ঢাকা ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাঙালিত্ব কী এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ

একটি প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই ঘুরপাক খায় মাথায়। বাঙালি বলব কাকে, আর বাঙালিত্বই বা কী আসলে? পণ্ডিতেরা অনেক গুরুগম্ভীর ও বিশদ নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞা ও তার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন জানি, তবে আমার মনে হয় এর সবচেয়ে সহজ ও সার্বজনীন উত্তরটা নিহিত রয়েছে আমাদের মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার মধ্যেই।

অর্থাৎ যে বা যাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, ভাববিনিময় করেন; বাংলা লিপিতে লেখার কাজ করেন; বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা থেকে তাঁদের আত্মার পুষ্টি লাভ করেন কেবল তাঁরাই পারেন প্রশ্নাতীতভাবে নিজেকে বাঙালি বলে দাবি করতে। নিছক বাঙালির ঘরে জন্মালেই কী কেউ স্বতঃসিদ্ধভাবে বাঙালি বনে যেতে পারেন? এই প্রশ্নটি মনের মধ্যে লতিয়ে উঠত প্রায়ই, আমার দীর্ঘ জীবনকালে, বাঙ্গালী বংশধরদের সিংহভাগই বাংলায় কথা বলতে পারে না, লেখা ও পড়া তো দূরস্থান। আর, সংস্কৃতি ব্যাপারটা যেহেতু ভাষা থেকে উদ্ভুত এবং ভাষার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি বিষয়, সেহেতু স্বাভাবিক কারণেই তারা বাংলা সংস্কৃতির অপরাপর অনুষঙ্গসমূহ- যথা সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাকরীতি ইত্যাদি কোনটার সঙ্গেই সত্যিকার একাত্মতা অনুভব করত না। তখন প্রশ্ন জাগত মনে, বাঙালির ঘরে বড় হয়ে ওঠা এই প্রজন্ম কিংবা প্রজাতিটিকে কি আমরা ঠিক বাঙালি বলে আখ্যায়িত করতে পারি?

প্রলম্বিত জীবনের এ-এক করুণ ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বলে নিজের মনকে নিজেই সান্তনা দিয়ে, এই বেয়াড়া প্রশ্নটিকে আপাতত স্থগিত রেখে, বলি ‘যে যায় বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে’, আপ্তবাক্যটির সত্যতা প্রমাণ করে এবার বাংলা ও বাঙালি অধ্যুষিত খোদ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কোলকাতা মহানগরের, মাটিতেই সেই নাছোড় প্রশ্নটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অচিরেই।

প্রথমেই যে-জিনিসটি চোখে পড়ে, সেটি হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়’ নামক একটি বস্তুর বেদম প্রকোপ। দেখি ঢাকা, চাটগাঁ ও অন্যান্য বড় শহরগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য নামী-অনামী ’ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়’; আর অভিভাবকেরাও সন্তানদের সাহেব বানানোর বাসনায় গুচ্ছের টাকা খরচ করে, খেয়ে না খেয়ে সেইসব বিদ্যালয়ের খাতায় তাদের নাম লেখাচ্ছেন দলে দলে। এই দলে এমনকী আমরা যারা শিল্পসাহিত্য করি, সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা আর বঙ্গসংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গলাবাজি করি তাঁরাও দেখি কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই।

এর ফল যা হবার তাইই হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে আস্ত একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে যারা না পারে বাংলায় কথা বলতে, পড়তে ও লিখতে, না পারে বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকলার রসাস্বাদন করতে; সংস্কৃতির অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে ধারণ ও চর্চা করার কথা নাহয় বাদই দিলাম। এটা যে কেবল ভাষা ও সংস্কৃতির বেলাতেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, বাঙালির অনেক চিরন্তন ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও আচারপ্রথার প্রতিও নেই তাদের বিন্দুমাত্র অনুরাগ কিংবা শ্রদ্ধাবোধ। উল্টো রয়েছে এক ধরনের অবজ্ঞা ও উপেক্ষার মনোভাব।

বাঙালির ঘরে ঘটনাচক্রে জন্ম হলেও, এমনকি তারা বাঙালি সংস্কৃতির ধারকবাহকদের উত্তরসূরি হলেও এদেরকে আমরা ঠিক কোন্ বিবেচনা ও যুক্তিতে বাঙালি বলে অভিহিত করতে পারি বলুন? অনেকে বলেন ঘোর বিশ্বায়নের যুগে, বিশেষ করে বড় বড় নগরগুলোতে, আমাদেরকে এই অনিবার্য পরিণাম মেনে নিতেই হবে, যেমনটি দেখছি আমরা ঢাকা, চাটগাঁ কিংবা পাশের দেশের কোলকাতা নগরীর বেলায়। তাঁরা অবশ্য সঙ্গে, সান্ত¡নার মত করে এটুকুও যোগ করে দেন যে, তবে ভাবনার কারণ নেই, বাংলা ভাষা, আর কোথাও না হলেও টিকে আছে এবং থাকবে, আমাদের গ্রামগুলোতে।

তাঁদের উদ্দেশে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কোন্ বাংলা ভাষা, বিভিন্ন অঞ্চলের বিচিত্র ও অবিকশিত আঞ্চলিক বাংলা বই তো নয়! এতে কি একটি সর্বজনগ্রাহ্য, সুসংস্কৃত, পরিশীলিত ও প্রমিত বাংলার ব্যবহারিক প্রয়োজনটুকু মিটবে? একেবারেই নয়। বরং সেটা আরও বিভ্রান্তি ও নৈরাজ্য বাড়াবে কেবল। তাছাড়া সেখানে যে আরও একটি বড় ও ভয়ঙ্কর বিপদ ওঁত পেতে বসে আছে সে বিষয়েও তাঁদেরকে খুব একটা ওয়াকিবহাল বলে মনে হয় না। খোলাসা করে বলি তবে।

আমাদের গ্রামগুলোতে অগণিত মাদ্রাসা-মক্তবে প্রচলিত আরেক ধরনের বিজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার কারণে অনেকদিন ধরেই আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষায় প্রবেশ করছে অনাবশ্যক ও অনাকাঙ্ক্ষিত মধ্যপ্রাচ্যীয় দূষণ, আর তার অভিঘাতে গোটা গ্রামবাংলার আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিতেও লেগেছে নানাবিধ বিকৃতি, বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের আত্মঘাতী ধারা। অন্যদিকে হাত গুটিয়ে বসে নেই কিন্তু ‘ইংরেজি মাধ্যমে’র লেবাসধারী নির্জলা বেনিয়া গোষ্ঠীটিও। এখনই তো তারা ছোট শহর ও মফস্বলগুলোর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের লোভাতুর হাত।

তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে যে আমাদের গ্রামগুলোও বাংলাবিদ্বেষী, বাংলাবিনাশী এই তথাকথিত ইন্টারন্যাশনাল কিন্ডারগার্টেন কাম মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার মহামারী থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে সে কথা হলফ করে বলা যায় না। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও পরিণতি সম্পর্কে কি কিছু ভেবে দেখেছেন আমাদের সমাজপতিরা? এই ভাষাহীন ও সংস্কৃতিরহিত প্রজন্মটি যখন আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়ে পঙ্গপালের মত ছড়িয়ে পড়বে গোটা দেশে এবং অবধারিতভাবে বিদেশেও; যখন কালের আবর্তনে সমাজ-রাজনীতি আর অর্থনীতির চালকের আসনে আসীন হবে এই প্রজন্মের সদস্যরা, যখন এদের হাতেই অর্পিত হবে খোদ রাষ্ট্রপরিচালনার ভার; তখন বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলা তথা গোটা বাঙালি সংস্কৃতির কী হাল হবে, একবার ভেবে দেখতে চেষ্টা করুন, প্রিয় পাঠক!

কিছুদিন আগে আমাদের শিল্পসংগঠন ’বিস্তার’-এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক, চিন্তক ও ভাষাবিদ, পবিত্র সরকার। ‘বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ’ বিষয়ক তাঁর বক্তৃতার এক জায়গায় তিনিও আমাদের এই আশঙ্কার প্রতিধ্বনি করে উল্লেখ করেছিলেন যে, বর্তমান বিশ্বের বিপন্ন ভাষাগুলোর তালিকায় যেসব ভাষার নাম রয়েছে, তার মধ্যে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা, ‘মোদের গরব মোদের আশা’ এই বাংলা ভাষাটিও বিদ্যমান।

এই মুহূর্তে সেটি হয়তো তালিকার নিচের দিকেই রয়েছে, কিন্তু পতন ও পচনের যে আত্মধ্বংসী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ জোরেসোরে, তা এই গতিতে এবং অপ্রতিহতভাবে অব্যাহত থাকলে তালিকার শীর্ষে উঠে আসতেও খুব বেশিদিন লাগবে না আমাদের প্রিয় ভাষাটির।

তবে এই অপকর্মের হোতাটি যে শুধু এই ইংরেজি মাধ্যম আর ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, তা কিন্তু নয়। এর জন্য সমানভাবে দায়ী আমাদের মেরুদ-হীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র, অযোগ্য প্রচারমাধ্যম, অপরিপক্ক বিজ্ঞাপনী সংস্থাসমূহ, দেশাত্মবোধবর্জিত কর্পোরেট সম্প্রদায়, কিছু অভিসন্ধিপ্রবণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী এবং অবশ্যই আমাদের অদূরদর্শী অভিভাবকবৃন্দ।

প্রতিক্রিয়াশীল ও পুঁজিবাদী শ্রেণির কাছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসহায় আত্মসমর্পণ; অবক্ষয়ী আমলাতন্ত্রের সীমাহীন দুর্নীতি; নীতিবিবর্জিত ও অক্ষম, অনুকারক প্রচারমাধ্যমের বাংলা ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগের ব্যাপারে প্রবল অনীহা, অগভীর বিজ্ঞাপনী সংস্থাসমূহের চটুল ও চটকদার বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ, কর্পোরেট মহলের সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব ও নির্লজ্জ মুনাফাবৃত্তি; সমাজের এক শ্রেণির মানুষের ভাষিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অপরাজনীতি এবং সবশেষে অভিভাবকশ্রেণির সম্মিলিত অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হয়ে আমাদের বাংলা ভাষাটির বড়ই করুণ দশা আজ।

যে-ভাষার অধিকারের জন্য বায়ান্নে এতগুলো তরুণ প্রাণ ঝরে গেল, যে-ভাষাকে মূলমন্ত্র করে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে এই স্বাধীন দেশটির জন্ম হলো, সেই দেশেই আজ এ-ভাষার কোনও মানমর্যাদা অবশিষ্ট নেই। সর্বত্রই সে এক অপরিসীম অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনার শিকার। আমাদের বাঙালিত্বের প্রধান বাহক ও প্রতীক এই ’বাংলা ভাষা’টির অস্তিত্বই যদি এভাবে হুমকির মধ্যে পড়ে, তাহলে তার ভেতর থেকে উৎসারিত ও উপজাত আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিটিকেও যে আর বেশিদিন সসম্মানে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে সে তো সহজ সমীকরণের বিষয়।

তাই বাংলা সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হলে সবার আগে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে খোদ বাংলা ভাষাটির দিকে। বাংলা ভাষার সুরক্ষার জন্য সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা ও সক্রিয়তার অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের সকলকেই। মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষা বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রধানতম স্মারক। এটি বিপন্ন হলে, বিপন্ন হবে বাঙালির সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবনচর্যা সবই; সেই সঙ্গে বিপন্ন হবে বাঙালির গোটা জাতিগত অস্তিত্ব। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা; সমাজের সর্বস্তরে তার সঠিক প্রয়োগ; তার প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নকেই তাই এই সময়ের বৌদ্ধিক সমাজের অন্যতম প্রধান দাবি ও অভীষ্ট বলে মনে করি।

Tag :

ভিডিও

এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

Azam Rehman

জনপ্রিয় সংবাদ

বাঙালিত্ব কী এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ

আপডেট টাইম ০৭:৩৮:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

একটি প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই ঘুরপাক খায় মাথায়। বাঙালি বলব কাকে, আর বাঙালিত্বই বা কী আসলে? পণ্ডিতেরা অনেক গুরুগম্ভীর ও বিশদ নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞা ও তার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন জানি, তবে আমার মনে হয় এর সবচেয়ে সহজ ও সার্বজনীন উত্তরটা নিহিত রয়েছে আমাদের মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার মধ্যেই।

অর্থাৎ যে বা যাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, ভাববিনিময় করেন; বাংলা লিপিতে লেখার কাজ করেন; বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা থেকে তাঁদের আত্মার পুষ্টি লাভ করেন কেবল তাঁরাই পারেন প্রশ্নাতীতভাবে নিজেকে বাঙালি বলে দাবি করতে। নিছক বাঙালির ঘরে জন্মালেই কী কেউ স্বতঃসিদ্ধভাবে বাঙালি বনে যেতে পারেন? এই প্রশ্নটি মনের মধ্যে লতিয়ে উঠত প্রায়ই, আমার দীর্ঘ জীবনকালে, বাঙ্গালী বংশধরদের সিংহভাগই বাংলায় কথা বলতে পারে না, লেখা ও পড়া তো দূরস্থান। আর, সংস্কৃতি ব্যাপারটা যেহেতু ভাষা থেকে উদ্ভুত এবং ভাষার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি বিষয়, সেহেতু স্বাভাবিক কারণেই তারা বাংলা সংস্কৃতির অপরাপর অনুষঙ্গসমূহ- যথা সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাকরীতি ইত্যাদি কোনটার সঙ্গেই সত্যিকার একাত্মতা অনুভব করত না। তখন প্রশ্ন জাগত মনে, বাঙালির ঘরে বড় হয়ে ওঠা এই প্রজন্ম কিংবা প্রজাতিটিকে কি আমরা ঠিক বাঙালি বলে আখ্যায়িত করতে পারি?

প্রলম্বিত জীবনের এ-এক করুণ ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বলে নিজের মনকে নিজেই সান্তনা দিয়ে, এই বেয়াড়া প্রশ্নটিকে আপাতত স্থগিত রেখে, বলি ‘যে যায় বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে’, আপ্তবাক্যটির সত্যতা প্রমাণ করে এবার বাংলা ও বাঙালি অধ্যুষিত খোদ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কোলকাতা মহানগরের, মাটিতেই সেই নাছোড় প্রশ্নটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অচিরেই।

প্রথমেই যে-জিনিসটি চোখে পড়ে, সেটি হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়’ নামক একটি বস্তুর বেদম প্রকোপ। দেখি ঢাকা, চাটগাঁ ও অন্যান্য বড় শহরগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য নামী-অনামী ’ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়’; আর অভিভাবকেরাও সন্তানদের সাহেব বানানোর বাসনায় গুচ্ছের টাকা খরচ করে, খেয়ে না খেয়ে সেইসব বিদ্যালয়ের খাতায় তাদের নাম লেখাচ্ছেন দলে দলে। এই দলে এমনকী আমরা যারা শিল্পসাহিত্য করি, সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা আর বঙ্গসংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গলাবাজি করি তাঁরাও দেখি কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই।

এর ফল যা হবার তাইই হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে আস্ত একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে যারা না পারে বাংলায় কথা বলতে, পড়তে ও লিখতে, না পারে বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকলার রসাস্বাদন করতে; সংস্কৃতির অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে ধারণ ও চর্চা করার কথা নাহয় বাদই দিলাম। এটা যে কেবল ভাষা ও সংস্কৃতির বেলাতেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, বাঙালির অনেক চিরন্তন ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও আচারপ্রথার প্রতিও নেই তাদের বিন্দুমাত্র অনুরাগ কিংবা শ্রদ্ধাবোধ। উল্টো রয়েছে এক ধরনের অবজ্ঞা ও উপেক্ষার মনোভাব।

বাঙালির ঘরে ঘটনাচক্রে জন্ম হলেও, এমনকি তারা বাঙালি সংস্কৃতির ধারকবাহকদের উত্তরসূরি হলেও এদেরকে আমরা ঠিক কোন্ বিবেচনা ও যুক্তিতে বাঙালি বলে অভিহিত করতে পারি বলুন? অনেকে বলেন ঘোর বিশ্বায়নের যুগে, বিশেষ করে বড় বড় নগরগুলোতে, আমাদেরকে এই অনিবার্য পরিণাম মেনে নিতেই হবে, যেমনটি দেখছি আমরা ঢাকা, চাটগাঁ কিংবা পাশের দেশের কোলকাতা নগরীর বেলায়। তাঁরা অবশ্য সঙ্গে, সান্ত¡নার মত করে এটুকুও যোগ করে দেন যে, তবে ভাবনার কারণ নেই, বাংলা ভাষা, আর কোথাও না হলেও টিকে আছে এবং থাকবে, আমাদের গ্রামগুলোতে।

তাঁদের উদ্দেশে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কোন্ বাংলা ভাষা, বিভিন্ন অঞ্চলের বিচিত্র ও অবিকশিত আঞ্চলিক বাংলা বই তো নয়! এতে কি একটি সর্বজনগ্রাহ্য, সুসংস্কৃত, পরিশীলিত ও প্রমিত বাংলার ব্যবহারিক প্রয়োজনটুকু মিটবে? একেবারেই নয়। বরং সেটা আরও বিভ্রান্তি ও নৈরাজ্য বাড়াবে কেবল। তাছাড়া সেখানে যে আরও একটি বড় ও ভয়ঙ্কর বিপদ ওঁত পেতে বসে আছে সে বিষয়েও তাঁদেরকে খুব একটা ওয়াকিবহাল বলে মনে হয় না। খোলাসা করে বলি তবে।

আমাদের গ্রামগুলোতে অগণিত মাদ্রাসা-মক্তবে প্রচলিত আরেক ধরনের বিজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার কারণে অনেকদিন ধরেই আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষায় প্রবেশ করছে অনাবশ্যক ও অনাকাঙ্ক্ষিত মধ্যপ্রাচ্যীয় দূষণ, আর তার অভিঘাতে গোটা গ্রামবাংলার আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিতেও লেগেছে নানাবিধ বিকৃতি, বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের আত্মঘাতী ধারা। অন্যদিকে হাত গুটিয়ে বসে নেই কিন্তু ‘ইংরেজি মাধ্যমে’র লেবাসধারী নির্জলা বেনিয়া গোষ্ঠীটিও। এখনই তো তারা ছোট শহর ও মফস্বলগুলোর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের লোভাতুর হাত।

তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে যে আমাদের গ্রামগুলোও বাংলাবিদ্বেষী, বাংলাবিনাশী এই তথাকথিত ইন্টারন্যাশনাল কিন্ডারগার্টেন কাম মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার মহামারী থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে সে কথা হলফ করে বলা যায় না। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও পরিণতি সম্পর্কে কি কিছু ভেবে দেখেছেন আমাদের সমাজপতিরা? এই ভাষাহীন ও সংস্কৃতিরহিত প্রজন্মটি যখন আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়ে পঙ্গপালের মত ছড়িয়ে পড়বে গোটা দেশে এবং অবধারিতভাবে বিদেশেও; যখন কালের আবর্তনে সমাজ-রাজনীতি আর অর্থনীতির চালকের আসনে আসীন হবে এই প্রজন্মের সদস্যরা, যখন এদের হাতেই অর্পিত হবে খোদ রাষ্ট্রপরিচালনার ভার; তখন বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলা তথা গোটা বাঙালি সংস্কৃতির কী হাল হবে, একবার ভেবে দেখতে চেষ্টা করুন, প্রিয় পাঠক!

কিছুদিন আগে আমাদের শিল্পসংগঠন ’বিস্তার’-এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক, চিন্তক ও ভাষাবিদ, পবিত্র সরকার। ‘বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ’ বিষয়ক তাঁর বক্তৃতার এক জায়গায় তিনিও আমাদের এই আশঙ্কার প্রতিধ্বনি করে উল্লেখ করেছিলেন যে, বর্তমান বিশ্বের বিপন্ন ভাষাগুলোর তালিকায় যেসব ভাষার নাম রয়েছে, তার মধ্যে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা, ‘মোদের গরব মোদের আশা’ এই বাংলা ভাষাটিও বিদ্যমান।

এই মুহূর্তে সেটি হয়তো তালিকার নিচের দিকেই রয়েছে, কিন্তু পতন ও পচনের যে আত্মধ্বংসী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ জোরেসোরে, তা এই গতিতে এবং অপ্রতিহতভাবে অব্যাহত থাকলে তালিকার শীর্ষে উঠে আসতেও খুব বেশিদিন লাগবে না আমাদের প্রিয় ভাষাটির।

তবে এই অপকর্মের হোতাটি যে শুধু এই ইংরেজি মাধ্যম আর ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, তা কিন্তু নয়। এর জন্য সমানভাবে দায়ী আমাদের মেরুদ-হীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র, অযোগ্য প্রচারমাধ্যম, অপরিপক্ক বিজ্ঞাপনী সংস্থাসমূহ, দেশাত্মবোধবর্জিত কর্পোরেট সম্প্রদায়, কিছু অভিসন্ধিপ্রবণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী এবং অবশ্যই আমাদের অদূরদর্শী অভিভাবকবৃন্দ।

প্রতিক্রিয়াশীল ও পুঁজিবাদী শ্রেণির কাছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসহায় আত্মসমর্পণ; অবক্ষয়ী আমলাতন্ত্রের সীমাহীন দুর্নীতি; নীতিবিবর্জিত ও অক্ষম, অনুকারক প্রচারমাধ্যমের বাংলা ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগের ব্যাপারে প্রবল অনীহা, অগভীর বিজ্ঞাপনী সংস্থাসমূহের চটুল ও চটকদার বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ, কর্পোরেট মহলের সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব ও নির্লজ্জ মুনাফাবৃত্তি; সমাজের এক শ্রেণির মানুষের ভাষিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অপরাজনীতি এবং সবশেষে অভিভাবকশ্রেণির সম্মিলিত অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হয়ে আমাদের বাংলা ভাষাটির বড়ই করুণ দশা আজ।

যে-ভাষার অধিকারের জন্য বায়ান্নে এতগুলো তরুণ প্রাণ ঝরে গেল, যে-ভাষাকে মূলমন্ত্র করে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে এই স্বাধীন দেশটির জন্ম হলো, সেই দেশেই আজ এ-ভাষার কোনও মানমর্যাদা অবশিষ্ট নেই। সর্বত্রই সে এক অপরিসীম অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনার শিকার। আমাদের বাঙালিত্বের প্রধান বাহক ও প্রতীক এই ’বাংলা ভাষা’টির অস্তিত্বই যদি এভাবে হুমকির মধ্যে পড়ে, তাহলে তার ভেতর থেকে উৎসারিত ও উপজাত আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিটিকেও যে আর বেশিদিন সসম্মানে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে সে তো সহজ সমীকরণের বিষয়।

তাই বাংলা সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হলে সবার আগে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে খোদ বাংলা ভাষাটির দিকে। বাংলা ভাষার সুরক্ষার জন্য সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা ও সক্রিয়তার অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের সকলকেই। মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষা বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রধানতম স্মারক। এটি বিপন্ন হলে, বিপন্ন হবে বাঙালির সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবনচর্যা সবই; সেই সঙ্গে বিপন্ন হবে বাঙালির গোটা জাতিগত অস্তিত্ব। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা; সমাজের সর্বস্তরে তার সঠিক প্রয়োগ; তার প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নকেই তাই এই সময়ের বৌদ্ধিক সমাজের অন্যতম প্রধান দাবি ও অভীষ্ট বলে মনে করি।