এই পৃথিবীতে মানবজাতি তার পথপরিক্রমার লাখ লাখ বছর পেরিয়েছে। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় তার নিজের বিবর্তন, পরিবর্তন ও উন্নয়ন এককথায় বলতে গেলে অপরিমেয়। মানববংশের আদি সদস্যরা থাকতেন পাহাড়ের গুহায়, খেতেন আপন হাতে শিকার করা পশুর কাঁচা মাংস, বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার বালাই ছিল না। সেই দুর্দিন পেরিয়ে মানুষ আজ কতো অগ্রসর! আজ তারা বিশ্বের সীমানা ছাড়িয়ে মহাবিশ্বের দিকে পা বাড়াচ্ছে। বিপুলা এ পৃথিবীটাকে এনে ফেলেছে হাতের মুঠোয়। অনাহার, রোগ-ব্যাধি এসবও আজ মানুষের অমিত পরাক্রমের বাইরে নয়। এতোটাই এগিয়েছে আজ মানবসভ্যতা। কিন্তু কখনো-কখনো এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যা এমনকি আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আঘাত হানে। জানতে ইচ্ছে হয়, এই কি মানুষ? লাখো বছরের পথ পেরিয়ে এই কি তার ”সভ্য” হওয়া?
বুধবার একটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ”তিন হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে রাস্তায় সন্তান প্রসব” শীর্ষক একটি খবর দেখে এসব প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছিল মনে। ঘটনার শিকার পারভীন স্বামী-পরিত্যক্তা এক দুঃখিনী নারী। থাকতেন রাজধানীর গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারে। সোমবার রাত ৩টার দিকে তার প্রসবব্যথা শুরু হলে তিনি সোহেল নামে এক অচেনা যুবকের হাত-পা ধরে কেঁদে ফেলেন এবং তাকে হাসপাতালে নেয়ার অনুরোধ জানান। পারভীনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা করে বলেন, ”স্বাভাবিক ডেলিভারি হবে”। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা উল্টো কথা বলেন, ”প্রসূতির অবস্থা সঙ্কটাপন্ন, সিজার করাতে হবে”। তবে সিজার করার ”ঝামেলা” তারা মাথায় নিতে নিতে নারাজ। ”স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ভালো চিকিৎসক আছেন, তারা ডেলিভারি রোগীর ভালো চিকিৎসা করেন” – এসব বলে তারা পারভিনকে মিটফোর্ডে পাঠিয়ে দেন। পারভিনকে মিটফোর্ডে নেয়ার পর তারাও বলেন, ”সিজার লাগবে”। কিন্তু তাদের ওখানে ”ভালো হবে না” বলে তারা পারভিনকে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ঠেলে দেন। কিন্তু সেখানে তার নামে কার্ড কিংবা রেজিস্ট্রেশন না থাকায় তারা পারভিনকে ভর্তি করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। পারভিন আর টিকতে পারছে না, যেকোনো মুহূর্তে সন্তান প্রসব হয়ে যাবে বলে তাদের অনুরোধ করলে তাকে দ্বিতীয় তলার লেবার রুমে নিয়ে যায়। লেবার রুমে নেয়ার পর এক নারী চিকিৎসক এসে তাদের বলেন, ”সিজার করতে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা লাগবে। তোমাদের কাছে কত টাকা আছে?” পারভিন ও সোহেল তাদের কাছে টাকা নেই বলে জানালে তৎক্ষণাৎ ওই চিকিৎসক চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের পোশাক পরিহিত এক আয়া এসে পারভিনের হাত ধরে নিচে নামিয়ে দিতে টানাহেঁচড়া করতে থাকে আর বলে, আপনার চিকিৎসা এখানে হবে না, আপনি অন্য হাসপাতালে যান।
এভাবে তিনটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরেও স্থান হয়নি আসন্নপ্রসবা পারভিনের। অবশেষে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজধানীর আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সামনে রাস্তার ওপরই তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। জন্মের পরপরই শিশুটি মারা যায়।
সংক্ষেপে এটাই হলো ঘটনা। আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও এর ব্যাপকতা বিশাল। এর মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দীনদশা এবং এর সঙ্গে জড়িত ”মানুষগুলোর” অমানুষী চেহারা নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রশ্ন :
০১. শেষ পর্যন্ত কোনো হাসপাতালের বেড এবং ডাক্তারের সাহায্য ছাড়াই রাস্তার ওপর শিশুটি ভূমিষ্ঠ হতে পারলো। তাহলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রথমে নরম্যাল ডেলিভারির কথা বলেও একটু পরেই সিজারিয়ানের গীত গাইলেন কোন যুক্তিতে? কোন ডেলিভারি নরম্যাল হবে আর কোনটায় সিজার লাগবে – এটুকু বোঝার বোধও কি তাদের নেই? তাহলে তারা চিকিৎসক হয় কিভাবে?
০২. ”আমাদের চাইতে ওরা ভালো” বলে এক সরকারি হাসপাতাল কিভাবে একজন জরুরি রোগীকে অন্য হাসপাতালের দিকে ঠেলে দেয়? এরা কি চিকিৎসক নামের উপযুক্ত?
০৩. মাত্র ১২০০/১৫০০ টাকা নেই শুনে লেবার রুমে আসন্নপ্রসবা নারীকে ফেলে চলে গেল যে মহিলা ডাক্তার, কে সে? সেও কি ডাক্তার নামের যোগ্য?
পারভীন একজন ছিন্নমূল নারী। সুতরাং তার নবজাত সন্তান কেন, সে নিজে এবং তার মতো আরো পারভীন মারা গেলেও এদেশে কোনো উচ্চবাচ্য হবে না। কিন্তু পারভীনের এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি এবং অবশেষে দিনেদুপুরে প্রকাশ্য রাজপথে সন্তান প্রসব আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের যে চেহারা দেখালো, তা শুধু বিবমিষারই উদ্রেক করে।