সারাদিন ডেস্ক::ঘুষ নেওয়ার দণ্ডিত সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলেছে হাই কোর্ট; এতে আসন্ন নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।
প্রায় এক যুগ আগের মামলাটিতে গত বছর তার সাত বছরের সাজা কমিয়ে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল হাই কোর্ট। রোববার হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে ঘটনা ও মামলার নথিপত্র-দলিলাদি পর্যালোচনা করে বলা হয়েছে, কোনো সারবত্তা না পাওয়ায় নাজমুল হুদার আপিলটি খারিজ করা হল।বাকি সাজা ভোগ করতে বিচারিক আদালতের রায়ের অনুলিপি গ্রহণের ৪৫ দিনের মধ্যে আপিলকারী (নাজমুল হুদা) বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিচারিক আদালত তার (নাজমুল হুদার) গ্রেপ্তার নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার তোড়জোড়ের মধ্যে আদালতের এই রায় মুশকিলে ফেলেছে বলে স্বীকার করেছেন নাজমুল হুদা নিজেই। খালেদা জিয়ার সরকারের দুই বারের মন্ত্রী নাজমুল হুদা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যও ছিলেন। পরে বিএনপি থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথমে বিএনএফ গঠন করেন, ওই দলের কর্তৃত্ব হারানোর পর তিনি গঠন করেন তৃণমূল বিএনপি। এখন ওই দল নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়ে ঢাকা-১৭ আসনে প্রার্থী হতে চাইছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, দুর্নীতি একটি অভিশাপ। সমাজের সর্বত্রই দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে। কোনো সরকারি কর্মচারীর দুর্নীতি শুধু সমাজের ভিত্তিকেই বিনষ্ট করে না, তা জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। যখন একজন ব্যক্তি সরকারের কোনো শীর্ষ পদে যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তখন ওই দুর্নীতি দেশের অর্থনীতি, জাতীয় স্বার্থ ও ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি করে।
হুদা দম্পতির আপিলের উপর পুনঃশুনানি শেষে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের হাই কোর্ট বেঞ্চ গত বছরের ৮ নভেম্বর এই রায় দিয়েছিল। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ২১ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম ধানমণ্ডি থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘খবরের অন্তরালে’র জন্য মীর জাহের হোসেন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন নাজমুল হুদা ও তার স্ত্রী সিগমা হুদা। ২০০৭ সালের ২৭ অগাস্ট বিশেষ জজ আদালতে এই মামলায় নাজমুল হুদাকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং আড়াই কোটি টাকা জরিমানা করে। পাশাপাশি তার স্ত্রী সিগমা হুদাকে তিন বছরের দণ্ড দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে নাজমুল হুদা ও সিগমা হুদা আপিল করলে ২০১১ সালের ২০ মার্চ হাই কোর্ট তাদের খালাস দেয়। রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলে উভয় আবেদনের শুনানি করে সর্বোচ্চ আদালত ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর হাই কোর্টের রায় বাতিল করে পুনঃশুনানির নির্দেশ দেয়। পরে মামলাটির পুনরায় শুনানি নিয়ে গত বছরের ৮ নভেম্বর হাই কোর্ট রায়ে নাজমুল হুদার সাত বছরের সাজা কমিয়ে চার বছরের কারাদণ্ড দেয়। হাই কোর্টের এ রায়ের পর নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ ছাড়াই হাই কোর্টের সাজার বিরুদ্ধে আপিল শুনানির অনুমতি চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন নাজমুল হুদা। কিন্তু চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সে আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।
রোববার হাই কোর্টের রায় প্রকাশের পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, “রেকর্ডসহ প্রকাশিত রায়টি নিম্ন আদালত যেদিন রিসিভ করবে, সেদিন থেকে আত্মসমর্পণের ৪৫ দিন কার্যকর হবে। অর্থাৎ হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়টি বিচারিক আদালত যেদিন গ্রহণ করবে, সেদিন থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে নাজমুল হুদাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।”
এ অবস্থায় নাজমুল হুদা আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না- জানতে চাইলে খুরশীদ আলম খান বলেন, “সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২(ঘ) অনুযায়ী আমি মনে করি উনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এটা আমার নিজস্ব আইনি অভিমত।”
তিনি বলেন, “নিম্ন আদালতের রায়ে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, উচ্চ আদালতের রায়ে সে সাজা থেকে খালাস পেতে হবে অথবা উচ্চ আদালতে সে সাজা স্থগিত হতে হবে। তবেই তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। যেহেতু উচ্চ আদালতের রায়ে উনাকে চার বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে, তাই নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাকে সর্বোচ্চ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেতে হবে।”
নাজমুল হুদা বলেন, “এই রায়টা অনেক আগেই প্রকাশ হওয়া উচিৎ ছিল। এটা না হয়ে আমার ভীষণ অসুবিধা হয়েছে।
আমাকে খুব তড়িঘড়ি করে মুভ করতে হবে। কারণ এটা যেহেতেু এখন বিচারিক আদালতে যাবে। তাছাড়া আমি জানলাম কী রায়টা হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত তো আমি জানতেই পারি নাই, কারণ রায় দেওয়া হয় নাই। হলে হয়ত আমি স্ট্যান্ড নিতে পারতাম, এমনকি নির্বাচন কমিশনেও স্ট্যান্ড নিতে পারতাম। এতদিন যেহেতু রায়ই হয় নাই, তাহলে আমাকে কনভিকটেড ধরা হবে কেন? দণ্ডপ্রাপ্ত ধরাই বা হবে কেন? এখন যেহেতু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেয়েছে আমি আইনি স্টেপ নিব।
ব্যারিস্টার হুদা আরও বলেন, “এই রায়ের মধ্যেই আছে ৪৫ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে সারেন্ডার করতে হবে। ৪৫ দিন কেন, এটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হয়ত আমি সারেন্ডার করতে পারব। সারেন্ডার করে আমি আমার মতো লিগ্যাল স্টেপ নিয়ে রায়টাকে স্থগিত করার স্টেপ নিতে পারব। তাছাড়া গভর্নমেন্ট ইচ্ছা করলে সাজাটা স্থগিত করে দিতে পারে।
এ অবস্থায় আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী ২ বছরের সাজা হলেই তো নির্বাচনের জন্য ডিসকোয়ালিফাইড। এই কেসে তো হাই কোর্টে আমি খালাস পেয়ে গিয়েছিলাম। সেটার অ্যাগেইনেস্টেই তো টাকা-পয়সা খেয়ে-টেয়ে আমাকে জড়ায়া দিল। তার আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী দুজনকে এই জন্য দায়ী করেন তিনি। এর সঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকেও তিনি দায়ী করেন। ৪ বছরের সাজা পাওয়া এ মামলাটি সাবেক পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ক্ষমতার অপব্যবহার ও উৎকোচ নিয়ে প্রভাবিত করেছেন অভিযোগ করে গত ২৭ সেপ্টেম্বর শাহবাগ থানায় মামলা করেন নাজমুল হুদা। পরে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ নাজমুল হুদার করা মামলাটির নথি পাওয়ার পর বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন।