জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন, এক লাখ ৬০ হাজার ৭৩৭ বাংলাদেশি। আগের পাঁচ বছরের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ, গত ২০১৪ সাল থেকে দিনে গড়ে ৮৮ জন করে আবেদন করছেন। ইউএনএইচসিআর সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছর বাংলাদেশের ২৮ হাজার ৪৮৮ জন নাগরিক বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগ চেয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে আবেদন যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রত্যাখ্যানের হারও বেড়েছে বহুগুণ।
রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশিদের প্রথম পছন্দ ইউরোপ। গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ ৩৪ হাজার ১১৭ বাংলাদেশি আবেদন করেন ফ্রান্সে। প্রায় সমান সংখ্যক আবেদন পড়ে ইতালিতে। রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশিদের তৃতীয় পছন্দের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। যেখানে গত পাঁচ বছরে আবেদন জমা পড়েছে ২৪ হাজারের বেশি। এর বাইরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রেও বাড়ছে বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা। যদিও আবেদনের বড় একটি অংশ বাতিল হচ্ছে। ২০১৮ সালে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জমা পড়েছে ৭ হাজার ৯৬৩, ইতালিতে ৪ হাজার ১৬২, গ্রিসে ২ হাজার ৪৯৮, দক্ষিণ আফ্রিকায় ২ হাজার ৪৫৪, যুক্তরাজ্যে ২ হাজার ৪৪৯টি, যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৮৯৬টি। এ ছাড়াও জাপান, কানাডাতেও আবেদন জমা পড়েছে।
এদিকে, সবমিলিয়ে বিভিন্ন দেশে বাৎসরিক আবেদন জমা পড়েছে ২০০৯ সালে ১২ হাজার ৫২৩টি, ২০১০ সালে ১২ হাজার ৪৮৬টি, ২০১১ সালে ১৪ হাজার ৯১৯টি, ২০১২ সালে ১৬ হাজার ৩৭১টি, ২০১৩ সালে ২২ হাজার ৪৪১টি, ২০১৪ সালে ২৭ হাজার ১১৬টি, ২০১৫ সালে ২৭ হাজার ১১৬টি, ২০১৬ সালে ২৮ হাজার ৩৯৫টি, ২০১৭ সালে ৩৩ হাজার ৯০৯, ২০১৮ সালে ২৮ হাজার ৪৮৮টি। যা হিসাব করলে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা দাড়ায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৭৬৪ জন। গত পাঁচ বছরে ইতালিতে বাংলাদেশিদের মধ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে ৩৩ হাজার ৫৫১ জন, ফ্রান্সে ৩৪ হাজার ১১৭ জন, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩৩ হাজর ৫৫৪ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ৭ হাজার ৫৯৬ জন। শুধুমাত্র ২০১৮ সালে ফ্রান্সে আবেদন করেছেন ৭ হাজার ৯৬৩ জন, ইতালিতে ৪ হাজার ১৬২জন, গ্রিসে ২৪ হাজার ৫৪ জন, যুক্তরাজ্যে ২ হাজার ৪৪৯ জন ও যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৮৯৬ জন।
জানা যায়, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা আবেদন করার আগে বৈধ ও অবৈধ পন্থায় ওইসব দেশে গিয়ে হাজির হচ্ছেন। দেশগুলোতে যেহেতু নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে সেহেতু আদালতে নিষ্পত্তি বা সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কোনো বাংলাদেশিকেই সরাসরি বহিষ্কার করা হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো দেশে বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আবেদনকারীদের ভাতা দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফ্রান্সে বসবাসরত রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া একজন বাংলাদেশি। বলেন, ২০১২ সালে আমি একটি রাজনৈতিক হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলাম। এর পর থেকে প্রতিপক্ষ আমাকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল। হত্যা করার হুমকি দিয়ে আসছিল। ফলে দেশে থাকা আমার জন্য খুব কষ্টকর ছিল। তাই আমি এখানে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলাম। পরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসেছি। যদিও এখনো আমার আবেদন গৃহীত হয়নি। জার্মানিতে রাজনৈতিক আবেদন করেছেন এমন একজন বলেন, দেশে থাকার মতো অবস্থা নেই। মামলা-হামলা চলছে। এই অবস্থায় দেশ ত্যাগ করা ছাড়া আমার সামনে বিকল্প ছিল না।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরুর) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, সারা বিশ্বে অভিবাসন প্রক্রিয়ার কোটাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে ফলে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যাটা বাড়ছে। তাছাড়া দেশেও তো রাজনৈতিকভাবে ভুক্তভোগী আছে, তা তো মিথ্যে নয়। আরেকটি বিষয়, দেশে শিক্ষিত তরুণদের তুলনায় চাকরি নেই, সকল জায়গায় দুর্নীতির একটা মহাআখড়া। এসব কারণেও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ইউএনএইচসিআর যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এখন সরকারকে ভাবতে হবে, এ সংখ্যাটা কমানো যায় কিভাবে। সেক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অবশ্যই প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ফলে দেশের বাইরে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রথমতঃ তথ্য সত্য কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়। তথ্যগুলোকে যাচাইবাছাই করা প্রয়োজন। আরেকটি বিষয় মানুষ যখন দেশের বাইরে যায় তারা তখন দেখেন রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে সহজে থাকতে পারে সেই জন্য আসলে এই সুযোগটা গ্রহণ করেন। আমাদের দেশের বহু লোক বিদেশে থাকতে চায়। বিদেশটাকে মনে করে খুব ভালো, স্বর্গসুখ। যদিও বিদেশ গিয়ে অনেকে বড় কষ্টও করে। বিশেষ করে আমাদের বাঙালিরা এমনটা করে। ফলে দেশের বাইরে আমাদের ভাবমূর্তি খুব নষ্ট হচ্ছে।