ঢাকা ০২:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শেষ মুহূর্তের চেষ্টা তদবির

image

সারাদিন ডেস্ক::একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা পর্ব শেষ; এখন দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে শেষ মুহূর্তের চেষ্টা-তদবির চলছে। জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই জোটগত বা দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করার যে রীতি, এবার তা প্রতিপালন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোট’ এবং বিএনপির ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’। বেশিরভাগ সংসদীয় আসনে উভয় জোটের দুই বা ততোধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এখন কে দলীয় বা জোটগত প্রার্থী হবেন, এ নিয়ে চলছে কেন্দ্রমুখী তৎপরতা। এদিকে প্রকাশ্যে সবাই দলীয় প্রতীকের পক্ষে থাকার কথা বললেও নেপথ্যে বিদ্রোহের গুঞ্জন উঠেছে অনেক আসনেই।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, দেশের তিনশ সংসদীয় আসনে এবার মোট ৩০৬৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। গড়ে প্রতি আসনে প্রার্থী ১০ জনেরও বেশি (১০ দশমিক ২২ জন)। এদের মধ্যে দলগুলোর প্রার্থী ২ হাজার ৫৬৯ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৪৯৮ জন। এবার নিবন্ধিত ৩৯টি দলের সবাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট, দল, নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সংসদীয় ৩০০ আসনের বিপরীতে মহাজোটের আটশ’র বেশি প্রার্থী এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের পক্ষে এক হাজারের বেশি প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মহাজোটের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ ২৬৪ আসনের বিপরীতে প্রার্থী দিয়েছে ২৮১ জন। অন্যদিকে ২৯৫ আসনের বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী অন্তত ৬৯৬ জন। মহাজোটের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ৪৫ আসনের নিশ্চয়তা দেয়া হলেও ২১০টি আসনে জাপার প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এই জোটের জাকের পার্টি ১০৮ জন প্রার্থী, ওয়ার্কার্স পার্টি ৫টি আসনে জোটগত নিশ্চয়তা পেলেও অন্তত ৩৩টি আসনে দলীয় প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছে। অন্য শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) প্রায় ৫৩ জন প্রার্থী, গণতন্ত্রী পার্টির ৮ জন প্রার্থী, সাম্যবাদী দলের ৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। একইভাবে আরও কয়েকটি শরিক দল মহাজোট থেকে নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত আসনের চেয়ে বেশি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। এদিকে বিএনপির আটশ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা ছাড়াও, দলটির নির্বাচনী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিক গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি-রব) প্রার্থীরা বিভিন্ন আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিএনপির অন্য জোট ২০ দল থেকেও দলীয়ভাবে বিভিন্ন আসনে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে এই জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলটির প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন জোটগত আসন বণ্টন চূড়ান্ত করে একক প্রার্থী নিশ্চিতকরণ এবং বিদ্রোহ দমনই ‘মহাজোট এবং ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ এর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনটি বর্তমানে জাতীয় পার্টির লিয়াকত হোসেন খোকার দখলে। এবারও তিনি জাপার মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ এখানে প্রার্থী ঘোষণা না করলেও দলটির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল কায়সার (কায়সার হাসনাত) এবং তার চাচা আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন উভয়েই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা সংবাদকে জানান, এলাকার নেতাকর্মীরা কায়সারকে নৌকার প্রার্থী করার জোর প্রচেষ্ট চালাচ্ছে। চলছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ তদবির। কায়সার নৌকা পেলে তার চাচা মোশারফ নির্বাচন করবেন না। তবে লাঙ্গল প্রার্থী হলে মোশারফ স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন।

এদিকে চাঁদপুর-১ আসনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে দল থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া না হলে একযোগে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে চাঁদপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইয়ুব আলী পাটোয়ারী। এ সময় দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এই আসনে গোলাম হোসেনকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

মহাজোট থেকে ফরিদপুর-২ আসন জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমির ফয়সালকে দেয়ার চিন্তা করেই প্রথমে বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। এরপর সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সাজেদা চৌধুরীর স্থানীয় সমর্থকরা এই আসনে তার মনোনয়নের দাবিতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এই প্রেক্ষাপটে শেষ সময়ে সাজেদা চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এই আসনে আমির ফয়সাল এবং সাজেদা চৌধুরী উভয়েই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এখানে কে মহাজোটের প্রার্থী হয়, তা প্রার্থিতা প্রত্যাহরের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।

আওয়ামী লীগ থেকে বরিশাল-২ আসনে প্রথমে মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয় বর্তমান সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুসকে। চেষ্টা-তদবির করে মঙ্গলবার এই আসনে মনোনয়নের চিঠি নিয়ে যান ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহ আলম। তালুকদার ইউনুস মনোনয়নপত্র জমাদানে বিরত থাকেন। আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে শেষ দিন মনোনয়নপত্র জমা দেন শাহ আলম। তবে এই আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি থেকে চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)-কে মনোনয়ন দিয়েছে। তাকে মহাজোটের একক প্রার্থী করতে দেন-দরবার চালাচ্ছে জাপা।

আইনি জটিলতায় প্রার্থী বাদ পড়ার সম্ভাবনা এবং মহাজোটের দুর্বল প্রার্থীদের কথা বিবেচনা করে অন্তত ১৪টি আসনে দুজন করে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অনেকগুলোতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীও রয়েছে। ফলে এসব আসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী কে হচ্ছেন, তা নিশ্চিত হতে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ (৯ ডিসেম্বর) দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এক আসনে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে বিপাকে পড়েছে বিএনপি। প্রায় প্রত্যেক আসনেই দুই-তিন জন, কোন কোন আসনে চারজনকেও মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রত্যেক আসনেই দুই থেকে তিনজন করে জুনিয়র নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এসব জুনিয়র নেতারা মনোনয়ন পাওয়ার পর এখন আর সিনিয়র নেতাদের মান্য করছেন না। ফলে ওই প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হওয়া ছাড়াও সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। অনেক সিনিয়র নেতাকে এখন জুনিয়র নেতাদের সঙ্গে মনোনয়ন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হচ্ছে। এই সিনিয়র নেতাদের মধ্যে দুই থেকে তিন বারের সংসদ সদস্যও রয়েছেন।

সিলেটের ছয়টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে সিলেট-১ আসনসহ তিনটিতে দুজন করে প্রার্থী। বিএনপি বলছে, দুজন করে প্রার্থীর বিষয়টি কৌশল। তবে এতে নেতাকর্মীরা দোটানার মধ্যে পড়েছেন। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় চূড়ান্ত প্রার্থীদের পুরোদমে প্রস্তুতি নিতে এমন কৌশল হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ। এছাড়া বিএনপির একাধিক প্রার্থী রয়েছে, পটুয়াখালী-২ আসনে ৩ জন, পটুয়াখালী-৩ ৩ জন, পটুয়াখালী-৪ এ ২ জন প্রার্থী রয়েছেন। তবে বিএনপির এক শীর্ষ নেতা জানান, একাধিক আসনে দুই থেকে চার জন ব্যক্তিকে ধানের শীষের প্রত্যয়নপত্র দেয়ার পিছনে কৌশল আছে বিএনপির। যদি একজন করে প্রার্থী দেয়া হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারে ক্ষমতাসীনরা। ফলে প্রার্থী সংকটে পড়তে হতে পারে। মূলত এই চিন্তা থেকেই একাধিক প্রার্থী রাখা হয়েছে। কিন্তু এই কৌশলই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিএনপির। একাধিক প্রার্থী দেয়ার কারণে কোন কোন আসনে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মিজানুর রহমান সিনহা ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আলী আজগর রিপন মল্লিকের পক্ষের লোকজন সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে বুধবার। এদিন দুপক্ষের প্রায় ১০ জন নেতাকর্মী আহত হয়। পিরোজপুরে জোট নেতা ইরানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে স্থানীয় বিএনপি। বুধবার পিরোজপুর জেলার ভা-ারিয়ায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিক লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরানকে। এই আসনে থানা বিএনপির সভাপতি আহমেদ সোহেল মনজুর সুমনকেও দলীয় মনোনয়ন দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা- গলাচিপা) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য যোগ দেয়া গোলাম মাওলা রনিকে মনোনয়ন দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রনির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় বিএনপি। তবে নিজের মনোনয়ন বহাল রাখতে কিংবা নতুন করে মনোনয়ন আনতে সবাই এখন কেন্দ্রমুখী যোগাযোগ ও চেষ্টা-তদবির করে যাচ্ছেন। জোটের আসন বণ্টন করে একক প্রার্থী দিলে অনেক আসনেই অন্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিদ্রোহ করতে পারেন বলে ধারণা করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

ইসি সচিবালয় সূত্রমতে, এবার জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনে মোট ৩০৫৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে ৭০৮ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এছাড়া রংপুরে ৩৬১, রাজশাহীতে ৩৫৩, খুলনায় ৩৫১, বরিশালে ১৮২, ময়মনসিংহে ২৩৬, সিলেটে ১৭৭ ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৮৮ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে ২৭ জন প্রার্থী হয়েছেন, যেটি সর্বোচ্চ। আর সবচেয়ে কম ৪ জন প্রার্থী হয়েছেন মাগুরা-২ আসনে। এবার কোন আসনে একক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি।

উল্লেখ্য, নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বাছাই হবে আগামী ২ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ ডিসেম্বর। এরপরই শুরু হবে প্রতীকসহ প্রচারণা। ভোট হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর, রোববার।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শেষ মুহূর্তের চেষ্টা তদবির

আপডেট টাইম ০৬:০৬:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ডিসেম্বর ২০১৮
image

সারাদিন ডেস্ক::একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা পর্ব শেষ; এখন দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে শেষ মুহূর্তের চেষ্টা-তদবির চলছে। জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই জোটগত বা দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করার যে রীতি, এবার তা প্রতিপালন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোট’ এবং বিএনপির ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’। বেশিরভাগ সংসদীয় আসনে উভয় জোটের দুই বা ততোধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এখন কে দলীয় বা জোটগত প্রার্থী হবেন, এ নিয়ে চলছে কেন্দ্রমুখী তৎপরতা। এদিকে প্রকাশ্যে সবাই দলীয় প্রতীকের পক্ষে থাকার কথা বললেও নেপথ্যে বিদ্রোহের গুঞ্জন উঠেছে অনেক আসনেই।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, দেশের তিনশ সংসদীয় আসনে এবার মোট ৩০৬৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। গড়ে প্রতি আসনে প্রার্থী ১০ জনেরও বেশি (১০ দশমিক ২২ জন)। এদের মধ্যে দলগুলোর প্রার্থী ২ হাজার ৫৬৯ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৪৯৮ জন। এবার নিবন্ধিত ৩৯টি দলের সবাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট, দল, নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সংসদীয় ৩০০ আসনের বিপরীতে মহাজোটের আটশ’র বেশি প্রার্থী এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের পক্ষে এক হাজারের বেশি প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মহাজোটের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ ২৬৪ আসনের বিপরীতে প্রার্থী দিয়েছে ২৮১ জন। অন্যদিকে ২৯৫ আসনের বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী অন্তত ৬৯৬ জন। মহাজোটের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ৪৫ আসনের নিশ্চয়তা দেয়া হলেও ২১০টি আসনে জাপার প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এই জোটের জাকের পার্টি ১০৮ জন প্রার্থী, ওয়ার্কার্স পার্টি ৫টি আসনে জোটগত নিশ্চয়তা পেলেও অন্তত ৩৩টি আসনে দলীয় প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছে। অন্য শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) প্রায় ৫৩ জন প্রার্থী, গণতন্ত্রী পার্টির ৮ জন প্রার্থী, সাম্যবাদী দলের ৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। একইভাবে আরও কয়েকটি শরিক দল মহাজোট থেকে নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত আসনের চেয়ে বেশি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। এদিকে বিএনপির আটশ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা ছাড়াও, দলটির নির্বাচনী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিক গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি-রব) প্রার্থীরা বিভিন্ন আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিএনপির অন্য জোট ২০ দল থেকেও দলীয়ভাবে বিভিন্ন আসনে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে এই জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলটির প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন জোটগত আসন বণ্টন চূড়ান্ত করে একক প্রার্থী নিশ্চিতকরণ এবং বিদ্রোহ দমনই ‘মহাজোট এবং ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ এর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনটি বর্তমানে জাতীয় পার্টির লিয়াকত হোসেন খোকার দখলে। এবারও তিনি জাপার মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ এখানে প্রার্থী ঘোষণা না করলেও দলটির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল কায়সার (কায়সার হাসনাত) এবং তার চাচা আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন উভয়েই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা সংবাদকে জানান, এলাকার নেতাকর্মীরা কায়সারকে নৌকার প্রার্থী করার জোর প্রচেষ্ট চালাচ্ছে। চলছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ তদবির। কায়সার নৌকা পেলে তার চাচা মোশারফ নির্বাচন করবেন না। তবে লাঙ্গল প্রার্থী হলে মোশারফ স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন।

এদিকে চাঁদপুর-১ আসনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে দল থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া না হলে একযোগে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে চাঁদপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইয়ুব আলী পাটোয়ারী। এ সময় দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এই আসনে গোলাম হোসেনকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

মহাজোট থেকে ফরিদপুর-২ আসন জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমির ফয়সালকে দেয়ার চিন্তা করেই প্রথমে বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। এরপর সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সাজেদা চৌধুরীর স্থানীয় সমর্থকরা এই আসনে তার মনোনয়নের দাবিতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এই প্রেক্ষাপটে শেষ সময়ে সাজেদা চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এই আসনে আমির ফয়সাল এবং সাজেদা চৌধুরী উভয়েই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এখানে কে মহাজোটের প্রার্থী হয়, তা প্রার্থিতা প্রত্যাহরের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।

আওয়ামী লীগ থেকে বরিশাল-২ আসনে প্রথমে মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয় বর্তমান সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুসকে। চেষ্টা-তদবির করে মঙ্গলবার এই আসনে মনোনয়নের চিঠি নিয়ে যান ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহ আলম। তালুকদার ইউনুস মনোনয়নপত্র জমাদানে বিরত থাকেন। আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে শেষ দিন মনোনয়নপত্র জমা দেন শাহ আলম। তবে এই আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি থেকে চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)-কে মনোনয়ন দিয়েছে। তাকে মহাজোটের একক প্রার্থী করতে দেন-দরবার চালাচ্ছে জাপা।

আইনি জটিলতায় প্রার্থী বাদ পড়ার সম্ভাবনা এবং মহাজোটের দুর্বল প্রার্থীদের কথা বিবেচনা করে অন্তত ১৪টি আসনে দুজন করে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অনেকগুলোতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীও রয়েছে। ফলে এসব আসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী কে হচ্ছেন, তা নিশ্চিত হতে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ (৯ ডিসেম্বর) দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এক আসনে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে বিপাকে পড়েছে বিএনপি। প্রায় প্রত্যেক আসনেই দুই-তিন জন, কোন কোন আসনে চারজনকেও মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রত্যেক আসনেই দুই থেকে তিনজন করে জুনিয়র নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এসব জুনিয়র নেতারা মনোনয়ন পাওয়ার পর এখন আর সিনিয়র নেতাদের মান্য করছেন না। ফলে ওই প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হওয়া ছাড়াও সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। অনেক সিনিয়র নেতাকে এখন জুনিয়র নেতাদের সঙ্গে মনোনয়ন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হচ্ছে। এই সিনিয়র নেতাদের মধ্যে দুই থেকে তিন বারের সংসদ সদস্যও রয়েছেন।

সিলেটের ছয়টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে সিলেট-১ আসনসহ তিনটিতে দুজন করে প্রার্থী। বিএনপি বলছে, দুজন করে প্রার্থীর বিষয়টি কৌশল। তবে এতে নেতাকর্মীরা দোটানার মধ্যে পড়েছেন। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় চূড়ান্ত প্রার্থীদের পুরোদমে প্রস্তুতি নিতে এমন কৌশল হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ। এছাড়া বিএনপির একাধিক প্রার্থী রয়েছে, পটুয়াখালী-২ আসনে ৩ জন, পটুয়াখালী-৩ ৩ জন, পটুয়াখালী-৪ এ ২ জন প্রার্থী রয়েছেন। তবে বিএনপির এক শীর্ষ নেতা জানান, একাধিক আসনে দুই থেকে চার জন ব্যক্তিকে ধানের শীষের প্রত্যয়নপত্র দেয়ার পিছনে কৌশল আছে বিএনপির। যদি একজন করে প্রার্থী দেয়া হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারে ক্ষমতাসীনরা। ফলে প্রার্থী সংকটে পড়তে হতে পারে। মূলত এই চিন্তা থেকেই একাধিক প্রার্থী রাখা হয়েছে। কিন্তু এই কৌশলই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিএনপির। একাধিক প্রার্থী দেয়ার কারণে কোন কোন আসনে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মিজানুর রহমান সিনহা ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আলী আজগর রিপন মল্লিকের পক্ষের লোকজন সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে বুধবার। এদিন দুপক্ষের প্রায় ১০ জন নেতাকর্মী আহত হয়। পিরোজপুরে জোট নেতা ইরানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে স্থানীয় বিএনপি। বুধবার পিরোজপুর জেলার ভা-ারিয়ায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিক লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরানকে। এই আসনে থানা বিএনপির সভাপতি আহমেদ সোহেল মনজুর সুমনকেও দলীয় মনোনয়ন দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা- গলাচিপা) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য যোগ দেয়া গোলাম মাওলা রনিকে মনোনয়ন দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রনির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় বিএনপি। তবে নিজের মনোনয়ন বহাল রাখতে কিংবা নতুন করে মনোনয়ন আনতে সবাই এখন কেন্দ্রমুখী যোগাযোগ ও চেষ্টা-তদবির করে যাচ্ছেন। জোটের আসন বণ্টন করে একক প্রার্থী দিলে অনেক আসনেই অন্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিদ্রোহ করতে পারেন বলে ধারণা করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

ইসি সচিবালয় সূত্রমতে, এবার জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনে মোট ৩০৫৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে ৭০৮ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এছাড়া রংপুরে ৩৬১, রাজশাহীতে ৩৫৩, খুলনায় ৩৫১, বরিশালে ১৮২, ময়মনসিংহে ২৩৬, সিলেটে ১৭৭ ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৮৮ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে ২৭ জন প্রার্থী হয়েছেন, যেটি সর্বোচ্চ। আর সবচেয়ে কম ৪ জন প্রার্থী হয়েছেন মাগুরা-২ আসনে। এবার কোন আসনে একক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি।

উল্লেখ্য, নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বাছাই হবে আগামী ২ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ ডিসেম্বর। এরপরই শুরু হবে প্রতীকসহ প্রচারণা। ভোট হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর, রোববার।