্যাম হটস্পারের এই ডিফেন্ডার। মিনিট পাঁচেক পর বাঁ-প্রান্ত থেকে আজারের দুর্দান্ত ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে দেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মিডফিল্ডার মারোয়ান ফেলাইনি (২-২)। সমতায় ফেরে ইউরোপিয়ানরা। ম্যাচের অন্তিম সময়ে জয়সূচক গোলটি করেন নাসের শাদলি।
কুর্তোসের বাড়ানো বল ধরা মুনিয়ের ক্রস জালে জড়িয়ে দেন বদলি মিডফিল্ডার শাদলি (৩-২)।
এবার বিশ্বকাপে শিরোপার অন্যতম দাবিদার ভাবা হচ্ছে লুকাকুদের। ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলেছিল বেলজিয়াম। সেই ইতিহাস টপকে ফাইনালে ওঠার স্বপ্নে বিভোর রয়েছেন বেলজিয়ানরা। মঙ্গলবার জাপানকে হতাশায় ডুবিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নের পথে আরও একধাপ এগোলেন মার্টিনেজের শিষ্যরা। এই জয়ে বেলজিয়াম পরিসংখ্যানেও সমতা ফেরাল। দু’দলের ছয়বারের দেখায় দুটি করে ম্যাচ জিতেছে উভয়েই। ড্র হয়েছে বাকি দুটি।