ঢাকা ০৫:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত ড. মো. হারুনুর রশীদ পরিচালিত সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া বুধা’ মুক্তি পেয়েছে ভাল মানুষ থেকেইে ভাল মানুষ তৈরী হয়—ঠাকুরগাঁওয়ে আল-হাসানাহ স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরুস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে সাবেক এমপি জাহিদুর রহমান ঠাকুরগাঁয়ে যুবলীগ নেতার পলিথিন কারখানা বন্ধ, মালামাল জব্দ সাগর-রুনি হত্যা মামলা র‌্যাব থেকে তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইয়ের কাছে সংস্কারের পরেই নির্বাচন: ড. ইউনূস বশিরউদ্দীন ও ফারুকীকে কার বুদ্ধিতে নিলেন, প্রশ্ন মান্নার ভূমি সেবায় দুর্নীতি-অনিয়মে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা ভোট কারচুপির তদন্ত সাবেক ডিসি-এসপি-ইউএনওদের ঘুম হারাম আসিফ নজরুলকে হেনস্তা,দূতাবাসের কাউন্সেলরকে দেশে ফেরত, চাকরি হারাচ্ছেন স্টাফ

শ্রীলঙ্কায় বাছবিচারহীনভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে মুসলিমদের

ডেস্ক :: ইস্টার সানডেতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর শ্রীলঙ্কায় বাছবিচারহীনভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে মুসলিমদের। সামান্য অজুহাত পেলেই এমন গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছেন তারা। গ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানি বৃদ্ধির এমন দাবি করেছেন মুসলিম, অধিকারকর্মী ও রাজনীতিকরা। এ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত বুধবার তারা এক বিবৃতিতে শ্রীলঙ্কার মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চাপ সৃষ্টিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এতে আরো বলা হয়, এর ফলে দেশটির শান্তি ও পুনরেকত্রীকরণ নষ্ট হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা।

শ্রীলঙ্কা পুলিশের মুখপাত্র রুয়ান গুনসেকারা বলেছেন, ইস্টার সানডে হামলার সঙ্গে জড়িত অথবা সংশ্লিষ্ট ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ২২৮৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা ১৮২০। কাউকে কাউকে তার পোশাকের কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা এসব মানুষের মধ্যে ১৬৫৫ জনকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে। ৬৩৪ জন এখনও নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন। হয়তো তাদেরকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে না হয় তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। রিমান্ডে নেয়া হয়েছে ৪২৩ জনকে। এর মধ্যে ৩৫৮ জনই মুসলিম।

শুধু পোশাকের কারণে ১৭ই মে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৪৭ বছর বয়সী একজন নারী আবদুল রহিম মাজাহিনাকে। তিনি যে পোশাক পরেছিলেন তাতে ছিল জাহাজের চাকার ছবি। কিন্তু মাজাহিনাকে পুলিশ বলেছে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই পোশাকের কারণে। কারণ, ওই পোশাকে যে চাকার ছবি, তা আসলে ধর্মচক্রের। ধর্মচক্র হলো বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতীক। ফলে তিনি এই পোশাক পরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। অ্যাজমা ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মাজাহিনা এই পোশাক পরেছেন এর আগে অনেকবার। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে কিছু বলেন নি তাকে। তাই তিনি বলেন, যদি ওই ছবি ধর্মচক্রের হয়েই থাকে তাহলে কেউ তাকে বিষয়টি জানাতে পারতো। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক ডিপার্টমেন্ট পরে কর্তৃপক্ষকে বলেছে, মাজাহিনার পরা ওই পোশাকের ছবিটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মচক্রের কিনা তা তারা নিশ্চিত হতে পারে নি।

রাজধানী কলম্বো থেকে ১৩০ কিলোমিটার পূর্বে হাসালাকা এলাকা। সেখানে ঘৃণাপ্রসূত আইনের অধীনে পুলিশ অভিযোগ গঠন করেছে মাজাহিনার বিরুদ্ধে। ওই আইনে ধর্ম অবমাননা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কথা বলেছেন মাজাহিনার আইনজীবী ফাতিমা নুসরা জারুক। উল্লেখ্য, গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডে’র প্রার্থনা সভা চলার সময় ৩টি গির্জা ও কয়েকটি বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলে সন্ত্রাসীরা আত্মঘাতী বোমা হামলা করে। এতে কমপক্ষে ২৫০ জন নিহত ও ৫০০ মানুষ আহত হয়েছেন। ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস।

মাজাহিনার মতো অনেক মানুষ নির্যাতিত হচ্ছেন। তাদের কান্না কেউ শুনছে না। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছেন, আমাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে ওসি মাথার স্কার্ফ খুলে ফেলতে বাধ্য করেন। এ সময় অন্য অফিসাররা আমার ছবি তুলতে থাকেন। ১৭ দিন জেলে আটকা ছিলেন তিনি। ওই সময়ে বার বার প্রহরীরা তাকে একজন ‘সন্ত্রাসী’ বলে ডাকতো। ৩ জুন তাকে জামিনে মুক্তি দিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। তবে তাকে আবার নভেম্বরে আদালতে হাজিরা দিতে হবে। যদি তিনি অভিযুক্ত হন, তাহলে তার দু’বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। জেলে থাকা অবস্থায় তার রক্তের চাপ বেড়ে গেছে। জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরলেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার স্বামী মুনাফ একজন দিনমজুর। তাকে দেখাশোনা করতে তিনি কাজে যেতে পারছেন না। এর ফলে ওই পরিবারটির এখন কোনোই আয়ের উৎস নেই।

শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার বিষয়ক সরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস কমিশন অব শ্রীলঙ্কা (এইচআরসিএসএল)। এর চেয়ারপারসন দীপিকা উদুগামা। তিনি বলেছেন, তারা মুসলিমদের খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তারের বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছেন। তার ভাষায়, এমন গ্রেপ্তারের বিষয়টি উদাহরণ সহ আমরা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শকের কাছে লিখিতভাবে জানাবো এবং আমাদের সুপারিশগুলো তুলে ধরবো। উদ্ভূত অবস্থায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ওদিকে ২০১৭ সালে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সিস্টেমেটিক সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এমন ব্যবস্থায় বিবাদী খেয়ালখুশিমতো আটক হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। ইস্টার সানডে হামলার আগে এমন গ্রেপ্তারের টার্গেটে ছিলেন জাতিগত তামিলরা, যারা হিন্দু ও খ্রিস্টান। উল্লেখ্য, স্বাধীনতাকামী লিবারেশন টাইগারস অব তামিল এলমের (এলটিটিই) বিরুদ্ধে ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ হয় শ্রীলঙ্কায়। এলটিটিই একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছিল।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশের কি কোনো উদ্বেগ আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র রুয়ান গুনসেকারা বলেন, এটা আমি কিভাবে বলতে পারি? যদি কারো কোনো আপত্তি থাকে তাহলে তারা পুলিশ সদর দপ্তরে অথবা এইচআরসিএসএলে তাদের আপত্তি জানাতে পারেন। তিনি জানান, পুলিশ সদর দপ্তরে এখন পর্যন্ত এমন কোনো অভিযোগ যায় নি।

বাদুল্লা জেলার জেজিমা (ছদ্মনাম)। তার বয়স ৫৮ বছর। তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন, পুলিশি হেফাজতে থাকা তার স্বামী নিখোঁজ। এ বিষয়ে তিনি অভিযোগ দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাদুল্লা পুলিশ তার অভিযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তার স্বামীর কাছে দুটি পাসপোর্ট ছিল। তাই তাকে পুলিশ স্টেশনে ডেকে নেয়া হয়েছিল এর কারণ ব্যাখ্যা করতে। বিষয়টি জানতেন না জেজিমা। তিনি বলেন, আমার স্বামীর দুটি পাসপোর্ট থাকা একটি সাধারণ বিষয়। তার একটি পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। অন্যটি চলমান। আমার স্বামী পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পর আর কখনো তিনি ফিরে আসেন নি। এমন কি তিনি কোথায় আছেন তাও বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে পুলিশ।

তা সত্ত্বেও তিনি ১২ দিন ধরে এখানে ওখানে খুঁজেছেন তার স্বামীকে। তারপর সহায়তা চেয়েছেন এইচআরসিএসএলে। তারা অনুসন্ধান করে তার স্বামীর হদিস পায় কলম্বোতে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে (সিআইডি)। জেজিমাকে সিআইডি নিশ্চিত করে যে, ৩রা জুনই তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়া হবে। তারপর কেটে গেছে এক সপ্তাহের বেশি সময়। কিন্তু জেজিমার স্বামী ফেরেন নি।

নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি মেমোরি কার্ড কাছে থাকার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২০ বছর বয়সী আসলাম রিজভিকে। অন্যদিকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তারই প্রতিবেশী ১৯ বছর বয়সী আবদুল আরিসকে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন আল জাজিরার সাংবাদিক। মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেসের নেতা রউফ হাকিম। মুসলিমদের সুরক্ষা দিতে সরকারের ব্যর্থতার কথা গত সপ্তাহে তুলে ধরেছেন তিনি। রউফ হাকিম বলেছেন, সামান্য কারণে মুসলিমদের হয়রান ও আটক করা হচ্ছে। তার ভাষায়, এটা সত্য যে, ২১ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলাকারীরা আমাদের সম্প্রদায়েরই। কিন্তু ওই হামলার প্রথম দিন থেকেই ওইসব সন্ত্রাসীদের মূলোৎপাটনে তিন বাহিনীকে সহায়তা করে যাচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়। এ প্রক্রিয়া চলাকালে আমরা তীব্র দুর্ভোগে পড়েছি।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই দমনপীড়ন বিশেষ করে তীব্র হয়েছে কাত্তানকুড়িতে। এটি পূর্ব উপকূলীয় শহর। ইস্টার বোমা হামলার মূলহোতা জাহারান হাশিমের বসবাস ছিল ওই এলাকায়। কাত্তানকুড়িতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লেকচারার  বলেছেন, এখন এখানকার সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। অনেক নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের (মুসলিম) কাউকে দেখে যদি কারো সামান্য সন্দেহ হয়, অমনি তারা পুলিশে কল দেয়।

শ্রীলঙ্কায় মুসলিমদের নাগরিক অধিকারের পরামর্শ দিয়ে থাকে অল সাইলন জমিয়াতুল উলেমা নামের একটি সংগঠন। তাদেরকে পার্লামেন্ট সিলেক্ট কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে হচ্ছে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন মুফতি রিজভি। তিনি ওই কমিটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তার বৃদ্ধির বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে। শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগই বৌদ্ধ। মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগেরও কম মুসলিম। বাকি রয়েছেন হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

দুর্নীতির অভিযোগে পীরগঞ্জ পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত

শ্রীলঙ্কায় বাছবিচারহীনভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে মুসলিমদের

আপডেট টাইম ০২:১৫:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ জুন ২০১৯
ডেস্ক :: ইস্টার সানডেতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর শ্রীলঙ্কায় বাছবিচারহীনভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে মুসলিমদের। সামান্য অজুহাত পেলেই এমন গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছেন তারা। গ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানি বৃদ্ধির এমন দাবি করেছেন মুসলিম, অধিকারকর্মী ও রাজনীতিকরা। এ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত বুধবার তারা এক বিবৃতিতে শ্রীলঙ্কার মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চাপ সৃষ্টিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এতে আরো বলা হয়, এর ফলে দেশটির শান্তি ও পুনরেকত্রীকরণ নষ্ট হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা।

শ্রীলঙ্কা পুলিশের মুখপাত্র রুয়ান গুনসেকারা বলেছেন, ইস্টার সানডে হামলার সঙ্গে জড়িত অথবা সংশ্লিষ্ট ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ২২৮৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা ১৮২০। কাউকে কাউকে তার পোশাকের কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা এসব মানুষের মধ্যে ১৬৫৫ জনকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে। ৬৩৪ জন এখনও নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন। হয়তো তাদেরকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে না হয় তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। রিমান্ডে নেয়া হয়েছে ৪২৩ জনকে। এর মধ্যে ৩৫৮ জনই মুসলিম।

শুধু পোশাকের কারণে ১৭ই মে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৪৭ বছর বয়সী একজন নারী আবদুল রহিম মাজাহিনাকে। তিনি যে পোশাক পরেছিলেন তাতে ছিল জাহাজের চাকার ছবি। কিন্তু মাজাহিনাকে পুলিশ বলেছে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই পোশাকের কারণে। কারণ, ওই পোশাকে যে চাকার ছবি, তা আসলে ধর্মচক্রের। ধর্মচক্র হলো বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতীক। ফলে তিনি এই পোশাক পরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। অ্যাজমা ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মাজাহিনা এই পোশাক পরেছেন এর আগে অনেকবার। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে কিছু বলেন নি তাকে। তাই তিনি বলেন, যদি ওই ছবি ধর্মচক্রের হয়েই থাকে তাহলে কেউ তাকে বিষয়টি জানাতে পারতো। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক ডিপার্টমেন্ট পরে কর্তৃপক্ষকে বলেছে, মাজাহিনার পরা ওই পোশাকের ছবিটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মচক্রের কিনা তা তারা নিশ্চিত হতে পারে নি।

রাজধানী কলম্বো থেকে ১৩০ কিলোমিটার পূর্বে হাসালাকা এলাকা। সেখানে ঘৃণাপ্রসূত আইনের অধীনে পুলিশ অভিযোগ গঠন করেছে মাজাহিনার বিরুদ্ধে। ওই আইনে ধর্ম অবমাননা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কথা বলেছেন মাজাহিনার আইনজীবী ফাতিমা নুসরা জারুক। উল্লেখ্য, গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডে’র প্রার্থনা সভা চলার সময় ৩টি গির্জা ও কয়েকটি বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলে সন্ত্রাসীরা আত্মঘাতী বোমা হামলা করে। এতে কমপক্ষে ২৫০ জন নিহত ও ৫০০ মানুষ আহত হয়েছেন। ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস।

মাজাহিনার মতো অনেক মানুষ নির্যাতিত হচ্ছেন। তাদের কান্না কেউ শুনছে না। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছেন, আমাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে ওসি মাথার স্কার্ফ খুলে ফেলতে বাধ্য করেন। এ সময় অন্য অফিসাররা আমার ছবি তুলতে থাকেন। ১৭ দিন জেলে আটকা ছিলেন তিনি। ওই সময়ে বার বার প্রহরীরা তাকে একজন ‘সন্ত্রাসী’ বলে ডাকতো। ৩ জুন তাকে জামিনে মুক্তি দিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। তবে তাকে আবার নভেম্বরে আদালতে হাজিরা দিতে হবে। যদি তিনি অভিযুক্ত হন, তাহলে তার দু’বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। জেলে থাকা অবস্থায় তার রক্তের চাপ বেড়ে গেছে। জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরলেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার স্বামী মুনাফ একজন দিনমজুর। তাকে দেখাশোনা করতে তিনি কাজে যেতে পারছেন না। এর ফলে ওই পরিবারটির এখন কোনোই আয়ের উৎস নেই।

শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার বিষয়ক সরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস কমিশন অব শ্রীলঙ্কা (এইচআরসিএসএল)। এর চেয়ারপারসন দীপিকা উদুগামা। তিনি বলেছেন, তারা মুসলিমদের খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তারের বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছেন। তার ভাষায়, এমন গ্রেপ্তারের বিষয়টি উদাহরণ সহ আমরা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শকের কাছে লিখিতভাবে জানাবো এবং আমাদের সুপারিশগুলো তুলে ধরবো। উদ্ভূত অবস্থায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ওদিকে ২০১৭ সালে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সিস্টেমেটিক সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এমন ব্যবস্থায় বিবাদী খেয়ালখুশিমতো আটক হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। ইস্টার সানডে হামলার আগে এমন গ্রেপ্তারের টার্গেটে ছিলেন জাতিগত তামিলরা, যারা হিন্দু ও খ্রিস্টান। উল্লেখ্য, স্বাধীনতাকামী লিবারেশন টাইগারস অব তামিল এলমের (এলটিটিই) বিরুদ্ধে ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ হয় শ্রীলঙ্কায়। এলটিটিই একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছিল।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশের কি কোনো উদ্বেগ আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র রুয়ান গুনসেকারা বলেন, এটা আমি কিভাবে বলতে পারি? যদি কারো কোনো আপত্তি থাকে তাহলে তারা পুলিশ সদর দপ্তরে অথবা এইচআরসিএসএলে তাদের আপত্তি জানাতে পারেন। তিনি জানান, পুলিশ সদর দপ্তরে এখন পর্যন্ত এমন কোনো অভিযোগ যায় নি।

বাদুল্লা জেলার জেজিমা (ছদ্মনাম)। তার বয়স ৫৮ বছর। তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন, পুলিশি হেফাজতে থাকা তার স্বামী নিখোঁজ। এ বিষয়ে তিনি অভিযোগ দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাদুল্লা পুলিশ তার অভিযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তার স্বামীর কাছে দুটি পাসপোর্ট ছিল। তাই তাকে পুলিশ স্টেশনে ডেকে নেয়া হয়েছিল এর কারণ ব্যাখ্যা করতে। বিষয়টি জানতেন না জেজিমা। তিনি বলেন, আমার স্বামীর দুটি পাসপোর্ট থাকা একটি সাধারণ বিষয়। তার একটি পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। অন্যটি চলমান। আমার স্বামী পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পর আর কখনো তিনি ফিরে আসেন নি। এমন কি তিনি কোথায় আছেন তাও বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে পুলিশ।

তা সত্ত্বেও তিনি ১২ দিন ধরে এখানে ওখানে খুঁজেছেন তার স্বামীকে। তারপর সহায়তা চেয়েছেন এইচআরসিএসএলে। তারা অনুসন্ধান করে তার স্বামীর হদিস পায় কলম্বোতে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে (সিআইডি)। জেজিমাকে সিআইডি নিশ্চিত করে যে, ৩রা জুনই তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়া হবে। তারপর কেটে গেছে এক সপ্তাহের বেশি সময়। কিন্তু জেজিমার স্বামী ফেরেন নি।

নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি মেমোরি কার্ড কাছে থাকার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২০ বছর বয়সী আসলাম রিজভিকে। অন্যদিকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তারই প্রতিবেশী ১৯ বছর বয়সী আবদুল আরিসকে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন আল জাজিরার সাংবাদিক। মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেসের নেতা রউফ হাকিম। মুসলিমদের সুরক্ষা দিতে সরকারের ব্যর্থতার কথা গত সপ্তাহে তুলে ধরেছেন তিনি। রউফ হাকিম বলেছেন, সামান্য কারণে মুসলিমদের হয়রান ও আটক করা হচ্ছে। তার ভাষায়, এটা সত্য যে, ২১ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলাকারীরা আমাদের সম্প্রদায়েরই। কিন্তু ওই হামলার প্রথম দিন থেকেই ওইসব সন্ত্রাসীদের মূলোৎপাটনে তিন বাহিনীকে সহায়তা করে যাচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়। এ প্রক্রিয়া চলাকালে আমরা তীব্র দুর্ভোগে পড়েছি।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই দমনপীড়ন বিশেষ করে তীব্র হয়েছে কাত্তানকুড়িতে। এটি পূর্ব উপকূলীয় শহর। ইস্টার বোমা হামলার মূলহোতা জাহারান হাশিমের বসবাস ছিল ওই এলাকায়। কাত্তানকুড়িতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লেকচারার  বলেছেন, এখন এখানকার সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। অনেক নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের (মুসলিম) কাউকে দেখে যদি কারো সামান্য সন্দেহ হয়, অমনি তারা পুলিশে কল দেয়।

শ্রীলঙ্কায় মুসলিমদের নাগরিক অধিকারের পরামর্শ দিয়ে থাকে অল সাইলন জমিয়াতুল উলেমা নামের একটি সংগঠন। তাদেরকে পার্লামেন্ট সিলেক্ট কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে হচ্ছে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন মুফতি রিজভি। তিনি ওই কমিটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তার বৃদ্ধির বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে। শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগই বৌদ্ধ। মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগেরও কম মুসলিম। বাকি রয়েছেন হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ।